চরিত্রহীন

উপেন্দ্র এতক্ষণ চুপ করিয়া মনে মনে বিরক্ত হইতেছিলেন, বলিয়া উঠিলেন, না না তবে কি? ও স্নান না করে খায় না, সকালবেলা খায় না। আমরা ওকে ক্রমাগত সাধ্য-সাধনা করতে থাকি, আর চা’র বাটি ঠাণ্ডা জল হয়ে যাক। নে সতীশ, তোর কি ভজন-টজন আছে সেরে নে, আমার আরও কাজ আছে। বলিয়া চা’র বাটি মুখে তুলিয়া দিলেন।

জ্যোতিষ মনে মনে অত্যন্ত আরাম বোধ করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন।

সতীশ দূরে একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িল, ইহার পরে আর তাহার গান গাহিবার উৎসাহ রহিল না। সরোজিনী বিমর্ষ হইয়া নতমুখে চা নাড়িতে লাগিলেন।

উপেন্দ্র চা খাইতে খাইতে বলিলেন, কোথাও ওকে নিয়ে যদি স্বস্তি পাওয়া যায়! এমন ছিষ্টিছাড়া স্বভাব ওর, একটা-না-একটা কিছু বাধিয়ে দেবেই। ও যে সকালবেলা গান গাইবার বদলে সানাই বাজাবার প্রস্তাব করেনি, এই ভাগ্য।

কথাটার মধ্যে যে সত্যের আভাস বিন্দুমাত্রও ছিল, তাহা কেহই অনুমান করিতে না পারিয়া পরিহাসচ্ছলে সকলেই হাসিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে চা-খাওয়া চলিতে লাগিল। ওদিকে সতীশ আর চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে না পারিয়া ঘরের ছবিগুলি ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল।

সন্ধ্যার পর এক সময়ে সরোজিনী আস্তে আস্তে উপেন্দ্রকে বলিলেন, সকালে আপনি গান শুনতে দেননি, আপনার ভারী অন্যায়।

উপেন্দ্র বলিলেন, আচ্ছা, এ বেলা তার প্রতিকার হতে পারবে, আসুক সতীশ।

জ্যোতিষ বলিলেন, বাস্তবিক উপেন, যে ঠাণ্ডা পড়েছে, কোথাও বার হতে ইচ্ছা হয় না, একটু গান-বাজনা হলে মন্দ হতো না। কিন্তু সতীশবাবু কৈ? ডাক্তারি করতে যাননি ত?

উপেন্দ্র বলিলেন, হতেও পরে। আলাপী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে বোধ হয়।

সরোজিনী আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, সতীশবাবু ডাক্তার বুঝি?

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, হ্যাঁ।

জ্যোতিষ বলিলেন, না হে উপেন, শুধু স্কুলে পড়লে হবে না। কোন ভাল হোমিওপ্যাথের সঙ্গে যদি কিছুদিন ঘুরে বেড়াতে পারেন, তা হলেই কিছু শিখবেন। না হলে ঐ যে কথায় বলে, শতমারী সহস্রমারী—কেবল মেরে মেরেই বেড়াবেন! আমি একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে জুটিয়ে দিতে পারি, কিন্তু কেমন বনিবনাও হয় বলা যায় না—তুমি যে-রকম সার্টিফিকেট দিচ্ছ—

উপেন্দ্র বলিলেন, লোক ভাল হলে নিশ্চয় বনবে, অন্যথায় রক্তারক্তি ঘটবে।

সরোজিনী বিস্ময়ে চাহিয়া রহিলেন, জ্যোতিষ বলিলেন, আরও ভাল।

উপেন্দ্র বলিলেন, ভালই। ওকে চিনতে পেরে, ওর দোষগুণ সমস্ত বুঝে নিয়ে, যে ওর মন পাবে, সে বড় ভাল জিনিসটিই পাবে। কিন্তু পাওয়াই শক্ত। ও যে জটিল বা দুর্বোধ তা নয়, বরং খুব সোজা, খুব স্পষ্ট। আমার মনে হয়, এত স্পষ্ট বলেই মানুষে ওকে ভুল বোঝে।

মতে অনৈক্য হলে আমরা যেখানে ভদ্রতার দোহাই পাড়ি এবং শিষ্টভাবে মতভেদ করে মন ভার করে চলে আসি, ও সেখানে হাতাহাতি করে মীমাংসা করেই আসে, মন ভার করে আসে না। ছেলেবেলা থেকে ওকে জানি, কখনও দেখিনি ওর মুখের কথা আর মনের কথা আলাদা হয়েছে। এত ভালবাসি এইজন্যেই।

জ্যোতিষ হাসিতে লাগিলেন। বলিলেন, এইজন্যেই সাধারণের মাঝে নিয়ে চলাফেরা শক্ত বলছিলে?

জ্যোতিষের দিকে তখন উপেন্দ্রর মন ছিল না। তাই তাঁহার কথাগুলা কানে গেলেও অন্তরে প্রবেশ করিল না। বাল্যবন্ধুর বিরুদ্ধে কাল রাত্রির ব্যবহার ও রূঢ় ভাষা তাঁহাকে ভিতরে ভিতরে ক্লেশ দিতেছিল, সেইজন্য কথায় কথায় মন তাঁহার গত দিনের অতি নিভৃত প্রদেশে প্রবিষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। কিশোর-দিনের ছোট-বড় কলহ-বিবাদে বিভিন্ন পাড়ার সম ও অসম-বয়সীদের সহিত হাতাহাতি, পেটাপেটি, বাদ-বিসংবাদ এবং আরও অনেক আপদ-বিপদে সর্বত্র সতীশ তাহার মস্ত দেহ ও মস্ত জোর লইয়া তাঁহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সেই সমস্ত স্মৃত ও বিস্মৃত কাহিনীর মাঝখানে আসিয়া হঠাৎ তাঁহার হৃদয় অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়া উঠিল এবং জ্যোতিষের কথায় উপেন্দ্র যখন বলিলেন, হ্যাঁ এইজন্যই। ঠিক এইজন্যই চিরকাল ওকে এত ভালবাসি। জ্যোতিষ ও সরোজিনী উভয়েই বিস্মিতমুখে চাহিয়া রহিলেন। এই অসংবদ্ধ কথার কেহই অর্থ গ্রহণ করিতে সমর্থ হইলেন না।

কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্নেরও সময় রহিল না। নিঃশব্দে পর্দা সরাইয়া সতীশ প্রবেশ করিল। তাহাকে প্রথমে দেখিতে পাইলেন সরোজিনী। তিনিই আনন্দকলরবে সংবর্ধনা করিয়া উঠিলেন—বেশ হয়েছে, সতীশবাবু এসে পড়েচেন।

সতীশ নীরবে সকলকে চাহিয়া দেখিয়া হাসিমুখে বলিল, আমার কথা হচ্ছিল বুঝি? উপীনদা আমাকে আর মুখ দেখাতে দেবে না, বলিয়া অনতিদূরে একটা কোচের উপর বসিতে গেলে, উপেন্দ্র হাত দিয়া হারমনিয়ম যন্ত্রটা দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, একেবারে ঐখানে গিয়ে বসো, সরোজিনী এইমাত্র আমাকে দোষ দিচ্ছিলেন, শুধু আমার জন্যেই ও-বেলা গান হতে পায়নি।

সতীশ নির্দিষ্ট আসনে উপবিষ্ট হইয়া সকৌতুকে বলিল, এখন ত গান হতে পারবে না—এটা যে আমার সানাই বাজাবার সময় উপীনদা!

সে রাত্রে একটু অধিক রাত্রে সভা ভাঙ্গিবার পরে বিছানায় শুইয়া সরোজিনী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে বলিল, উনি যদি আমাদের কোনো আত্মীয় হতেন ত ওঁর কাছেই শিখতুম। সঙ্গীত-শিক্ষার জন্য তাহার একজন হিন্দুস্থানী ওস্তাদ নিযুক্ত ছিল। ইহারই স্থানে সতীশকে কল্পনা করিবার জন্য নানাবিধ উপায় উদ্ভাবন করিতে করিতে এক সময়ে ঘুমাইয়া পড়িল।

0 Shares