চরিত্রহীন

সেটা আলাদা কথা। চুরি প্রমাণ হবার পরে তাকে চোর বলে, চোর জেলে যায়, কিন্তু এঁর সম্বন্ধে কি প্রমাণ তুমি পেয়েছ?

প্রমাণ না হয়েও অনেকে জেলে যায়, সেটা জজসাহেবের হাতে। আমরা যেটা বুঝতে পারিনে, তিনি সেটা বোঝেন। আবার তুমি-আমি যেটা জলের মত সোজা দেখি, অতবড় জজসাহেবের কাছে হয়ত সেটা পাহাড়-পর্বত! আজ তোমার সম্বন্ধেও এ কথা খাটে। মনে কোরো না ভুল বকচি উপীনদা। এতবড় দুনিয়াটা চোখের উপর রেখেও অনেকে ঈশ্বরের প্রমাণ খুঁজে পায় না। তুমি রাগ করবে জানি, কেননা চিরকালটা তুমি ভালর সঙ্গে মিশে, ভাল দেখে, ভাল হয়েই আছ, কিন্তু আমার মত ভাল-মন্দ দেখে যদি পাকা হতে, আমার এত কথা বলবার আবশ্যক হতো না, তোমার নিজের চোখেই অনেক জিনিস ধরা পড়ে যেত!

উপেন্দ্র ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, সমস্ত জিনিস চোখে পড়বার প্রয়োজন আমার নেই, কিংবা পাকা হবার জন্যে তোর মত ইতর হতেও পারব না। তুই এ প্রসঙ্গ বন্ধ কর, গাড়ি ফটকের মধ্যে ঢুকছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস সতীশ, কাঁচার দাম যে কি, সে কেবল তখন বুঝবি যখন আরও পাকা হবি।

পরদিন উঠিতে উপেন্দ্রর বেলা হইয়া গেল। বহুক্ষণ সূর্যোদয় হইয়াছে, তাহা জানালার ফাঁক দিয়া আলোর পানে চাহিয়াই বোঝা গেল। উপেন্দ্র ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া পড়িলেন। ঘরে সতীশ ছিল না, সে কোথায় গিয়াছে। বাহিরে বেহারী দাঁড়াইয়া ছিল, আসিয়া সংবাদ দিল, সতীশবাবু সামনের বাগানে কুস্তি করিতেছেন এবং নীচে চা দেওয়া হইয়াছে, তথায় সাহেব প্রভৃতি অপেক্ষা করিয়া আছেন।

উপেন্দ্র অবিলম্বে প্রস্তুত হইয়া নীচে নামিতেই জ্যোতিষ হাত ধরিয়া চায়ের টেবিলে উপস্থিত করিলেন। সেখানে তাঁহার ভগিনী সরোজিনী অপেক্ষা করিয়া ছিলেন। তিনি খবরের কাগজটা ফেলিয়া দিয়া হাসিমুখে বলিলেন, কাল রাত্রি দশটা পর্যন্ত আমরা আপনাদের পথ চেয়ে বসেছিলুম। শেষে মেজদা বললেন, নিশ্চয়ই কোন নির্দয় বন্ধু পথ হতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছেন, এবং আপনারা হয়ত রাত্রে ফিরতেই পারবেন না। ফিরতে কাল কত রাত্রি হয়েছিল উপীনবাবু?

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, বারোটা। বিশেষ কাজে আবদ্ধ হয়ে গিয়ে সকলকে ক্লেশ দিয়েছি।

জ্যোতিষ বলিলেন, সেটুকু আমরা বুঝি। আমরা মনে করিনি, তোমরা মিছামিছি পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। সতীশবাবু গেলেন কোথায়?

বেহারী হাজির হইয়া নিবেদন করিল, সতীশবাবু বাগানের ওদিকে কুস্তি করিতেছেন এবং তাঁহাকে সংবাদ দেওয়া হইয়াছে।

বেহারী চলিয়া গেলে, জ্যোতিষ উপেন্দ্রর দিকে চাহিয়া বলিলেন, কুস্তি কি হে! আরো কেউ আছেন নাকি?

উপেন্দ্র বলিলেন, আমি ত জানিনে। কুস্তি বোধ হয় নয়, ছেলেবেলা থেকে ওর ব্যায়াম করা অভ্যাস, তাই কোনও রকম কিছু করচে বোধ হয়।

সরোজিনী কাল দুপুরবেলা মিউজিয়ম দেখিতে গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরিয়া শুনিতে পান, উপেন্দ্রবাবু ও তাঁহার বন্ধু আসিয়াছেন। তখন কিন্তু ইঁহারা পাথুরেঘাটার উদ্দেশে বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, সতীশবাবু কে উপীনবাবু? আমি ত দেখিনি।

কাল যে সময়ে আমরা আসি, আপনি ছিলেন না। সতীশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু, যদিও বয়সে অনেক ছোটো—ঐ যে—

সতীশ ঘরে প্রবেশ করিল। কি সুন্দর বলিষ্ঠ উন্নত দেহ! কপালে তখনও বিন্দু বিন্দু ঘাম রহিয়াছে, সুশ্রী গৌরবর্ণ মুখে রক্তাভা পড়িয়া আরও সুন্দর দেখাইতেছে।

সরোজিনী মুহূর্তমাত্র চাহিয়াই চোখ নত করিলেন।

জ্যোতিষ বলিলেন, বেহারী বলছিল, আপনি কুস্তি করছিলেন। কিন্তু কুস্তিই করুন, আর যাই করুন, আপনার দেহের দিকে চাইলে হিংসে হয়, আমাদের মত চার-পাঁচজনেও বোধ করি আপনার কাছে ঘেঁষতে পারে না।

সতীশ একটুখানি হাসিয়া বলিল, বিনা-পরীক্ষায় অতবড় সার্টিফিকেট দেবেন না। তা ছাড়া শুধু গায়ের জোর নিয়েই বা কি হবে, আমার আর কোন জোরই নেই।

কথার শেষদিকটায় দুঃখের আভাস বাজিল। সরোজিনী চা ঢালিতে ঢালিতে মনে মনে আন্দাজ করিলেন, সতীশবাবুর সাংসারিক অবস্থা বোধ করি ভাল নয়। জ্যোতিষ পূর্বেই উপেন্দ্রর নিকট সমস্ত শুনিয়াছিলেন, তিনি চুপ করিয়া রহিলেন। ইতিমধ্যে চায়ের বাটিগুলি পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। সতীশ সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবির দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

জ্যোতিষ বলিলেন, আসুন সতীশবাবু, সমস্তই প্রস্তুত।

সতীশ সরিয়া আসিয়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, আপনারা শুরু করে দিন, আমি স্নান না করে কিছুই খাইনে।

বিলক্ষণ! আমি ত এ কথা জানিনে, তবে যান, আর দেরী করবেন না,—বেয়ারা—

না না, আপনি ব্যস্ত হবেন না। স্নান আমার যথাসময়েই হবে, তা ছাড়া সকালবেলা খাওয়া আমার অভ্যাস নেই। মধ্যাহ্নের ভোজনটা আমার সাধারণ পাঁচজনের চেয়ে কিছু বেশী—সেটা অসময়ে চা প্রভৃতি বাজে জিনিস খেয়ে নষ্ট করতে ভালবাসি নে। তার চেয়ে আমি ঐ হারমনিয়মটা খুলে দুটো ভজন করি, আপনাদের দু’কাজই চলুক।

গান গাইবার প্রস্তাবে সরোজিনী অত্যন্ত প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। মুখ তুলিয়া হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, সেই ভাল। কিন্তু পরক্ষণেই অপ্রতিভ হইয়া মুখ নত করিল। কথাটা তাহার নিজের কানেও কেমন কেমন শুনাইল। জ্যোতিষ হাসিয়া বলিলেন, বোনটি আমার গান পেলে আর কিছুই চায় না। না না সতীশবাবু, আপনি—

0 Shares