চরিত্রহীন

বলিয়াই মুখ ফিরাইয়া হাসিতে লাগিল।

কুপিত ডাক্তারের প্রথমে ইচ্ছা করিল ঐ মুখ চড় মারিয়া বন্ধ করিয়া দেয়, কিন্তু সেটা ত সম্ভব নহে, শুধু বলিল, যাও তুমি।

আমি যাব কোথায়? বাড়ি আমার, যেতে হলে তোমাকেই হয়!

আমি যাচ্ছি, বলিয়া সে গমনোদ্যত হইতেই কিরণময়ী দুই চৌকাটে হাত দিয়া পথরোধ করিয়া বলিল, যাচ্চো, কিন্তু জেনে যাও, এই যাওয়াই শেষ যাওয়া।

তাহার কণ্ঠস্বর ও মুখের বিস্ময়কর পরিবর্তনে ডাক্তার শঙ্কিত হইল। কিন্তু মুখে বলিল, বেশ তাই, এই শেষ যাওয়া।

কিরণময়ী বলিল, সত্যিই শেষ যাওয়া। যখন এসে পড়েছ তখন স্পষ্ট করেই সবটা জেনে যাও। আচ্ছা, ঐ ওখানে বসো, সমস্ত খুলে বলচি, বলিয়া ডাক্তারের হাতব্যাগটা লইয়া নিজে মেঝের উপর রাখিয়া দিল এবং হাত দিয়া চৌকি দেখাইয়া দিয়া বলিল, রাঁধতে হবে, বেশী সময় নেই, সংক্ষেপে বলচি—

এমন সময়ে ঝি আসিয়া সংবাদ দিল, দু’জন বাবু আসচে। সেই সঙ্গেই নীচে জুতার শব্দ শুনিয়া কিরণময়ী ব্যাধ-ভয়ে ভীতা হরিণীর ন্যায় ঝিকে সবেগে ঠেলিয়া দিয়া ঘর হইতে ছুটিয়া পলাইয়া গেল। ডাক্তার ও ঝি আশ্চর্য হইয়া পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

অনতিকাল পরেই জুতার শব্দ দ্বারের কাছে আসিয়া থামিল। ডাক্তার দেখিল, দুটি অপরিচিত ভদ্রলোক। ভদ্রলোক দুটি দেখিলেন, ডাক্তার। তাহার কোটের পকেট হইতে বুক-পরীক্ষার চোঙটা গলা বাড়াইয়া পরিচয় জানাইয়া দিল। উপেন্দ্র, সতীশ দেখিলেন ডাক্তারের মুখ অতিশয় শুষ্ক। দুর্ঘটনা আশঙ্কা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু?

ডাক্তার নীরব। মুখ তাহার আরো কালি হইয়া গেল।

উপেন্দ্র অধিকতর শঙ্কিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন, এখন কি রকম দেখলেন?

তথাপি ডাক্তার কথা কহিল না, বিহ্বলের মত চাহিয়া রহিল।

ঝি কহিল, তুমি যাও না ডাক্তারবাবু, এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন?

ডাক্তার ব্যস্ত হইয়া ব্যাগটা তুলিয়া বলিল, আমি যাই, অনেক কাজ আছে আমার, বলিয়াই উপেন্দ্র, সতীশের মাঝখান দিয়া দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেল। এবং এই মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া ঝিটি যে কোথায় মিলাইয়া গেল তাহা জানাও গেল না।

সেই নিস্তব্ধ ভাঙ্গা বাড়ির ভাঙ্গা বারান্দার উপর বেলা ন’টার সময়ে উপেন্দ্র, সতীশ নির্বাক-বিস্ময়ে উভয়ে উভয়ের মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

কিছুক্ষণ পরে সতীশ বলিল, উপীনদা, হারানবাবুর মা কি পাগল?

উপেন্দ্র বলিলেন, ও হারানদার মা নয়, আর কেউ—বোধ করি ঝি। কিন্তু আমি ভাবচি, ডাক্তার ও-রকম করে গেল কেন?

সতীশ বলিল, ঠিক চোরের মত যেন ধরা পড়বার ভয়ে পালিয়ে গেল।

উপেন্দ্র অন্যমনস্কভাবে বলিলেন, প্রায়। কাউকে ত দেখা যায় না, ঐ ঘর হারানদার না?

সতীশ বলিল, হাঁ, যাই চল।

কিন্তু হঠাৎ ঢুকতে সাহস হয় না। আমার ভয় হচ্চে হয়ত কিছু ঘটেছে।

সতীশ কহিল, সে হলে চীৎকার করবার লোক জুটত—তা নয়।

এমন সময় দেখিতে পাওয়া গেল, ও-ধারের বারান্দা ঘুরিয়া বধূ আসিতেছে। মনে হইল, যেন এইমাত্র সে কাঁদিতেছিল—চোখ মুছিয়া উঠিয়া আসিয়াছে। কাল দীপের আলোকে যে মুখ সুন্দর দেখাইয়াছিল, আজ দিনের বেলা, সূর্যালোকে স্পষ্ট বোঝা গেল, এমন সৌন্দর্য আর কোনদিন চোখে পড়ে নাই। জীবিতও না, ছবিতেও না।

বধূ কহিল, আজ আমরা প্রস্তুত ছিলুম না। ভেবেছিলুম আসব বলে গেলেও হয়ত আসতে পারবেন না। সতীশের দিকে চাহিয়া সহসা মৃদু হাসিয়া কহিল, ঠাকুরপো যে!

আজ সতীশ মাথা হেঁট করিল।

উপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, হারানদা কেমন?

বধূ সংক্ষেপে উত্তর দিল, তেমনি। আসুন ও-ঘরে যাই।

হারানের ঘরে তাঁর জননী অঘোরময়ী শয্যার পার্শ্বে উপবিষ্টা ছিলেন। উপেন্দ্র প্রণাম করিতেই তিনি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন।

হারান শ্রান্তকণ্ঠে নিষেধ করিয়া বলিল, চুপ কর মা।

উপেন্দ্র লজ্জায় দুঃখে একধারে বসিয়া পড়িলেন।

সতীশ এদিক ওদিক চাহিয়া মুখ যথাসাধ্য ভারী করিয়া সেই কাঠের সিন্দুকটির উপর গিয়া বসিল।

বধূ মুহূর্তমাত্র দাঁড়াইয়া সতীশের দিকে বিদ্যুদ্দাম কটাক্ষ করিয়া বাহির হইয়া গেল, যেন স্পষ্ট শাসাইয়া গেল, তোমরা কাজটা ভাল করিতেছ না।

পরিচ্ছেদ – পনের

সতীশ স্থির করিল, সে ডাক্তারী পড়া ছাড়িবে না। তাই পরদিন সন্ধ্যার সময় কাহাকেও কিছু না বলিয়া বেহারীকে সঙ্গে করিয়া তাহার সাবেক বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। বাড়িটা তখনও খালি পড়িয়া ছিল, বাড়িওয়ালাকে ধরিয়া ছয় মাসের বন্দোবস্ত করিল এবং নিকটবর্তী হিন্দু-আশ্রমে গিয়া সন্ধান করিয়া এক পাচক নিযুক্ত করিয়া খুশী হইয়া বাহির হইয়া পড়িল। বেহারীকে কহিল, আমরা কালই চলে আসব—কি বলিস বেহারী?

বেহারী সম্মতি জানাইল।

পথে চলিতে চলিতে সতীশ বলিল, কাজটা ভাল হয় না বেহারী। যাই হোক সে আমার ঢের করেছে; তা ছাড়া একরকম ধরতে গেলে আমার জন্যেই তার ও-বাসার কাজটা গেল, একবার খবর দেওয়া উচিত।

বেহারী বুঝিল, কাহার কথা হইতেছে—চুপ করিয়া রহিল।

সতীশ বলিতে লাগিল, যে কেউ হোক না কেন, পথের ভিখিরী হলেও দুঃখে পড়লে দেখা চাই—না হলে মানুষ-জন্মই বৃথা।

0 Shares