দত্তা

বিজয়া হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার নেওয়া হয়ে গেছে বোধ হয়? কিন্তু দেখে ত তা মনে হয় না।

লোকটি বলিল, ডাক্তারদের একটু সবুর করে নিতে হয়। অমন তাড়াতাড়ি—

কথাটা শেষ না হইতেই বিজয়া প্রশ্ন করিল, আপনি ডাক্তার নাকি?

লোকটি অপ্রতিভ হইয়া সহসা উত্তর দিতে পারিল না। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলাইয়া লইয়া পরিহাসের ভঙ্গীতে কহিল, তা বৈ কি! একজন কতবড় ডাক্তারের প্রতিবেশী আমরা! সবাইকে দিয়ে-থুয়ে তবে ত আমাদের—কি বলেন?

বিজয়া তৎক্ষণাৎ কোন কথাই বলিল না; ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া পরে কহিল, শুধু প্রতিবেশী নয়, তিনি যে আপনার একজন বন্ধু, সে আমি অনুমান করেছিলুম। আমার কথা তাঁকে গল্প করেছেন নাকি?

লোকটা হাসিয়া কহিল, আপনি তাকে একটা অপদার্থ হতভাগা মনে করেন, এ ত পুরোনো গল্প—সবাই করে। এ আর নূতন করে বলবার দরকার কি? তবে একদিন হয়ত সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবে।

বিজয়া মনে মনে অতিশয় লজ্জিত হইয়া কহিল, আমার সঙ্গে দেখা করায় তাঁর লাভ কি? কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে ত আমি এ রকম কথা আপনাকে বলিনি।

না বলে থাকলেও বলাই ত উচিত ছিল।

উচিত ছিল কেন?

যার বাড়ি-ঘরদোর বিকিয়ে যায়, তাকে সবাই হতভাগ্য বলে। আমরাও বলি। সুমুখে না পারি, আড়ালেও ত আমরা বলতে পারি।

বিজয়া হাসিতে লাগিল, কহিল, আপনি ত তাঁর খুব ভাল বন্ধু!

লোকটি ঘাড় নাড়িয়া বলিল, সে ঠিক। এমন কি, তার হয়ে আমি নিজেই আপনাকে ধরতুম, যদি না জানতুম, আপনি সদুদ্দেশ্যেই তার বাড়িখানি গ্রহণ করচেন।

বিজয়া একটিবার মাত্র মুখ তুলিয়া চাহিল, কিন্তু এ সম্বন্ধে কোন কথা কহিল না।

কথায় কথায় আজ তাহারা আরও একটু অধিক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া গিয়াছিল। দেখা গেল, ও-পারে একদল লোক সার বাঁধিয়া নরেন্দ্রবাবুর বাটীর দিকে চলিয়াছে। তাহার মধ্যে পঞ্চাশ হইতে পনর পর্যন্ত সকল বয়সের লোকই ছিল। লোকটি দেখাইয়া কহিল, ওরা কোথায় যাচ্ছে জানেন? নরেনবাবুর ইস্কুলে পড়তে।

বিজয়া আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তিনি এ ব্যবসাও করেন নাকি? কিন্তু যতদূর বুঝতে পারছি, বিনা পয়সায়—ঠিক না?

লোকটি হাসিমুখে কহিল, তাকে ঠিক চিনেচেন। অপদার্থ লোকের কোথাও আত্মগোপন করা চলে না। পরে অপেক্ষাকৃত গম্ভীর হইয়া কহিল, নরেন বলে, আমাদের দেশে সত্যিকার চাষী নেই। চাষ করা পৈতৃক পেশা; তাই সময়ে-অসময়ে জমিতে দু’বার লাঙ্গল দিয়ে, বীজ ছড়িয়ে আকাশের পানে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকে। একে চাষ করা বলে না, লটারির খেলা বলে! কোন্‌ জমিতে কখন সার দিতে হয়, কাকে সার বলে, কাকে সত্যিকার চাষ করা বলে—এ-সব জানেই না। বিলাত থাকতে ডাক্তারি পড়ার সঙ্গে এ বিদ্যেটাও সে শিখে এসেছিল। ভাল কথা, একদিন যাবেন তার ইস্কুল দেখতে? মাঠের মাঝখানে গাছের তলায় বাপ-ব্যাটা-ঠাকুদ্দায় মিলে যেখানে পাঠশালা বসে, সেখানে?

যাইবার জন্য বিজয়া তৎক্ষণাৎ উদ্যত হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণেই কৌতূহল দমন করিয়া শুধু কহিল, না থাক । জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, অতবড় বাড়ি থাকতে তিনি গাছতলায় পাঠশালা বসান কেন?

লোকটি বলিল, এ-সব শিক্ষা ত শুধু কেবল মুখের কথায় বই মুখস্থ করিয়ে দেওয়া যায় না! তাদের হাতেনাতে চাষ করিয়ে দেখাতে হয় যে, এ জিনিসটা রীতিমত শিখে করলে দু-গুণো, এমন কি চার-পাঁচ-গুণো ফসলও পাওয়া যায়। তার জন্যে মাঠ দরকার, চাষ করা দরকার। কপাল ঠুকে মেঘের পানে চেয়ে হাত পেতে বসে থাকা দরকার নয়। এখন বুঝলেন, কেন তার পাঠশালা গাছতলায় বসে?

একবার যদি তার ইস্কুলের মাঠের ফসল দেখেন, আপনার চোখ জুড়িয়ে যাবে, তা নিশ্চয়ই বলতে পারি। এখনো ত বেলা আছে—আজই চলুন না—ঐ ত দেখা যাচ্চে।

বিজয়ার মুখের ভাব ক্রমশঃ গম্ভীর এবং কঠিন হইয়া আসিতেছিল; কহিল, না, আজ থাক।

লোকটি সহজেই বলিল, তবে থাক। চলুন, খানিকটা আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি— বলিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল। মিনিট পাঁচ-ছয় বিজয়া একটা কথাও কহিল না, ভিতরে ভিতরে কেমন যেন তাহার লজ্জা করিতে লাগিল—অথচ লজ্জার হেতুও সে ভাবিয়া পাইল না। লোকটি পুনরায় কথা কহিল, বলিল, আপনি ধর্মের জন্যই যখন তার বাড়িটা নিচ্চেন—এই ক’ বিঘে জমি যখন ভাল কাজেই লাগছে, তখন এটা ত আপনি অনায়াসেই ছেড়ে দিতে পারেন? বলিয়া সে মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।

কিন্তু প্রত্যুত্তরে বিজয়া গম্ভীর হইয়া কহিল, এই অনুরোধ করবার জন্যে তাঁর তরফ থেকে আপনার কোন অধিকার আছে? বলিয়া আড়চোখে চাহিয়া দেখিল, লোকটির হাসিমুখের কোন ব্যতিক্রম ঘটিল না।

সে বলিল, এ অধিকার দেবার ওপর নির্ভর করে না, নেবার ওপর নির্ভর করে। যা ভাল কাজ, তার অধিকার মানুষ সঙ্গে সঙ্গেই ভগবানের কাছে পায়—মানুষের কাছে হাত পেতে নিতে হয় না। যে অনুগ্রহ প্রার্থনা করার জন্যে আপনি মনে মনে বিরক্ত হলেন, পেলে কারা পেতো জানেন? দেশের নিরন্ন কৃষকেরা। আমাদের শাস্ত্রে আছে, দরিদ্র ভগবানের একটা বিশেষ মূর্তি। তাঁর সেবার অধিকার ত সকলেরই আছে। সে অধিকার নরেনের কাছে চাইতে যাব কেন বলুন? বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

বিজয়া চলিতে চলিতে বলিল, কিন্তু আপনার বন্ধু ত শুধু এই জন্যেই এখানে বসে থাকতে পারবেন না?

লোকটি কহিল, না। কিন্তু তিনি হয়ত আমার ওপরে এ ভার দিয়ে যেতে পারেন।

বিজয়ার ওষ্ঠাধরে একটা চাপা হাসি খেলা করিয়া গেল; কিন্তু অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বলিল, সে আমি অনুমান করেছিলুম।

লোকটি বলিল, করবারই কথা কিনা। এ সকল কাজ আগে ছিল দেশের ভূস্বামীর। তাদের ব্রহ্মোত্তর দিতে হত। এখন সে দায় নেই বটে, কিন্তু তার জের মেটেনি। তাই দু-চার বিঘে কেউ ঠকিয়ে নেবার চেষ্টা করলেই তারা পূর্ব-সংস্কারবশে টের পান। বলিয়া সে আবার হাসিতে লাগিল।

বিজয়া নিজেও এ হাসিতে যোগ দিতে গেল, কিন্তু পারিল না। এই সরল পরিহাস তাহার অন্তরের কোথায় গিয়া যেন বিঁধিয়া রহিল। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চলিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, আপনি নিজেও ত আপনার বন্ধুকে আশ্রয় দিতে পারেন?

কিন্তু আমি ত এখানে থাকিনে। বোধ হয়, এক সপ্তাহ পরেই চলে যাবো।

বিজয়া অন্তরের মধ্যে যেন চমকাইয়া উঠিল; কহিল, কিন্তু বাড়ি যখন এখানে তখন নিশ্চয়ই ঘন ঘন যাতায়াত করতে হয়।

লোকটি মাথা নাড়িয়া বলিল, না, আর বোধ হয় আমাকে আসতে হবে না।

বিজয়ার বুকের মধ্যে তোলপাড় করিতে লাগিল। সে মনে মনে বুঝিল, এ সম্বন্ধে অযথা প্রশ্ন করা আর কোনমতেই উচিত হইবে না; কিন্তু কিছুতেই কৌতূহল দমন করিতে পারিল না। ধীরে ধীরে কহিল, এখানে বাড়ির লোকের ভার নেবার লোক আপনার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু—

0 Shares