দত্তা

নরেন্দ্র নিজেকে অপমানিত মনে করিয়া বলিল, আপনাকে দয়া করতে ত আমি অনুরোধ করিনি!

বিজয়া কহিল, সেদিন কিন্তু করেছিলেন, যেদিন মামার হয়ে বলতে এসেছিলেন।

সে পরের জন্যে, নিজের জন্যে নয়। এ অভ্যাস আমার নয়!

কথাটা যে কতদূর সত্য, বিজয়ার তাহা অগোচর ছিল না। সেই হেতু একটু গায়েও লাগিল। কহিল, যাই হোক, ওটা আপনার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না—এইখানেই থাকবে। আচ্ছা, খেতে বসুন।

নরেন সন্দিগ্ধ-স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, তার মানে?

বিজয়া কহিল, কিছু একটা আছে বৈ কি।

জবাব শুনিয়া নরেন ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। বোধ করি, মনে মনে এই কারণটা অনুসন্ধান করিল, এবং পরক্ষণেই হঠাৎ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বলিয়া উঠিল, সেইটে কি, তাই আমি আপনার কাছে স্পষ্ট শুনতে চাই। আপনি কি কেনবার ছলে কাছে আনিয়ে আটকাতে চান? এও কি বাবা আপনার কাছে বাঁধা রেখেছিলেন? আপনি ত তা হলে দেখচি আমাকেও আটকাতে পারেন? অনায়াসে বলতে পারেন, বাবা আমাকেও আপনার কাছে বাঁধা দিয়ে গেছেন।

বিজয়ার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল; সে ঘাড় ফিরাইয়া কহিল, কালীপদ, তুই দাঁড়িয়ে কি করচিস? ও-গুলো নামিয়ে রেখে যা পান নিয়ে আয়।

ভৃত্য কেৎলি প্রভৃতি টেবিলের একধারে নামাইয়া দিয়া প্রস্থান করিলে বিজয়া নিঃশব্দে নতমুখে চা প্রস্তুত করিতে লাগিল, এবং অদূরে চৌকির উপর নরেন্দ্র মুখখানা রাগে হাঁড়ির মত করিয়া বসিয়া রহিল।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

সৃষ্টিতত্ত্বের যাহা অজ্ঞেয় ব্যাপার তাহার সম্বন্ধে বিজয়া বড় বড় পণ্ডিতের মুখে অনেক আলোচনা, অনেক গবেষণা শুনিয়াছে; কিন্তু যে অংশটা তাহার জ্ঞেয়, সে কোথায় শুরু হইয়াছে, কি তাহার কার্য, কেমন তাহার আকৃতি-প্রকৃতি, কি তাহার ইতিহাস, এমন দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট ভাষায় বলিতে সে যে আর কখনো শুনিয়াছে তাহার মনে হইল না। যে যন্ত্রটাকে সে এইমাত্র ভাঙ্গা বলিয়া উপহাস করিতেছিল তাহারই সাহায্যে কি অপূর্ব এবং অদ্ভুত ব্যাপার না তাহার দৃষ্টিগোচর হইল! এই রোগা এবং ক্ষ্যাপাটে গোছের লোকটা যে ডাক্তারি পাশ করিয়াছে, ইহাই ত বিশ্বাস হইতে চায় না। কিন্তু শুধু তাহাই নয়; জীবিতদের সম্বন্ধে ইহার জ্ঞানের গভীরতা, ইহার বিশ্বাসের দৃঢ়তা, ইহার স্মরণ করিয়া রাখিবার অসামান্য শক্তির পরিচয়ে সে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল। অথচ সামান্য লোকের মত ইহাকে রাগাইয়া দেওয়াও কত না সহজ! শেষাশেষি সে কতক বা শুনিতেছিল, কতক বা তাহার কানেও প্রবেশ করিতেছিল না। শুধু মুখপানে চাহিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। নিজের ঝোঁকে সে যখন নিজেই বকিয়া যাইতেছিল, শ্রোতাটি হয়ত তখন ইহার ত্যাগ, ইহার সততা, ইহার সরলতার কথা মনে মনে চিন্তা করিয়া স্নেহে, শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে বিভোর হইয়া বসিয়া ছিল।

হঠাৎ এক সময়ে নরেনের চোখে পড়িয়া গেল যে সে মিথ্যা বকিয়া মরিতেছে। কহিল, আপনি কিছুই শুনচেন না।

বিজয়া চকিত হইয়া বলিল, শুনচি বৈ কি।

কি শুনলেন, বলুন তো?

বাঃ—একদিনেই বুঝি সবাই শিখতে পারে?

নরেন হতাশভাবে কহিল, না, আপনার কিছু হবে না। আপনার মত অন্যমনস্ক লোক আমি কোন কালে দেখিনি।

বিজয়া লেশমাত্র অপ্রতিভ না হইয়া বলিল, একদিনেই বুঝি হয়? আপনারই নাকি একদিনে হয়েছিল?

নরেন হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া বলিল, আপনার যে একশ বচ্ছরেও হবে না। তা ছাড়া এ সব শেখাবেই বা কে?

বিজয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, আপনি। নইলে ঐ ভাঙা যন্ত্রটা কে নেবে?

নরেন্দ্র গম্ভীর হইয়া কহিল, আপনার নিয়েও কাজ নেই, আমি শেখাতেও পারব না।

বিজয়া কহিল, তা হলে ছবি-আঁকা শিখিয়ে দিন। সে ত শিখতে পারব?

নরেন উত্তেজিত হইয়া বলিল, তাও না। যে বিষয়ে মানুষের নাওয়া-খাওয়া জ্ঞান থাকে না, তাতেই যখন মন দিতে পারলেন না, মন দেবেন ছবি আঁকাতে? কিছুতেই না।

তা হলে ছবি-আঁকাও শিখতে পারব না?

না।

বিজয়া ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত কহিল, কিছুই শিখতে না পারলে কিন্তু মাথায় সত্যিই শিঙ্‌ বেরোবে।

তাহার মুখের ভাবে ও কথায় নরেন পুনরায় উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, সেই হবে আপনার উচিত শাস্তি।

বিজয়া মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া বলিল, তা বৈ কি। আপনার শেখাবার ক্ষমতা নেই তাই কেন বলুন না। কিন্তু চাকরেরা কি করছে, আলো দেয় না কেন? একটু বসুন, আমি আলো দিতে বলে আসি। বলিয়া দ্রুতপদে উঠিয়া, দ্বারের পর্দা সরাইয়া অকস্মাৎ যেন ভূত দেখিয়া থামিয়া গেল। সম্মুখেই বসিবার ঘরের দুটা চৌকি দখল করিয়া পিতা-পুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী বসিয়া আছেন। বিলাসের মুখের উপর কে যেন এক ছোপ কালি মাখাইয়া দিয়াছে। বিজয়া আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কখন এলেন কাকাবাবু? আমাকে ডাকেন নি কেন?

রাসবিহারী শুষ্ক হাস্য করিয়া কহিলেন, প্রায় আধ-ঘণ্টা এসেছি মা। তুমি ও-ঘরে কথায়-বার্তায় ব্যস্ত আছ বলে আর ডাকিনি। ওই বুঝি জগদীশের ছেলে? কি চায় ও?

পাশের ঘর পর্যন্ত শব্দ না পৌঁছায়, বিজয়া এমনি মৃদুস্বরে বলিল, একটা মাইক্রস্কোপ্‌ বিক্রি করে উনি এখান থেকে যেতে চান। তাই দেখাচ্ছিলেন।

বিলাস ঠিক যেন গর্জন করিয়া উঠিল—মাইক্রস্কোপ্‌! ঠকাবার জায়গা পেলে না ও!

রাসবিহারী মৃদু র্ভৎসনার ভাবে ছেলেকে বলিলেন, ও কথা কেন? তার উদ্দেশ্য ত আমরা জানিনে—ভালও ত হতে পারে!

বিজয়ার মুখের প্রতি চাহিয়া ঈষৎ হাস্যের সহিত ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, যা জানিনে, সে সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করা আমি উচিত মনে করিনে। তার উদ্দেশ্য মন্দ নাও ত হতে পারে—কি বল মা? বলিয়া একটু থামিয়া নিজেই পুনরায় কহিলেন, অবশ্য জোর করে কিছুই বলা যায় না, সেও ঠিক। তা সে যাই হোক গে, ওতে আমাদের আবশ্যক কি? দূরবীন হলেও না হয় কখনো কালে-ভদ্রে দূরে-টুরে দেখতে কাজে লাগতেও পারে!—ও কে কালীপদ? ও ঘরে আলো দিতে যাচ্ছিস? অমনি বাবুটিকে বলে দিস আমরা কিনতে পারব না—তিনি যেতে পারেন।

বিজয়া ভয়ে ভয়ে বলিল, তাঁকে বলেছি আমি নেব।

রাসবিহারী কিছু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, নেবে? কেন? তাতে প্রয়োজন কি?

বিজয়া মৌন হইয়া রহিল।

রাসবিহারী জিজ্ঞাসা করিলেন, উনি কত দাম চান?

দু’ শ টাকা।

রাসবিহারী দুই ভ্রূ প্রসারিত করিয়া কহিলেন, দু’শ? দু’শ টাকা চায়? বিলাস তা হলে নেহাত—কি বল বিলাস, কলেজে তোমার এফ. এ. ক্লাসে কেমিস্ট্রীতে ত এসব অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেচ—দু’শ টাকা একটা মাইক্রস্কোপের দাম? কালীপদ, যা—ওঁকে যেতে বলে দে—এসব ফন্দি এখানে খাটবে না।

কিন্তু যাহাকে বলিতে হইবে, সে যে নিজের কানেই সমস্ত শুনিতেছে, তাহাতে লেশমাত্র সন্দেহ নাই। কালীপদ যাইবার উপক্রম করিতেছে দেখিয়া বিজয়া তাহাকে শান্ত অথচ দৃঢ়-কণ্ঠে বলিয়া দিল, তুমি শুধু আলো দিয়ে এসো গে, যা বলবার আমি নিজেই বলব।

0 Shares