চরিত্রহীন

দিবাকর অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তার পরে ধীরে ধীরে কহিল, বৌদি, আপনি আত্মা মানেন না?

না।

কেন?

মিথ্যে কথা বলে। তা ছাড়া এমন দম্ভ আমার মনে নেই যে, সমস্তই নাশ হবে, শুধু আমার এই মহামূল্য আমিটির কোনদিন ধ্বংস হবে না। এমন কামনাও করিনি যে, আমার মৃত্যুর পরেও আমার আমিটি বেঁচে থাকুক।

আচ্ছা ঈশ্বর? তাঁকেও কি আপনি স্বীকার করেন না?

কিরণময়ী হাসিয়া কহিল, অত ভয়ে ভয়ে বলচ কেন ঠাকুরপো? এতে ভয়ের কথা কিছু নেই; না, আমি অস্বীকারও করিনে।

দিবাকর প্রগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে যেন একটু আলোর রেখা দেখিতে পাইল। জিজ্ঞাসা করিল, তাঁকে আপনি কি করে চিন্তা করেন?

কিরণময়ী কহিল, যে বস্তুকে অজ্ঞেয় বলে নিশ্চয় বুঝেচি, তাকে চিন্তা করাও যায় না, করিও নে। বস্তুতঃ, অচিন্তনীয়কে চিন্তা করব কি দিয়ে? তাই অসম্ভবকে সম্ভব করবার চেষ্টা কোনদিন আমার নেই। একটা জিনিসকে বাড়িয়ে বড় করা যায়, আরও বাড়ালে আরো বড় করা যায় তাও জানি, কিন্তু, তাকে টেনে টেনে অনন্ত করে তোলা যায়, এ ভুল আমার কখনো হয় না।

তবে কি তাঁকে ভাবাই যায় না?

যায় ঠাকুরপো, ছোট করে নিয়ে ভাবা যায়। মানুষের দোষ-গুণ জড়িয়ে দিয়ে ছোটখাট ঠাকুর-দেবতা করে নিয়ে, নিরক্ষর লোকে যেমন করে ভক্তি দিয়ে ভাবে, তেমনি করেই শুধু যায়। নইলে, জ্ঞানের অভিমানে ব্রহ্ম করে নিয়ে যারা ভাবতে চায়, তারা শুধু নিজেকে ঠকায়। কিন্তু, আজ আর না। এ-সব কথা আর একদিন হবে। উপেন্দ্রর মুখপানে চাহিয়া হাসিমুখে কহিল, কিন্তু, তুমি ঠাকুরপো, ভারী সেয়ানা। আমরা যখন ঝোঁকের উপর তর্কাতর্কি করে নিজেদের ফাঁকা করে ফেললুম, তুমি তখন মুখ বুজে নিজেকে একেবারে গোপন করে রাখলে। আমি জানি, তুমি সমস্ত জানো, কিন্তু নিজের মনের একটি কথাও কাউকে জানতে দিলে না।

উপেন্দ্র হাসিয়া ফেলিল। কহিল, না বৌঠান, আমি এ সম্বন্ধে একেবারে মহামূর্খ। আমি স্তম্ভিত হয়ে শুধু আপনার কথাই শুনছিলুম।

কিরণময়ীও হাসিয়া বলিল, বিদ্রূপ করচ বুঝি ঠাকুরপো!

না বৌঠান, সত্যি কথাই বলচি। কিন্তু ভাবচি, আপনার এইটুকু বয়সের মধ্যে এত পড়লেন বা কবে, এত ভাবলেন বা কবে?

প্রশংসা শুনিয়া কিরণময়ীর অন্তঃকরণ পুলকে, গর্বে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কিন্তু তাহা দমন করিয়া বিনয়ের সহিত কহিল, না না, ও-কথা বলো না ঠাকুরপো, আমিও মহামূর্খ। কিছুই জানিনে। তবে শুধু এইটুকু জেনেছি বটে যে, কিছুই জানবার জো নাই। তাই, এই-সমস্ত শাস্ত্রের জবরদস্তি আর দাম্ভিক উক্তি দেখলেই আমার গা-জ্বালা করে ওঠে—কিছুতেই যেন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। কেবলই মনে হয়, তুমিও জান না, আমিও জানিনে। তবে বাপু, তোমার এত গায়ের জোর, এত বিধি-নিষেধের ঘটা, এত মিথ্যে নিয়ে ভরতি করা কেন? সমস্ত কাজেই যে ভগবান তাঁদের মধ্যস্থ রেখে কাজ করেছেন, এমনি দাম্ভিক অনুশাসনের বহর? খেতে, শুতে, বসতে ভগবানের দোহাই, আর ধর্মের দাঁত-খিচুনি! কেন বাপু? কেন এমন করে হাঁচব, আর তেমন করে কাসব? অথচ, এত তেজ যে, কোথাও এতটুকু কারণ পর্যন্ত কেউ দেখাবার দরকার মনে করেন নি। শুধু জবরদস্তি। তোমরা গো-হত্যার ব্রহ্ম-হত্যার পাতক হবে, তুমি উচ্ছন্ন যাবে, তোমার চৌদ্দপুরুষ নরকে যাবে? কেন যাবে? কে তোমাকে বলেচে? শ্রুতি, স্মৃতি, তন্ত্র, পুরাণ, সমস্তই এই গায়ের জোর আর চোখ-রাঙ্গানি। বাস্তবিক, এত অন্যায় জোর সহ্য হয় না ঠাকুরপো।

উপেন্দ্র কথা কহিল না। কিন্তু দিবাকর তাহার শেষ চেষ্টা করিয়া বলিল, কিন্তু সে জোর হয়ত আমাদের মঙ্গলের জন্যই তাঁরা করেচেন।

কিরণময়ী জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, অত ভালয় কাজ নেই ঠাকুরপো! যেন তাঁরাই শুধু মানুষ হয়ে দেশসুদ্ধ গরুর পাল লাঠির গুঁতো দিয়ে ভাল পথে তাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্যেই অবতীর্ণ হয়েছেন। নিজের ভাল কে চায় না? বুঝিয়ে বললেই ত হয়, বাপু, এইজন্যে তোমার ভাল—তাই, এই-সব বিধি-নিষেধ তৈরী করে দিলুম। আমাকেও ত বুঝতে দেওয়া চাই কেন এই পথে আমার মঙ্গল। তাতে ত এত চোখ-রাঙ্গানি, এত মিথ্যে উপন্যাস রচনা করবার আবশ্যক হত না। বলিতে বলিতে তাহার ভিতরের ক্রোধটা অতি স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

উপেন্দ্রর অকস্মাৎ সেই প্রথম রাত্রির কথা মনে পড়িয়া গেল। এ সেই মূর্তি! পিঞ্জরাবদ্ধ বন্যপশুর সেই মর্মান্তিক গর্জন। কিন্তু, কি চায় এ? কিসের বিরুদ্ধে ইহার এত আক্রোশ? শাস্ত্র এবং শাস্ত্রকারের কোন্‌ অনুশাসনের শৃঙ্খল চূর্ণ করিয়া এই বিধবা মুক্তি প্রার্থনা করে?

তাহাকে শান্ত করিবার অভিপ্রায়ে উপেন্দ্র সবিনয় হাস্যের সহিত কহিল, আমরা দুজনে ত জবার দিতে পারিলাম না বৌঠান; কিন্তু একজন আছে—যার কাছে আপনাকেও তর্কে হেরে আসতে হবে, তা বলে দিচ্চি।

কিরণময়ী নিজের উত্তেজনা নিজেই উপলব্ধি করিয়া অবশেষে মনে মনে লজ্জা পাইয়াছিল। সেও হাসিয়া কহিল, এমন কে বল ত ঠাকুরপো?

উপেন্দ্র গম্ভীর হইয়া কহিল, আপনি তামাশা মনে করবেন না। সত্যিই বলচি, সেখানে তাকে জিতে আসা ভারী কঠিন। তার পড়াশুনা যে বেশী আছে তা নয়, কিন্তু তর্কের বুদ্ধি অতি সূক্ষ্ম। সেও এ-সমস্ত বিশ্বাস করে—তাকে নিরুত্তর করে দিয়ে আসতে পারেন, তবে ত বুঝি।

0 Shares