দত্তা

আপনার সম্বন্ধে যে সামাজিক গোলযোগ আছে, তা কি সে গ্রামের লোকেরা জানে না?

জানে বৈ কি?

তবে?

নরেন্দ্র একটুখানি ভাবিয়া বলিল, যে ঘরটায় আছি, সেটাকে ঠিক বাড়ির মধ্যে বলা যায় না, আর আমার অবস্থা শুনেও বোধ করি, সামান্য কিছুদিনের জন্যে তাঁর ছেলেরা আপত্তি করে না। তবে বেশী দিন থেকে তাঁদের বিব্রত করা চলবে না, সে ঠিক। বলিয়া সে একটুখানি থামিল। কহিল, আচ্ছা, সত্যি কথা বলুন তো, কেন এসব খোঁজ নিচ্ছিলেন? বাবার আরও কিছু দেনা বেরিয়েছে, এই না?

উত্তর দিবার জন্যই বোধ করি বিজয়া তাহার মুখপানে চাহিল। কিন্তু সহসা হাঁ—না কোন কথাই তাহার গলা দিয়া বাহির হইল না।

নরেন্দ্র কহিল, পিতৃঋণ কে না শোধ দিতে চায়, কিন্তু সত্যি বলচি আপনাকে, স্বনামে-বেনামে এমন কিছু আমার নেই, যা বেচে দিতে পারি।শুধু মাইক্রস্কোপ্‌টা আছে, তাও বেচে তবে বিদেশে যাবার খরচটা যোগাড় করতে হবে। পিসিমার অবস্থাও খারাপ—এমন কি, সেখানে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত—বলিয়াই সে হঠাৎ থামিয়া গেল।

বিজয়ার চোখে জল আসিয়া পড়িল; সে ঘাড় ফিরাইল।

নরেন্দ্র বলিল, তবে যদি এই দয়াটা করেন, তা হলে বাবার দেনাটা আমি নিজের নামে লিখে নিতে পারি। ভবিষ্যতে শোধ দিতে প্রাণপণে চেষ্টা করব। আপনি রাসবিহারীবাবুকে একটু বললেই আর তিনি এ নিয়ে এখন পীড়াপীড়ি করবেন না।

পরেশ আসিয়া দ্বারের বাহির হইতে কহিল, মাঠান, মা বলচে, বেলা যে অনেক হয়ে গেল—ঠাকুরমশাইকে ভাত দিতে বলবে?

সুমুখের ঘড়িটার প্রতি চাহিয়া নরেন্দ্র চকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, লজ্জিত হইয়া বলিল, ইস্‌! বারোটা বাজে! আপনার ভারী কষ্ট হল।

বিজয়া চোখের জল সামলাইয়া লইয়াছিল; কহিল,আপনি কি জন্যে এসেছিলেন, সে ত বললেন না?

নরেন্দ্র তাড়াতাড়ি বলিল, সে থাক। বলিয়া প্রস্থানের উপক্রম করিতেই বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার পিসিমার বাড়ি এখান থেকে কত দূর? এখন সেখানেই ত যেতে হবে?

নরেন্দ্র কহিল, হ্যাঁ।দূর একটু বৈ কি—প্রায় ক্রোশ-দুই।

বিজয়া অবাক হইয়া বলিল, এই রোদের মধ্যে এখন দু’ ক্রোশ হাঁটবেন? যেতেই তো তিনটে বেজে যাবে।

তা হোক, তা হোক, নমস্কার। বলিয়া নরেন পা বাড়াইতেই বিজয়া দ্রুতপদে কবাটের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কহিল, আমার একটা অনুরোধ আপনাকে আজ রাখতেই হবে। এত বেলায় না খেয়ে আপনি কিছুতেই যেতে পারবেন না।

নরেন্দ্র অতিশয় বিস্মিত হইয়া বলিল, খেয়ে যাব? এখানে?

কেন, তাতে কি আপনারও জাত যাবে নাকি?

প্রত্যুত্তরে পুনরায় তেমনি প্রশান্ত হাসিতে তাহার মুখ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল; কহিল, না, সে ভয় আমার দুনিয়ায় আর নেই। তা ছাড়া ভগবান আমার প্রতি আজ ভারী প্রসন্ন, নইলে এত বেলায় সেখানে যে কি জুটত, সে ত আমি জানি।

তবে একটু বসুন, আমি আসচি, বলিয়া বিজয়া তাহার প্রতি না চাহিয়াই ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

একাদশ পরিচ্ছেদ

খাওয়া প্রায় শেষ হইয়া আসিলে নরেন্দ্র পুনরায় সেই কথাই বলিল, কহিল, এত বেলা পর্যন্ত উপোস করে আমাকে সুমুখে বসিয়ে খাওয়াবার কোন দরকার ছিল না। অন্য দেশে এ প্রথা নেই।

বিজয়া হাসিমুখে জবাব দিল, বাবা বলতেন, সে দেশের ভারী দুর্ভাগ্য, যে দেশের মেয়েরা অভুক্ত থেকে পুরুষদের খাওয়াতে পায় না, সঙ্গে বসে খেতে হয়। আমিও ঠিক তাই বলি।

নরেন্দ্র কহিল, কেন তা বলেন? অন্য দেশের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আমাদের দেশেও ত অনেকের বাড়িতে খেয়েছি, তাঁদের মধ্যেও ত এ প্রথা চলে দেখেছি।

বিজয়া কহিল, বিলিতি প্রথা যাঁরা শিখেছেন,তাঁদের বাড়িতে হয়ত চলে, কিন্তু সকলের নয়। আপনি নিজে সেদেশে অনেক দিন ছিলেন বলেই আপনার ভুল হচ্ছে। নইলে পু্রুষদের সামনে বার হই, দরকার হলে কথা কই বলেই আমরা সবাই মেমসাহেবও নই, তাদের চাল-চলনেও চলিনে।

নরেন্দ্র কহিল, না চললেও চলা ত উচিত। যাদের যেটা ভাল, তাদের কাছে সেটা ত নেওয়া চাই।

বিজয়া বলিল, কোন্‌টা ভাল, একসঙ্গে বসে খাওয়া? বলিয়াই একটুখানি হাসিয়া কহিল, আপনি কি জানবেন মেয়েদের কতখানি জোর এই খাওয়ানোর মধ্যে থাকে? আমি ত বরঞ্চ আমাদের অনেক অধিকার ছাড়তে রাজী আছি কিন্তু এটি নয়—ও কি, সমস্ত দুধই যে পড়ে রইল! না, না—মাথা নাড়লে হবে না। কখনই আপনার পেট ভরেনি, তা বলে দিচ্ছি।

নরেন হাসিয়া বলিল, আমার নিজের পেট ভরেছে কি না, সেও আপনি বলে দেবেন!এ ত বড় অদ্ভুত কথা। বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কথাটা শুনিয়া বিজয়া নিজেও একটু হাসিল বটে, কিন্তু তাহার মুখের ভাব দেখিয়া বুঝিতে বাকী রহিল না যে, সে ঐটুকু দুধ না খাওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ হইয়াছে।

বেলা পড়িলে বিদায় লইতে গিয়া নরেন্দ্র হঠাৎ বলিয়া উঠিল, একটা বিষয়ে আজ আমি ভারী আশ্চর্য হয়ে গেছি। আমাকে রোদের মধ্যে আপনি যেতে দিলেন না, না খাইয়ে ছেড়ে দিলেন না, একটু কম খাওয়া দেখে ক্ষুণ্ণ হলেন—এ সব কেমন করে সম্ভব? শুনে আপনি দুঃখিত হবেন না—আমি শ্লেষ বা বিদ্রূপ করার অভিপ্রায়ে এ কথা বলছি নে—কিন্তু আমি তখন থেকে কেবল ভাবছি, এ রকম কেমন করে সম্ভব হয়।

বিজয়া কোন উপায়ে এই অলোচনার হাত থেকে নিস্তার পাইবার জন্য তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিল, সব বাড়িতেই এই রকম হয়ে থাকে। সে থাক, আপনি আর কতদিনের মধ্যে বিদেশ যাবার ইচ্ছা করেন?

নরেন্দ্র অন্যমনস্কভাবে কহিল, পরশু। কিন্তু আমি ত আপনার একেবারেই পর; আমার দুঃখ-কষ্টতে সত্যই ত আপনার কিছু যায় আসে না, তবু আপনার আচরণ দেখে বাইরের কারুর বলবার জো নেই যে, আমি আপনার লোক নই। পাছে কম খাই বা খাওয়ার সামান্য ত্রুটি হয়, এই ভয়ে নিজে না খেয়ে সুমুখে বসে রইলেন। আমার বোন নেই, মা-ও ছেলেবেলায় মারা গেছেন। তাঁরা বেঁচে থাকলে এমনি ব্যাকুল হতেন কি না আমি ঠিক জানিনে; কিন্তু আপনার যত্ন করা দেখে ভারী আশ্চর্য হয়ে গেছি। অথচ এ-কিছু আর যথার্থই সত্যি হতে পারে না, সে আমিও জানি, আপনিও জানেন; বরঞ্চ একে সত্যি বললেই আপনাকে ব্যঙ্গ করা হবে—অথচ মিথ্যা বলে ভাবতেও যেন ইচ্ছে করে না।

বিজয়া জানালার বাহিরে চাহিয়াছিল; সেই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া কহিল, ভদ্রতা বলে একটা জিনিস আছে সে কি আপনি আর কোথাও দেখেন নি?

ভদ্রতা! তাই হবে বোধ হয়। বলিয়া হঠাৎ তাহার একটা নিশ্বাস পড়িল। তার পরে হাত তুলিয়া আবার একবার নমস্কার করিয়া কহিল, যেমন কোরে হোক বাবার ঋণটা যে সমস্ত শোধ হয়েছে, এই আমার ভারী তৃপ্তি। আপনার মন্দিরের দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হোক—আজকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমি চললুম। বলিয়া সে যখন ঘরের বাহিরে আসিয়া পড়িল, তখন ভিতর হইতে অস্ফুট আহ্বান আসিল, একটু দাঁড়ান—

0 Shares