দত্তা

জবাব শুনিয়া নরেনের মুখ শুকাইল। সে লজ্জায় একান্ত সঙ্কুচিত ও কুণ্ঠিত হইয়া অস্ফুটকণ্ঠে এই বলিয়া ক্ষমা চাহিতে লাগিল যে, সে কিছুই ভাবিয়া বলে নাই—তাহার অত্যন্ত অন্যায় হইয়া গিয়াছে—আর কখনো সে—ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহার অনুতাপের পরিমাণ দেখিয়া বিজয়া হাসিল। স্নিগ্ধহাস্যে মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিল, কৈ দেখি আপনার যন্ত্র।

নরেন বাঁচিয়া গেল। এই যে দেখাই, বলিয়া সে তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া বাক্স খুলিতে প্রবৃত্ত হইল। এই বসিবার ঘরটায় আলো কম হইয়া আসিতেছিল দেখিয়া বিজয়া পাশের ঘরটা দেখাইয়া কহিল, ও-ঘরে এখনো আলো আছে, চলুন, ঐখানে যাই।

তাই চলুন, বলিয়া সে বাক্স হাতে লইয়া গৃহস্বামিনীর পিছনে পিছনে পাশের ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইল। একটি ছোট টিপয়ের উপর যন্ত্রটি স্থাপিত করিয়া উভয়ে দুই দিকে দুখানা চেয়ার লইয়া বসিল। নরেন কহিল, এইবার দেখুন। কি করে ব্যবহার করতে হয়, তার পরে আমি শিখিয়ে দেব।

এই অণুবীক্ষণ যন্ত্রটির সহিত যাহাদের সাক্ষাৎ পরিচয় নাই তাহারা ভাবিতেও পারে না কত বড় বিস্ময় এই ছোট জিনিসটির ভিতর দিয়া দেখিতে পাওয়া যায়। বাহিরের অসীম ব্রহ্মাণ্ডের মত এমনি সীমাহীন ব্রহ্মাণ্ডও যে মানুষের একটি ক্ষুদ্র মুঠার ভিতর ধরিতে পারে, সে আভাস শুধু এই যন্ত্রটির সাহায্যেই পাওয়া যায়। এইটুকুমাত্র ভূমিকা করিয়াই সে বিজয়ার মনোযোগ আহ্বান করিল। বিলাতে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা করার পরে তাহার জ্ঞানের পিপাসা এই জীবাণুতত্ত্বের দিকেই গিয়াছিল। তাই একদিকে যেমন ইহার সহিত তাহার পরিচয়ও একান্ত ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার সংগ্রহও তেমনি অপর্যাপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। সে-সমস্তই সে তাহার এই প্রাণাধিক যন্ত্রটির সহিত বিজয়াকে দিবার জন্য সঙ্গে আনিয়াছিল। সে ভাবিয়াছিল এ-সকল না দিলে শুধু শুধু যন্ত্রটা লইয়া আর একজনের কি লাভ হইবে। প্রথমে ত বিজয়া কিছু দেখিতে পায় না—শুধু ঝাপসা আর ধোঁয়া। নরেন যতই আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করে সে কি দেখিতেছে ততই তাহার হাসি পায়। সেদিকে তাহার চেষ্টাও নাই মনোযোগও নাই। দেখিবার কৌশলটা নরেন প্রাণপণে বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছে; প্রত্যেক কলকবজা নানাভাবে ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া দেখাটা সহজ করিয়া তুলিবার বিধিমতে প্রয়াস পাইতেছে; কিন্তু দেখিবে কে? যে বুঝাইতেছে, তাহার কণ্ঠস্বরে আর একজনের বুকের ভিতরটা দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছে, প্রবল নিশ্বাসে তাহার এলোচুল উড়িয়া সর্বাঙ্গ কণ্ঠকিত করিতেছে, হাত হাতে ঠেকিয়া দেহ অবশ করিয়া আনিতেছে—তাহার কি আসে-যায় জীবাণুর স্বচ্ছদেহের অভ্যন্তরে কি আছে, না আছে, দেখিয়া? কে ম্যালেরিয়ায় গ্রাম উজাড় করিতেছে, আর কে যক্ষ্মায় গৃহ শূন্য করিতেছে চিনিয়া রাখিয়া তাহার লাভ কি? করিলেও ত সে তাহাদের নিবারণ করিতে পারিবে না! সে ত আর ডাক্তার নয়! মিনিট-দশেক ধস্তাধস্তি করিয়া নরেন অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া সোজা উঠিয়া বসিল; কহিল, যান, এ আপনার কাজ নয়। এমন মোটাবুদ্ধি আমি জন্মে দেখিনি।

বিজয়া প্রাণপণে হাসি চাপিয়া কহিল, মোটাবুদ্ধি আমার, না আপনি বোঝাতে পারেন না।

নিজের রূঢ় কথায় নরেন মনে মনে লজ্জিত হইয়া কহিল, আর কি করে বোঝাবো বলুন?

আপনার বুদ্ধি আর কিছু সত্যিই মোটা নয়, কিন্তু আমার নিশ্চয় বোধ হচ্চে, আপনি মন দিচ্চেন না। আমি বকে মরচি, আর আপনি মিছামিছি ওটাতে চোখ রেখে মুখ নীচু করে শুধু হাসচেন।

কে বললে আমি হাসচি?

আমি বলচি।

আপনার ভুল।

আমার ভুল? আচ্ছা বেশ, যন্ত্রটা ত আর ভুল নয়, তবে কেন দেখতে পেলেন না?

যন্ত্রটা আপনার খারাপ, তাই!

নরেন বিস্ময়ে অবাক্‌ হইয়া বলিল, খারাপ! আপনি জানেন এ রকম পাওয়ারফুল মাইক্রস্কোপ্‌ এখানে বেশী লোকের নেই! এমন স্পষ্ট দেখাতে—

বলিয়া স্বচক্ষে একবার যাচাই করিয়া লইবার অত্যন্ত ব্যগ্রতায় ঝুঁকিতে গিয়া বিজয়ার মাথার সঙ্গে তাহার মাথা ঠুকিয়া গেল।

উঃ—করিয়া বিজয়া মাথা সরাইয়া লইয়া হাত বুলাইতে লাগিল। নরেন অপ্রস্তুত হইয়া কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই সে হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, মাথা ঠুকে দিলে কি হয় জানেন? শিঙ্‌ বেরোয়।

নরেনও হাসিল। কহিল, বেরোতে হলে আপনার মাথা থেকেই তাদের বার হওয়া উচিত।

তা বৈ কি! আপনার এই পুরোনো ভাঙা যন্ত্রটাকে ভালো বলিনি বলে, আমার মাথাটা শিঙ্‌ বেরোবার মত মাথা!

নরেন হাসিল বটে, কিন্তু তাহার মুখ শুষ্ক হইল। ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আপনাকে সত্যি বলচি, ভাঙা নয়। আমার কিছু নেই বলেই আপনার সন্দেহ হচ্চে আমি ঠকিয়ে টাকা নেবার চেষ্টা করচি, কিন্তু আপনি পরে দেখবেন।

বিজয়া কহিল, পরে দেখে আর কি কোরব বলুন? তখন আপনাকে আমি পাবো কোথায়?

নরেন তিক্তস্বরে বলিল, তবে কেন বললেন, আপনি নেবেন? কেন মিথ্যে কষ্ট দিলেন?

বিজয়া গম্ভীরভাবে বলিল, তখন আপনিই বা কেন না বললেন, এটা ভাঙা?

নরেন মহা বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, একশবার বলচি ভাঙা নয়, তবু বলবেন ভাঙা?

কিন্তু পরক্ষণেই ক্রোধ সংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আচ্ছা, তাই ভাল। আমি আর তর্ক করতে চাইনে—এটা ভাঙাই বটে। আপনি আমার এইটুকুমাত্র ক্ষতি করলেন যে, কাল আর যাওয়া হল না। কিন্তু সবাই আপনার মত অন্ধ নয়—কলকাতায় আমি অনায়াসেই বেচতে পারি, তা জানবেন। আচ্ছা, চললুম—বলিয়া সে যন্ত্রটা বাক্সের মধ্যে পুরিবার উদ্যোগ করিতে লাগিল।

বিজয়া গম্ভীরভাবে বলিল, এখুনি যাবেন কি করে? আপনাকে যে খেয়ে যেতে হবে।

না, তার দরকার নেই।

দরকার আছে বৈ কি।

নরেন মুখ তুলিয়া কহিল, আপনি মনে মনে হাসচেন। আমাকে কি উপহাস করচেন?

কাল যখন খেতে বলেছিলাম, তখন কি উপহাস করেছিলাম? সে হবে না, আপনাকে নিশ্চয় খেয়ে যেতে হবে। একটু বসুন, আমি এখুনি আসচি, বলিয়া বিজয়া হাসি চাপিতে চাপিতে সমস্ত ঘরময় রূপের তরঙ্গ প্রবাহিত করিয়া বাহির হইয়া গেল। মিনিট-পাঁচেক পরেই সে স্বহস্তে খাবারের থালা এবং চাকরের হাতে চায়ের সরঞ্জাম দিয়া ফিরিয়া আসিল। টিপয়টা খালি দেখিয়া কহিল, এর মধ্যে বন্ধ করে ফেলেচেন—আপনার রাগ ত কম নয়!

নরেন্দ্র উদাসকণ্ঠে জবাব দিল, আপনি নেবেন না তাতে রাগ কিসের? কিন্তু ভেবে দেখুন ত, এতবড় একটা ভারী জিনিস এতদূর বয়ে আনতে, বয়ে নিয়ে যেতে কত কষ্ট হয়!

থালাটা টেবিলের উপর রাখিয়া দিয়া বিজয়া কহিল, তা হতে পারে। কিন্তু, কষ্ট ত আমার জন্য করেন নি, করেছেন নিজের জন্যে। আচ্ছা, খেতে বসুন, আমি চা তৈরি করে দিই।

নরেন খাড়া বসিয়া রহিল দেখিয়া সে পুনরায় কহিল, আচ্ছা, আমিই না হয় নেব, আপনাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। আপনি খেতে আরম্ভ করুন।

0 Shares