চরিত্রহীন

তাহার মুখ দেখিয়া কিরণময়ী বিষাদের ভান করিয়া বলিল, আমি মূর্খ মেয়েমানুষ ঠাকুরপো, এ-সব বড় বড় কথার কি জানি বল ত, যে রাগ করচ?

দিবাকর আর একদিনের কথা স্মরণ করিল। যেদিন বেদকেও তাচ্ছিল্যের সহিত উল্লেখ করিতে শুনিয়া সে কানে আঙ্গুল দিয়াছিল। বলিল, আমি জানি বৌদি, তুমি ভয়ানক পণ্ডিত। তুমি ইচ্ছে করলে সব বিষয় আমাকে বুঝিয়ে দিতে পার।

কিরণময়ী বলিল, পারি? আচ্ছা, তবে যদি বলি রমণীর রূপ একটা ভ্রম মাত্র। আসলে এটা কিছুই নয়—মরীচিকার মত মিথ্যা। বিশ্বাস করবে?

দিবাকর কহিল, না। তার কারণ, মরীচিকাও মিথ্যা নয়—সে যা তাই। আয়নাতে মানুষের ছায়া পড়ে। সেটা ছায়া, মানুষ নয়, এ ত জানা কথা। ছায়াকে মানুষ বলে ধরতে গেলেই ভুল করা হয়। কিন্তু রূপ ত সেরকম কোন জিনিসের ছায়া নয়। সাপকে দড়ি বলে ধরতে যাওয়া ভুল, মরীচিকাকেও জল বলে ছুটে ধরতে যাওয়া ভুল, কিন্তু রূপের পিছনে মানুষ যে নিছক রূপের তৃষ্ণাতেই ছুটে যায় বৌদি।

কিরণময়ী বলিল, ঠাকুরপো, এইমাত্র আরসিতে ছায়া দেখার একটা উপমা দিয়েছিলে। যেদিন বুঝবে রূপটাও মানুষের ছায়া, মানুষ নয়—সেইদিনই শুধু ভালবাসার সন্ধান পাবে। কিন্তু সে যাক। জিজ্ঞেসা করি, রূপের পিছনেই বা মানুষ ছুটে যায় কেন?

তা জানিনে। ভ্রমরকে ছেড়েও গোবিন্দলাল রোহিণীর পিছনে ছুটে গিয়েছিল, এইটে আমার কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত ঠেকে।

কিন্তু তার ফল কি দাঁড়াল?

ফল যাই দাঁড়াক বৌদি, সে বিচারের ভার মানুষের হাতে নয়। রোহিণীর রূপ ছিল, গুণ ছিল না। কিন্তু রূপের সঙ্গে গুণ থাকলে গোবিন্দলালের কি হতো বলা যায় না।

কিরণময়ী চুপ করিয়া রহিল। এই বি. এ. ফেল করা ছেলেটির উপর মনে মনে তাহার শ্রদ্ধা ছিল না। শুধু ফেল করার জন্য নয়, পাস করিলেও সে মনে করিত ইহারা শুধু পড়া মুখস্থ করিয়া পাস করিতেই পারেস আর কিছু পারে না। কিন্তু প্রয়োজন হইলে ইহাদের শিক্ষিত মন যে তর্ক করিতেও সক্ষম, এ ধারণাই তাহার ছিল না। কহিল, রূপ যে ছায়া নয়, এ কথা অত নিঃসংশয়ে স্থির করে রেখো না। যাই হোক, জিজ্ঞেসা করি ঠাকুরপো, এ-সমস্ত কি তুমি নিজেই ভেবেচ, না কারো ভাবা কথা শুনে বলচ?

দিবাকর মৃদু হাসিয়া বলিল, না বৌদি, এ আমার নিজেরই কথা। ছেলেবেলা থেকে ভগবান আমাকে অনেক কথাই ভাববার সুবিধে দিয়েছিলেন।

কিরণময়ী মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া কহিল, অথচ এত সুবিধাতেও রূপের তত্ত্ব খুঁজে পেলে না। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সতীশ-ঠাকুরপোও একদিন আমাকে ঠিক এই কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আরও একজন করেছিলেন, আর আজ তুমিও করচ। আমি ভাবচি, আমার রূপ দেখেই কি তোমাদের এই প্রশ্ন মনে আসে?

হঠাৎ দিবাকর চমকিয়া উঠিল। লজ্জায় তাহার মাথা কাটা যাইতে লাগিল, সে মুখ নীচু করিয়া বলিল, আমাকে মাপ কর বৌদি, আমি জানতাম না।

কিরণময়ী হাসিমুখে বলিল, এক-আধবার নয় ভাই, তোমাকে এক শ’বার মাপ করলুম; বলিয়া ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া সে যেন নিজের মনেরই একটা আগন্তুক দ্বিধাকে সবলে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল; এবং অতুল সুন্দর গ্রীবা ঈষৎ উন্নত করিয়া কেমন যেন একটা মৃদু করুণ-সুরে বলিতে লাগিল, ঠাকুরপো, আজ যত কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করেচ, তার সত্য উত্তর যদি দিতে যাই, কথাগুলো আমার দম্ভের মত শোনাবে। সেইটা তোমাকে ভুলতে হবে। নইলে নিজের ভুলে আমাকে ভুল বুঝে সমস্তই গোলমাল করে ফেলবে। আমার কথাটা বুঝতে পারচ ঠাকুরপো?

দিবাকর নীরবে ঘাড় নাড়িল।

কিরণময়ী একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিতে লাগিল, আমার দেহের এই রূপটা শুধু তোমাদের পুরুষের চোখে নয়, আমার নিজের চোখেও একটা অদ্ভুত জিনিস। তাই এর কথা আমি অনেক ভেবেচি। যা ভেবেচি, হয়ত তাই ঠিক, হয়ত না। কিন্তু সে যাই হোক, আমার এ ভাবনা আর একটি দেওরকে বলতে যখন লজ্জা করিনি, তখন তোমাকে বলতেও পেছুব না। আমার নিজেকে দেখে কি মনে হয় জান? মনে হয় সন্তান-ধারণের জন্য যে-সমস্ত লক্ষণ সবচেয়ে উপযোগী তাই নারীর রূপ। সমস্ত জগতের সাহিত্যে, কাব্যে এই বর্ণনাই তার রূপের বর্ণনা।

দিবাকর নিস্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। কিরণময়ী তাহার স্তব্ধ মুখের উপর নবীন যৌবনের একটা সদ্যজাগ্রত ক্ষুধার মূর্তি অকস্মাৎ অনুভব করিয়া সসঙ্কোচে থামিয়া গেল। কিন্তু মুহূর্তের জন্য, পরক্ষণেই তাহাকে স্পর্ধার সহিত অতিক্রম করিয়া বলিল, বাস্তবিক ঠাকুরপো, এইখানে রূপের যেন একটা কূল পাওয়া যায়। এই জন্যই নারীর বাল্যরূপ যদি বা মানুষকে আকৃষ্ট করে তাকে মাতাল করে না। আবার যেদিন সে সন্তান-ধারণের বয়স পার হয়ে যায়, তখনও ঠিক তাই। ভেবে দেখ ঠাকুরপো, শুধু নারী নয়, পুরুষেরও এই দশা। ততক্ষণই তার রূপ, যতক্ষণ সে সৃষ্টি করতে পারে। এই সৃষ্টি করবার ক্ষমতাই তার রূপ-যৌবন, এই সৃষ্টি করবার ইচ্ছাই তার প্রেম।

দিবাকর ধীরে ধীরে বলিল, কিন্তু—

কিরণময়ী বাধা দিয়া বলিয়া উঠিল, না, কিন্তুর জায়গা এর মধ্যে নেই। বিশ্ব চরাচরের যেদিকে খুশী চেয়ে দেখ, ওই এক কথা ঠাকুরপো, সৃষ্টিতত্ত্বের মূলকথা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার জন্যই থাক, কিন্তু এর কাজের দিকে একবার চেয়ে দেখ। দেখতে পাবে, এর প্রতি অণু-পরমাণু নিরন্তর আপনাকে নতুন করে সৃষ্টি করতে চায়। কেমন করে সে নিজেকে বিকাশ করবে, কোথায় গেলে, কার সঙ্গে মিশলে, কি করলে সে আরও সবল আরও উন্নত হবে, এই তার অক্লান্ত উদ্যম। দৃশ্যে-অদৃশ্যে, অন্তরে-বাহিরে প্রকৃতির তাই এই নিত্য পরিবর্তন, এবং এই জন্যই নারীর মধ্যে পুরুষ যখন এমন কিছু দেখতে পায়—জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, যেখানে সে আপনাকে আরও সুন্দর আরও সার্থক করে তুলতে পারবে, সে লোভ সে কোনমতেই থামাতে পারে না।

0 Shares