চরিত্রহীন

এই লোকটি ভিতরে ভিতরে যে কিরূপ দগ্ধ হইতেছিল এবং এই-সমস্ত যে তাহারই উৎক্ষিপ্ত ভস্মাবশেষ, কিরণময়ী তাহা নিশ্চিত বুঝিয়াও শান্ত-দৃঢ়স্বরে মুখ তুলিয়া কহিল, না। আপনি একটু দাঁড়ান, আমি এখনি এনে দিচ্ছি, বলিয়াই পাশের দরজা খুলিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

এইবার ডাক্তার শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। কিরণকে তিনি চিনিতেন। কোথায় কি যে আনিতে গেল, হঠাৎ এত রাত্রে কি একটা অসম্ভব কাণ্ড করিয়া কোথাকার হাঙ্গামা কোথায় টানিয়া আনিবে, এই দুর্ভাবনা তাঁহাকে তদ্দণ্ডেই চাপিয়া ধরিল। সে আঘাত খাইয়া চলিয়া গিয়াছে, ফিরিয়া আসিয়া

নির্দয় প্রতিঘাত করিবেই। সেই নিঃসন্দেহ প্রতিশোধের কঠোরতা কল্পনা করিয়া অনঙ্গমোহন আশঙ্কায় স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন।

ফিরিয়া আসিতে কিরণময়ীর বিলম্ব হইল না। সে নীরবে নতমুখে আঁচলে বাঁধা কতকগুলা অলঙ্কার ডাক্তারের পায়ের কাছে উজাড় করিয়া দিয়া আস্তে আস্তে কহিল, এই নিন আপনি। আপনার দাবী যে কত, সে হিসাব এতদিন পরে করতে যাওয়া বৃথা। অত সময়ও আমার নেই, ধৈর্যও থাকবে না—যা-কিছু আমার ছিল, সমস্তই আপনাকে এনে দিয়েছি, এই নিয়ে আমাদের মুক্তি দিন,—আপনি যান।

অনঙ্গ পাংশুমুখে চুপ করিয়া রহিলেন; কিরণ কহিল, দেরী করচেন কিসের জন্য? বিশ্বাস করুন, আর আমার কিছুই নেই—যা ছিল সমস্তই এনে দিয়েচি—রাত হচ্চে, আপনি বিদেয় হোন।

অনঙ্গ সভয়ে বলিলেন, আমি ত তোমার গায়ের গয়না চাইনি—টাকা চেয়েছিলুম মাত্র। তাও—

কিরণ অত্যন্ত অসহিষ্ণুভাবে বলিয়া উঠিল, গয়না যে টাকা, সে কথা বোঝবার বয়স আপনার হয়েচে। অনর্থক ছুতো করে কেন মিছে দেরী করচেন!

এবার অনঙ্গ সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিয়া উঠিলেন, না, আমি কিছুতেই এ-সব নিতে পারব না।

কিরণময়ী অদূরে বসিয়া পড়িয়াছিল, বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া দাঁড়াইল—কেন পারবেন না? আপনি দয়া করচেন কাকে? আপনাকে যা দিলুম, কোনমতেই আর তা ফিরিয়ে নিতে পারব না, এ কথা নিশ্চয় বললুম। একমুহূর্তে মৌন থাকিয়া কহিল, আপনি যদি নাও নেন, কাল সমস্তই গরীব-দুঃখীকে বিলিয়ে দেব, কিন্তু বাড়িতে রেখে কোনমতেই আমার স্বামীর অকল্যাণ করব না,—বলিয়া পা দিয়া সেগুলা ঈষৎ ঠেলিয়া দিয়া কহিল, নিন তুলুন ও-সব! শেষ কথাগুলা এতই কঠিন শুনাইল যে, হতবুদ্ধি অনঙ্গমোহন হেঁট হইয়া সেগুলা কুড়াইতে লাগিলেন।

কিরণময়ী ক্ষণকাল সেইদিকে চাহিয়া থাকিয়া উগ্রতা সংবরণ করিয়া নিরতিশয় ঘৃণাভরে কহিল, নিয়ে যান। এ-সব চিহ্ন এ বাড়িতে থাকা পর্যন্ত আমার মুখে অন্নজল রুচবে না, চোখে ঘুম আসবে না।

ডাক্তার সবগুলি কুড়াইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কিরণময়ী অধীরভাবে কহিল, রাত অনেক হলো যে!

ডাক্তার কহিলেন, যাচ্চি। কিন্তু তুমিও ভুল করলে। এ-সব আমি দিইনি, সমস্তই তোমার নিজের। তবুও কেন যে আমি না নিলে গরীব-দুঃখীকে বিলিয়ে দেবে, বুঝতে পারলুম না। আমাকে মাপ কর কিরণ।

কিরণময়ী ধমকাইয়া উঠিল—আবার নাম করে! হাঁ, ওগুলো আমার জিনিসই বটে, কিন্তু ঐ-গুলোর মায়াতেই আপনার সাহায্য নিয়েছিলুম।—রাত ঢের হলো যে ডাক্তারবাবু।

ডাক্তার নিজের নাম-ছাপানো একখণ্ড কার্ড বাহির করিয়া বলিলেন, আমার বাড়ির ঠিকানাটা—

দিন,—বলিয়া কিরণময়ী হাত বাড়াইয়া গ্রহণ করিল এবং পিছাইয়া আসিয়া জ্বলন্ত উনানে উহা নিক্ষেপ করিয়া বলিল, এর বেশী আমার আবশ্যক হবে না। আপনি এইমাত্র ক্ষমা চাইছিলেন না? আপনাকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করতে পারব বলেই আপনার সমস্ত ঋণ, সমস্ত সম্বন্ধ, নিঃশেষ করে দিলুম। কোনদিন কোন কারণে যেন আপনাকে আমার মনে না পড়ে, যাবার সময় শুধু এই কথা বলে যান। আর কোনরূপ প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই সশব্দে কবাট বন্ধ করিয়া দিয়া তাহার রান্নার জায়গায় ফিরিয়া আসিয়া বসিল।

বাহিরে ডাক্তারের পায়ের শব্দ যখন তাহার কানে দূরে চলিয়া গেল, তখন সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চাহিয়া

দেখিল, উনুন নিবিয়া গিয়াছে। ফুঁ দিয়া জ্বালিয়া দিয়া আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া বসিল।

তৃষ্ণায় গলা শুকাইয়া গেছে, তথাপি সে উঠিতে পারিল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, বাহিরের অন্ধকারে তখনও কি-একটা আতঙ্ক যেন তাহারই জন্য হাত বাড়াইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। বুকের ভিতরটা এমনি অশান্ত হইয়া উঠিল যে, দুই বাহু দিয়া সজোরে চাপিয়া রাখিল। এই বিদায়ের পালাটা একদিন তাহাকে সমাপন করিতেই হইবে, ইহা সে নিশ্চয় জানিত, কারণ আগাছা তাহার সর্বদেহে মূল বিস্তার করিয়া তাহাকে নিরন্তর আচ্ছন্ন করিতেছে এ কথা সে যতই মনে করিয়াছে, ততই মন তাহার তিক্ত বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছে, তথাপি এই

বীভৎস বন্ধনপাশ হইতে নিজেকে মুক্ত করিয়া লইবার মত জোর সে নিজের মধ্যে কিছুতেই খুঁজিয়া পায় নাই। এমনি করিয়া দিন বহিয়া গিয়াছে—অনুক্ষণ সহ্য করিয়াছে, কিন্তু কিছুই করিতে পারে নাই। সেই এতবড় শক্ত কাজটা যে এত সহজে হইয়া গেল, তাহাই কিরণময়ী চুপ করিয়া বসিয়া অন্তরে অন্তরে অনুভব করিতে লাগিল। প্রয়োজনের অনুরোধে যে পাপ নিজের ঘরে ডাকিয়া আনিয়া বড় করিয়াছে, সে যে আজ ‘যাও’ বলিতেই গেল, এমন অসম্ভব কেমন করিয়া হইল! মান-ভিক্ষা, সাধাসাধি, কান্নাকাটি, মর্মস্পর্শী অনুনয়-বিনয়, এ কাজের অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারগুলা যাহার কল্পনামাত্র তাহাকে প্রতিদিন তপ্তশেলে বিঁধিয়া গেছে, সে-সমস্তই যে বাকী রহিল! সে কি আর একদিনের জন্য, না সত্যই সমস্ত নিঃশেষ হইল!

0 Shares