চরিত্রহীন

উপেন্দ্রর সাড়া পাওয়া গেল না। ভগবান সতীশকে গাহিবার গলা এবং বাজাইবার হাত দিয়াছিলেন। এদিকে তিনি কৃপণতা করেন নাই। শিশুকাল হইতে শুরু করিয়া এই বিদ্যাটাই সে শিক্ষা করিয়াছিল এবং শিক্ষা বলিতে যাহা বুঝায়, ঠিক তেমনি করিয়াই শিখিয়াছিল। সতীশ বাঁশী বাজাইতে লাগিল। সেই শুদ্ধসুন্দর অনির্বচনীয় সঙ্গীত-সৃষ্টি বুঝিবার লোক কেহ ছিল না—শুধু বাহিরে আকাশের খণ্ড চন্দ্র তাহাকে অনুসরণ করিয়া ছুটিয়া চলিতে লাগিল এবং মাটির উপর সুপ্ত জ্যোৎস্নার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। ক্রমে গাড়ির গতি যখন মন্দ হইয়া আসিল এবং বুঝা গেল, স্টেশন নিকটে আসিয়াছে, তখন সে বাঁশী নামাইয়া রাখিল।

উপেন্দ্র হাই তুলিয়া উঠিয়া বসিলেন, নাঃ, যদি শিখতে হয় ত সানাই বাজাতে শিখব। সেদিন তোর সেতার শুনে মিথ্যে একটা সেতার কিনে ফেললাম। টাকাগুলোই মাটি।

সতীশ হাসিয়া বলিল, রক্ষে কর উপীনদা, তাই বলে যেন সানাই কিনো না। ঘরে বসে ও যন্ত্রটা শেখবার চেষ্টা করলে আর পাড়ায় লোক টিকতে পারবে না।

উপেন্দ্র লেশমাত্র কুণ্ঠিত না হইয়া বলিলেন, না, শিখি ত তোরই ঘরে বসে শিখব। বলিতে দুজনেই হাসিয়া উঠিলেন।

পরদিন অনেক বেলায় গাড়ি হাওড়ায় থামিলে উপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, তুই কোথায় যাবি রে?

সতীশ আশ্চর্য হইয়া বলিল, ও আবার কি কথা? তোমার সঙ্গে।

তোর যাবার জায়গা নেই?

বেশ যা হোক তুমি!

এ সম্বন্ধে আর কোন কথাও হইল না।

স্টেশনে নামিতেই একজন বিলাতী পোশাক-পরা বাঙ্গালী সাহেব উপেন্দ্রর হাত ধরিলেন। ইনি উপেন্দ্রর বাল্যবন্ধু জ্যোতিষ রায়, ব্যারিস্টার। ‘তার’ পাইয়া লইতে আসিয়াছেন। বাহিরে তাঁহার গাড়ি দাঁড়াইয়া ছিল। অল্পস্বল্প জিনিসপত্র যাহা সঙ্গে ছিল, কুলি গাড়ির উপরে তুলিয়া দিলে তিনজনে ভিতরে উঠিয়া বসিলেন। বেহারী কোচ-বাক্সে চড়িয়া বসিল এবং কোচম্যান গাড়ি হাঁকাইয়া দিল। অনেক পরে, অনেক রাস্তা-গলি পার হইয়া বড় বড় থাম দেওয়া প্রকাণ্ড একটা বাটীর সম্মুখে আসিয়া গাড়ি থামিল। তিনজনে নামিয়া গেলেন।

পরিচ্ছেদ – বার

সন্ধ্যা হইতে আর বিলম্ব নাই। উপেন্দ্র ও সতীশ পাথুরেঘাটায় একটা অতি সঙ্কীর্ণ গলির মোড়ে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

উপেন্দ্র কহিলেন, এই গলিটাই নিশ্চয় বোধ হচ্চে।

সতীশ সন্দেহ প্রকাশ করিল, এর ভেতরে থাকতে পারে না, এটা কখনও নয়।

ভাঙ্গা দেওয়ালের গায়ে টিন মারা আছে, খুব সম্ভব ইহাতে একদিন গলির নাম লেখা ছিল, এখন আর পড়া যায় না। সতীশ বলিল, ভাল করে না জেনে ঢোকা যায় না, এটা পাতাল-প্রবেশের সুড়ঙ্গও হতে পারে!

উপেন্দ্র সহাস্যে বলিলেন, তুই তবে প্রহরী হয়ে থাক, আমি ভিতরে গিয়ে দেখে আসি।

সতীশ প্রথমে বাধা দিবার চেষ্টা করিল, পরে উপেন্দ্রর পশ্চাতে চলিতে চলিতে বলিল, উপীনদা, আমাদের মত বম্বেটে লোকেরাও এ-সব স্থানে সন্ধ্যের পরে আসতে সাহস করে না, তোমার খুব সাহস ত!

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, বোম্বেটের সাহস কি ভদ্রলোকের চেয়ে বেশী সতীশ? দুষ্কর্ম করতে পারাকেই সাহস বলে না।

সতীশ সে কথার প্রতিবাদ না করিয়া অত্যন্ত সাবধানে পথ দেখিয়া চলিতে লাগিল। পায়ের নীচেই দুর্গন্ধ-পঙ্কিল খোলা নর্দমা, ক্ষীণদৃষ্টি সতীশের তাহাতে পড়িয়া যাইবার সম্পূর্ণ আশঙ্কা ছিল। একস্থানে ক্ষুদ্র গলি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ এবং অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিল। সতীশ পিছন হইতে উপেন্দ্রর জামার খুঁট টানিয়া ধরিল—উপীনদা, করচ কি, এই রাত্রে মারা পড়বে নাকি?

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, আমার এতক্ষণে ঠিক মনে পড়েচে। আর একটা বাড়ির পরেই তেরো নম্বরের বাড়ি। প্রায় বছর-আষ্টেক আগে একদিন মাত্র এখানে এসেছিলাম, সেইজন্যেই প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন চিনেছি, এই পথই বটে।

সতীশ বিশ্বাস করিল না। বলিল, পথ বটে, কিন্তু তোমার আমার জন্যে নয়। যাদের জন্যে বিশেষ করে এই পথের সৃষ্টি, তাদের কারো সঙ্গে গা ঠেকাঠেকি হয়ে গেলে, এ রাত্রে স্নান করে মরতে হবে, এইবেলা ফিরে যাই চল।

উপেন্দ্র জবাব না দিয়া সতীশের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিলেন, এবং আরো একটু আগে আসিয়া একটা বাটীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিলেন, তুই সিগারেট খাস, তোর পকেটে দেশলাই আছে; একবার জ্বেলে দেখ দেখি, এটা ক’নম্বরের বাড়ি।

সতীশ আলো জ্বালিয়া বেশ করিয়া বাড়ির নম্বর পরীক্ষা করিয়া বলিল, ভাল পড়া গেল না, কিন্তু চৌকাঠের গায়ে খড়ি দিয়ে ১৩ নম্বর লেখা আছে। বোধ হয় তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু এই কথা জিজ্ঞাসা করি আমি, বাড়ির নম্বর তেরোই হোক আর তিপ্পান্নই হোক, এখানে তোমার প্রয়োজনটা কি হতে পারে?

উপেন্দ্র উত্তর না দিয়া ডাকিতে লাগিলেন, হারানদা! ও হারানদা!

উপরে, নীচে, কাছে, দূরে সর্বত্র অন্ধকার, শব্দমাত্রই নাই। সতীশ ভীত হইয়া উঠিল, উপেন্দ্র আবার ডাকিতে লাগিলেন।

বহুক্ষণে উপরের জানালা ঈষৎ মুক্ত করিয়া স্ত্রীকণ্ঠে সাড়া আসিল, কে?

উপেন্দ্র বলিলেন, দরজা খুলে দিতে বলুন। হারানদা কোথায়?

যাচ্চি, একটু দাঁড়ান।

0 Shares