চরিত্রহীন

এ হাসি উপেন্দ্র চোখে না দেখিলেও অন্তরে অনুভব করিল। কহিল, হয়ত ভাল মনে করে না।

তবে?

কি করব বৌঠান, কোন কথাই যেন খুঁজে পাচ্চিনে।

কিরণময়ী সহাস্যে কহিল, পাচ্চ না? আচ্ছা, আমি খুঁজে বার করে দিচ্চি। কিন্তু মাঝখানে একটা খবর দিয়ে রাখি যে, আমার খাবার তৈরী থেকে তোমাকে খাইয়ে বিদায় করা পর্যন্ত আধ-ঘণ্টার বেশী লাগবে না। এই সময়টুকুর জন্যে তুমি একটুখানি প্রসন্নমুখে কথা কও, অমন মনভারী করে বসে থেকো না।

উপেন্দ্র জোর করিয়া হাসিয়া কহিল, বেশ বলুন।

কিরণময়ী আবার মুখ টিপিয়া হাসিল। কহিল, তবু ভাল, বৌঠানের মান রেখে একটু হেসেচ। তোমাকে দেখে পর্যন্ত একটা কথা আমার প্রায় মনে হয় ঠাকুরপো। কিন্তু শুনে আবার উলটো বুঝে রাগ করে বসবে না ত?

না, রাগ কিসের?

কি জানো ঠাকুরপো, ভাল ভাল কাব্যে পড়া যায় ত, তা আমাদের দেশেরই বল, আর বিদেশেরই বল, প্রথম চোখের দেখাতেই একটা প্রগাঢ় ভালবাসা—আচ্ছা, এ কি সম্ভব বলে মনে কর?

উপেন্দ্রর মুখ চক্ষের পলকে লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল। কহিল, ভাল-মন্দ কোন কাব্য সম্বন্ধেই আমার বিশেষ কোন জ্ঞান নেই বৌঠাকরুন, এ-সব আমি জানিনে।

কিরণময়ী বলিল, সে কি কথা ঠাকুরপো? এত লেখাপড়া শিখেচ, এতগুলো পাস করে কত টাকার জলপানি আদায় করেচ, আর কাব্য সম্বন্ধে কিছুই জান না? শকুন্তলা, রোমিও-জুলিয়েট এ দুটোও কি তোমাকে পড়তে হয়নি?

উপেন্দ্র কহিল, কিন্তু পড়ে পাস করতে ত সম্ভব-অসম্ভব স্থির করতে হয়নি। বইয়ে যা লেখা আছে মুখস্থ করে লিখে দিয়ে এসেছিলুম। আপনার মত কোন পরীক্ষক কখনো প্রশ্ন করেন নি—তা হয় কি না। আমাকে মাপ করতে হবে বৌঠান, এ-সব আলোচনা আপনার সঙ্গে আমি করতে পারব না।

কিরণময়ী বিষণ্ণ হইয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তাই জিজ্ঞাসা করেছিলুম, শুনে রাগ করবে না ত?

কিন্তু রাগ ত করিনি।

না করলেই ভাল, বলিয়া কিরণময়ী জ্বলন্ত উনানের উপর ঘিয়ের কড়া চাপাইয়া দিল।

খান তিন-চার লুচি নীরবে ভাজিয়া তুলিয়া কিরণময়ী সহসা বলিল, যে কথা আমি জানতে চেয়েছিলুম, সে আলোচনাই তুমি করতে চাইলে না। আমার কপাল! কিন্তু আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি ঠাকুরপো, প্রণয়কে লোক অন্ধ বলে কেন?

উপেন্দ্র কহিল, বোধ করি চোখ থাকলে যে-পথে মানুষ যায় না—এতে তেমন পথেও তাকে নিয়ে যায়।

কিরণময়ী উৎসুক হইয়া প্রশ্ন করিল, যায় কি? কথাটি কি সত্যি, ভালবাসা অন্ধ?

সত্যি বৈ কি। অনেকের অনেক অভিজ্ঞতাই ত প্রবাদ-বচন।

কিরণময়ী কহিল, বেশ কথা। তা যদি হয়, কানা খানায় পড়লে লোকে ছুটে এসে তাকে তুলে দেয়। তার জন্যে দুঃখ করে, যার যেমন সাধ্য তার ভালর চেষ্টা করে, কিন্তু ভালবাসায় অন্ধ হয়ে সে যখন গর্তে পড়ে, কেউ ত তুলে ধরতে ছুটে আসে না। বরং আরও তার হাত-পা ভেঙ্গে দিয়ে সেই গর্তেই মাটি চাপা দিয়ে চায়। যে-সত্য মানুষ নিজেই প্রচার করে, প্রয়োজনের সময় সে সত্যের কোন মর্যাদাই রাখে না! আমার কথাটা বুঝতে পারচো ঠাকুরপো?

উপেন্দ্র ঘাড় নাড়িয়া কহিল, পারচি বৈ কি!

কিরণময়ী কহিল, পারবে বলেই ত তোমাকে জিজ্ঞাসা করচি। কিন্তু তা হলেই দেখ, অপরের বেলায় অনেক জিনিস জেনেও জোর করে ভুলতে চায়। অন্ধকে চক্ষুষ্মানের শাস্তি দিয়ে আপনাকে বাহাদুর মনে করে। পরকে বিচার করবার সময় এ একটা তার মনেও পড়ে না যে, চোখ হারালে তার নিজেরও খানায় পড়বার সম্ভাবনা ওই লোকটার চেয়ে একটুও কম থাকে না।

উপেন্দ্র একটুখানি অপ্রসন্ন বিস্ময়ের সহিত কহিল, তা না হতে পারে, কিন্তু আমি ভেবে পাচ্চিনে বৌঠান, এ-সব আলোচনা কেন করচেন? সত্যি হোক, মিথ্যা হোক, আপনার জীবনের সঙ্গে এ মীমাংসার কোন সম্বন্ধ নেই।

কিরণময়ী উপেন্দ্রর অপ্রসন্নতা লক্ষ্য করিয়াও হাসিল, কহিল, অন্ধ আলোচনা করে খানায় পড়ে না ঠাকুরপো, পড়ে আলোচনা করে। আমি যে পড়িনি কিংবা পড়বার জন্যে সেদিকে এগিয়ে যাচ্চিনে, সেই বা কি করে জানলে?

উপেন্দ্র কহিল, কিন্তু আপনি ত অন্ধ নন। আমি যে আপনার বড় বড় দুটো চোখ দেখতে পেয়েছি বৌঠান।

কিরণময়ী বলিল, ঐখানেই ত মুশকিল ঠাকুরপো, দু’রকমের অন্ধ আছে কিনা! যারা চোখ বুজে চলে, তাদের সম্বন্ধে ত ভাবতে হয় না—তাদের চেনা যায়। কিন্তু, যারা দু’চোখ চেয়ে চলে, দেখতে পায় না, তাদের নিয়েই যত গোল। তারা নিজেরাও ঠকে, পরকেও ঠকাতে ছাড়ে না।

উপেন্দ্র কুণ্ঠিত হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার কাছে উত্তর না পাইয়া কিরণময়ী সহসা অত্যন্ত উৎসুক হইয়াই যেন প্রশ্ন করিল, আচ্ছা, আমার যে বড় বড় দুটো চোখ দেখেছিলে বললে ঠাকুরপো, সে কবে, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

উপেন্দ্র বলিল, সে আপনার স্বামীর মৃত্যুর পরেই। সেদিন আপনাকে যে দেখেচে তার কোনদিন আপনাকে ভুল হবে না। কেন যে আপনি নিজেকে অন্ধ বলে ভয় করচেন, সে আপনি জানেন, কিন্তু আমি জানি এ কথা সত্য নয়। সেদিন আপনার দুটি চোখে যে জ্যোতি আমি দেখতে পেয়েছিলাম, তাতে নিশ্চয় জানি যত অন্ধকারই আপনার চারিপাশে ঘনিয়ে আসুক, আপনাকে ভুলোতে পারবে না। আপনি ঠিক পথটি দেখে চিরজীবন চলে যেতে পারবেন।

0 Shares