চরিত্রহীন

সাড়া না পাইয়া সস্নেহ-কণ্ঠে বলিল, রোগা দেহ, ঠাণ্ডায় অসুখ করবে যে মা! উঠে বোস, আমি একটা মাদুর পেতে দিই।

সাবিত্রী নির্বাক্‌, স্থির।

বেহারী বিস্মিত হইল। ভাল দেখা যাইতেছিল না, প্রদীপটা মুখের কাছে আনিয়া একটু ঝুঁকিয়া ঠাহর করিয়া দেখিয়াই বুড়া চীৎকার করিয়া উঠিল, মা গো, এ কি করলি মা!

সাবিত্রীর নয়ন মুদ্রিত, সমস্ত মুখ নীলবর্ণ। এতবড় চিৎকারেও সে সাড়া দিল না—তেমনি মৃতবৎ পড়িয়া রহিল।

উপরের ঘরে সতীশ তখনও একই ভাবে মূর্তির মত বসিয়া ছিল, বেহারীর কান্নার শব্দে চমকিয়া উঠিল। রান্না ফেলিয়া বামুনঠাকুর ছুটিয়া আসিয়া খবর দিল।

সতীশ বেহারীর ঘরে ঢুকিয়া সাবিত্রীর মাথার কাছে হাঁটু গাড়িয়া বসিল, এবং আলো লইয়া মুখপানে চাহিয়াই বুঝিল সে মূর্ছিত হইয়াছে। কহিল, চেঁচাস নে বেহারী, ওর মুখেচোখে জল দে—বামুনকে বল্, একটা পাখা নিয়ে বাতাস করুক।

সাহস পাইয়া বেহারী সজোরে জলের ছিটা দিতে লাগিল এবং হিন্দুস্থানী পাচক প্রাণপণে পাঙ্খা হাঁকিতে লাগিল।

খানিক পরে সাবিত্রী নিশ্বাস ফেলিল এবং পরক্ষণেই চোখ মেলিয়া মাথায় কাপড় টানিয়া দিয়া উঠিয়া বসিল।

সতীশ কহিল, ঠাকুর বেশী করে খানিকটা গরম দুধ নিয়ে আসুক; আর ভিজে কাপড়টা শিগগির ছেড়ে ফেলতে বল বেহারী।

ঠাকুর দুধ আনিতে গেল, বেহারী মৃদুস্বরে বোধ করি তাহাই কহিল।

মিনিট-খানেক চুপ করিয়া থাকিয়া সতীশ পুনরায় কহিল, সুস্থ বোধ করলে কোথায় ও যাবে, জিজ্ঞাসা করে একটা গাড়ি ডেকে দিস বেহারী—এর ওপর যেন হেঁটে না যায়।

সাবিত্রীর সর্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল, কিন্তু ক্ষীণ আলোকে কেহ তাহা লক্ষ্য করিল না। সে প্রাণপণে আত্মসংবরণ করিয়া নিশ্চল হইয়া রহিল।

সতীশ আরও মিনিট-খানেক স্থির থাকিয়া বলিল, আর যদি সুস্থ বোধ না করে, না হয়, আমার ঘরেই শুতে বলিস, আমি আর কোথাও যাচ্চি।

সাবিত্রী শিহরিয়া অনুভব করিল, বুঝি-বা সে কোনমতেই আর আপনাকে ধরিয়া রাখিতে পারে না।

সতীশ একটা ক্ষুদ্র চাবি বেহারীর কাছে ফেলিয়া দিয়া বলিল, আর দ্যাখ, দেরাজের চাবিটা তোর কাছেই রইল, যা টাকার দরকার হয়, যাবার সময় যেন নিয়ে যায়, রুগ্ন শরীরে যেন—

সতীশের কথাগুলা বিষ এবং অমৃতে মিশিয়া সাবিত্রীর কণ্ঠ পর্যন্ত ফেনাইয়া উঠিল। সতীশ কহিল, আমি পাথুরেঘাটায় যাচ্চি বেহারী—কাল ফিরতে বোধ করি একটু বেলা হবে। এক-পা পিছাইয়া গিয়া কহিল, সাবিত্রী, কোন সঙ্কোচ কোরো না, যা আবশ্যক হয় নিয়ো—আমি চললুম।

সতীশ চলিয়া গেল।

সাবিত্রী আর একবার ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল। বুকফাটা-কণ্ঠে কাঁদিয়া বলিল, ওগো, কেন তুমি এই পাপিষ্ঠাকে এত ভালবেসেছিলে? এই যে শপথ করলে আমাকে ঘৃণা কর, এই কি ঘৃণা করা? তোমাকে এই দুঃখ দেওয়া, এত মিথ্যা বলা, সবই তোমার স্নেহের আগুনে পুড়ে কি ছাই হয়ে গেল? কে আমাকে বলে দেবে কি করলে আমি তোমার ঘৃণা পাব?

বেহারী এই কান্নার বিন্দুমাত্র অর্থও বুঝিতে পারিল না, একটুখানি কাছে সরিয়া সান্ত্বনার স্বরে বলিল, আচ্ছা, কেন মা, বাবুর কাছে এত মিথ্যে কথা বললে? যেখানে যাওনি, যে দোষ করনি, কি জন্যে সেই-সব নিজের ঘাড়ে নিয়ে এত অপরাধী হয়ে রইলে?

সাবিত্রী কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, ধর্ম জানেন বেহারী, আমার সমস্ত কথাই মিথ্যে। বলতে বুক ফেটে গেছে, তবুও বলতে হয়েছে। কিন্তু, কোন কাজেই ত এলো না বেহারী, কোন কাজেই যে এলো না।

বেহারী মূঢ়ের মত মুখপানে চাহিয়া বলিল, মিথ্যে আবার কি কাজে আসে মা?

সাবিত্রী উঠিয়া বসিয়া চোখ মুছিল। তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, ঠিক জানো বেহারী, কোন কাজেই কি আসে না?

বেহারী ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিল, তা আসে বৈ কি। আদালতে মিথ্যাতেই ত কাজ হয়—সেখানে মিথ্যা কথারই ত জয়-জয়কার।

সাবিত্রী জবাব দিল না। বহুক্ষণ স্থিরভাবে বসিয়া থাকিয়া বলিল, কেন এত মিথ্যা বলে গেলুম, হয়ত একদিন বুঝতে পারবে। কিন্তু সে কথা যাক, বেহারী, আমার দুটি কথা রাখবে?

রাখব বৈ কি মা। কি কথা?

একটা কথা এই যে, আমি চলে গেলেও কোনদিন বাবুকে জানিয়ো না, আমি তাঁকে আগাগোড়া মিথ্যে বলে গিয়েছিলুম।

বেহারী মৌন হইয়া রহিল। সাবিত্রী কহিল, আর একটা কথা—আমার ঠিকানা তোমাকে লিখে জানাব। যদি কখনো বোঝো, আমার আসা দরকার, আমাকে জানিয়ো। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই বেহারী, আমি ছাড়া ওঁকে কেউ শাসন করতেও পারবে না, আমার চেয়ে বিপদের দিনে কেউ সেবা করতেও পারবে না।

বেহারী কাঁদিয়া ফেলিল। চোখ মুছিয়া রুদ্ধস্বরে বলিল, সব জানি মা।

সাবিত্রী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, তবে চললুম, ওঁকে তোমার হাতেই দিয়ে গেলুম—দেখো বেহারী, আমার দুটি কথা রেখো। ভগবান করুন, তোমরা সুখে থাকো—আমার এই পোড়ামুখ নিয়ে যেন আর তোমাদের সামনে আমাকে আসতে না হয়। বলিয়া সাবিত্রী চোখ মুছিয়া অগ্রসর হইল।

রাস্তায় আসিয়া গাড়ি ভাড়া করিয়া সাবিত্রীকে তুলিয়া দিয়া বেহারী গড় হইয়া প্রণাম করিল। চোখ মুছিয়া গলা পরিষ্কার করিয়া বলিল, মা, আমারও একটি নিবেদন আছে। আজ যেমন ছেলে বলে মনে করেছিলে, দরকার হলে আবার স্মরণ করবে?

0 Shares