চরিত্রহীন

সরোজিনী অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, কিসে! যদি বলি পিপাসা মিটল তাঁর সেই ভৃঙ্গারের জলে! তিনি দুর্যোধনের সেই ভৃঙ্গারের জলই খেয়েছিলেন।

এবার সুরবালা ভয়ানক উত্তেজিত ও রুষ্ট হইয়া কহিল, তবে লেখা আছে কেন খাননি? আর তাই যদি তিনি ভৃঙ্গারের জলই খাবেন, তা হলে অর্জুনের অত কষ্ট করে বাণ দিয়ে পৃথিবী বিদীর্ণ করে গঙ্গা আনবার কি দরকার হয়েছিল! তা বল? দিদি, তুমিই বল, এ ত আর কিছুতেই মিথ্যে হতে পারে না? বলিয়া সে ক্রুদ্ধ অথচ করুণ দুই চক্ষুর দ্বারা কিরণময়ীকে আবেদন জানাইল। মুহূর্তমধ্যে উপেন্দ্রর উচ্চহাস্যে ঘর ভরিয়া গেল।

সরোজিনীও খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

উপেন্দ্র কহিল, নিন বৌঠান, জবাব দিন। গঙ্গা যদি না এলেন, তবে পিপাসা মিটল কিসে? আর পিপাসা যখন মিটল তখন গঙ্গা আসবেন না কেন? বলিয়া আর একবার উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল।

কিন্তু আশ্চর্য! কিরণময়ী এই হাসিতে যোগ দিতে পারিল না। সে বিস্ময়স্তব্ধ-নেত্রে ক্ষণকাল সুরবালার মুখপানে চাহিয়া স্থির হইয়া রহিল। তারপর অকস্মাৎ বিপুল আবেগে তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইয়া চুপি চুপি কহিল, মিথ্যে নয় বোন, কোথাও এর মধ্যে এতটুকু মিথ্যে নেই। গঙ্গা এসেছিলেন বৈ কি! তুমি যা বুঝেছ, যা পড়েচ, সব সত্যি। সত্যি ত সবাই চিনতে পারে না দিদি, তাই ঠাট্টা-তামাশা করে। বলিতে বলিতেই তাহার দুই চক্ষু অশ্রুজলে প্লাবিত হইয়া গেল।

সরোজিনী এবং উপেন্দ্র উভয়েই বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিল। কিরণময়ী সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র করিল না। তাহাকে তেমনি বুকে চাপিয়া রাখিয়া চোখ মুছিয়া ধীরে ধীরে কহিল, বোন, যারা অনেক ধর্মগ্রন্থ পড়েছে, তারা জানে, আজ তুমি যেমন করে বিচার করে দিলে, এর চেয়ে বেশী বিচার কোন ধর্মগ্রন্থে, কোন পণ্ডিত কোনদিন করতে পারেন নি—তাঁদের সবাইকে এমনি করেই নিজেদের মনের কথা বলতে হয়েছে। এ কথা যে জানে, তার সাধ্য নেই আজ তোমার মুখের কথা কয়টি শুনে হাসে। বলিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া সরোজিনীর দিকে ফিরিয়া চাহিয়া কহিল, তুমি বোধ করি, ভাই, আমার কাণ্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছ। হবারই কথা। বলিয়া একটুখানি হাসিল।

কিন্তু সর্বাপেক্ষা অধিক হতবুদ্ধি হইয়াছিল উপেন্দ্র নিজে। বস্তুতঃ, কিরণময়ীর এই অদ্ভুত ভাব-পরিবর্তনের হেতু সে একেবারেই বুঝিতে পারে নাই। যে, মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বেই স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছে, বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা ভিন্ন অন্য কোন প্রকার তুলাদণ্ডই সে গ্রাহ্য করে না, এবং যে-বস্তু ইহার বাহিরে, তাহাকে ভিতরে প্রবেশ করাইবারও কিছুমাত্র প্রয়োজন অনুভব করে না, সে সুরবালার এই একান্ত সরল ও ছেলেমানুষিতে বিচলিত হইল কি প্রকারে! তাহাকে বুকে টানিয়া লইয়া যে কথাগুলি এইমাত্র কহিল, সে ত মনরাখা কথা নয়! তা ছাড়া সে নিশ্চয় জানিত, যাহা বলিয়াছে, তাহার যথার্থ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করা সুরবালার সাধ্য নয়। সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর তাহার আকস্মিক উদ্গত অশ্রু। সে আসিল কি প্রকারে! এতদ্ব্যতীত আর একটা কথা। উপেন্দ্র নিঃসংশয়ে জানিত, এই প্রকার তীক্ষ্ণবুদ্ধি নর-নারী আবেগ প্রকাশ করিতে কিছুতেই চাহে না। কোনমতে প্রকাশ পাইলেও তাহাদের লজ্জার পরিসীমা থাকে না। কিন্তু, লেশমাত্র লজ্জাও সে যে নিজের ব্যবহারে অনুভব করিয়াছে, সে লক্ষণ ত সম্পূর্ণ অপরিচিতা সরোজিনীর কাছেও ধরা পড়িল না।

সন্ধ্যা হইয়া গেল। কিরণময়ী সকলের কাছে বিদায় গ্রহণ করিয়া ধীরে ধীরে গাড়িতে আসিয়া উপবেশন করিল।

দিবাকর বাড়ি ছিল না; সান্ধ্যভ্রমণে বাহির হইয়াছিল। সুতরাং ইতস্ততঃ করিয়াও উপেন্দ্রকে একাই ভিতরে গিয়া বসিতে হইল। কিন্তু কিরণময়ী আর তাহাকে যেন লক্ষ্যই করিল না। গাড়ির একটা কোণে মাথা রাখিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

কিছুক্ষণ কাটিয়া গেল। অমন চুপচাপ বসিয়া থাকাও অপ্রীতিকর। তা ছাড়া উপেন্দ্র নিশ্চয় বুঝিতেছিল কিরণময়ী কিছু ভাবিতেছে। কিন্তু কি ভাবিতেছে, তাহাই যাচাই করিবার জন্য কহিল, দেখে এলেন ত! এই বুদ্ধিমতীটিকে নিয়ে আমাকে ঘর করতে হয়। কিন্তু, এমনিই ত তাঁকে আঁটবার জো নেই, তাতে আপনি আজ তামাশা করে যে সার্টিফিকেট দিয়ে এলেন, এবার আর তার নাগাল পাওয়াই যাবে না।

কিরণময়ী ইহার কোন উত্তর করিল না। একটুখানি অপেক্ষা করিয়া উপেন্দ্র হাসিয়া কহিল, কিন্তু এইখানেই এর শেষ নয় বৌঠান। ও এত বড় বোকা যে জন্মাবধি কখনো মিথ্যা কথা বলতে পারে না।

কিরণময়ী তেমনি নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

উপেন্দ্র বলিল, কেন জানেন? একে ত তেত্রিশ কোটি দেব-দেবতা তাকে চতুর্দিকে ঘিরে দিবা-রাত্রি পাহারা দিয়ে আছে,—তা ছাড়া, যা ঘটেনি, সেইটুকু সে নিজের বুদ্ধি খরচ করে বানিয়ে বলবে সে ক্ষমতাই ওর নেই।

কিরণময়ী রুদ্ধকণ্ঠে সংক্ষেপে কহিল, ভালই ত।

উপেন্দ্র কহিল, অতটাই যে ভাল, তা আমার মনে হয় না বৌঠান। সংসার করতে গেলে একটু-আধটু মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হয়। যাতে কারো কোন ক্ষতি নেই, অথচ একটা অশান্তি, একটা উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যায়, তাতে দোষ কি? আমি ত বলি বরং ভালই।

0 Shares