দত্তা

ঘরের সকলেই চমকিয়া উঠিল। কালীপদ ‘শূয়ারকা বাচ্চা’ এবং ‘লাও’ কথাটার অর্থ বুঝিতে পারিল, কিন্তু ‘কুরসী’ বস্তুটি যে কি, তাহার আন্দাজ করিতে না পারিয়া সে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া একবার এদিকে একবার ওদিকে মুখ ফিরাইতে লাগিল। বৃদ্ধ রাসবিহারী নিজেকে সংবরণ করিয়া লইয়াছিলেন; তিনি গম্ভীর স্বরে কহিলেন, ও ঘর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এসো কালীপদ, বাবুকে বসতে দাও। কালীপদ দ্রুতবেগে প্রস্থান করিলে তিনি ছেলের দিকে ফিরিয়া, তাঁহার শান্ত-উদারকণ্ঠে বলিলেন, রোগা-মানুষের ঘর—অমন হেস্টি হয়ো না বিলাস। টেম্পার লুজ করা কোন ভদ্রলোকের পক্ষেই শোভা পায় না।

ছেলে উদ্ধতভাবে জবাব দিল, মানুষ এতে টেম্পার লুজ করে না ত করে কিসে শুনি? হারামজাদা চাকর, বলা নেই, কওয়া নেই, এমন একটা অসভ্য লোককে ঘরে এনে ঢোকালে যে ভদ্রমহিলার সম্মান রাখতে পর্যন্ত জানে না।

অকস্মাৎ প্রচণ্ড ধাক্কায় মাতালের যেমন নেশা ছুটিয়া যায় বিজয়ারও ঠিক তেমনি জ্বরের আচ্ছন্ন ঘোরটা ঘুচিয়া গেল। সে নিঃশব্দে নরেনের হাত ছাড়িয়া দিয়া দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল।

কালীপদ তাড়াতাড়ি একখানা চেয়ার আনিয়া রাখিয়া যাইতেই নরেন্দ্র বিছানা হইতে উঠিয়া আসিয়া তাহাতে বসিল। রাসবিহারী বিজয়ার মুখের ভাব লক্ষ্য করিতে ত্রুটি করেন নাই। তিনি একটু প্রসন্ন হাস্য করিয়া পুত্রকেই উদ্দেশ করিয়া পুনশ্চ বলিলেন, আমি সমস্তই বুঝি বিলাস। এ ক্ষেত্রে তোমার রাগ হওয়াটা যে অস্বাভাবিক নয়, বরঞ্চ খুবই স্বাভাবিক, তাও মানি, কিন্তু এটা তোমার ভাবা উচিত ছিল যে সবাই ইচ্ছা করে অপরাধ করে না। সকলেই যদি সব রকম রীতি-নীতি আচার-ব্যবহার জানত, তা হলে ভাবনা ছিল কি? সেই জন্যে রাগ না করে শান্তভাবে মানুষের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করে দিতে হয়।

এই দোষ-ত্রুটি যে কাহার, তা কাহারও বুঝিতে বিলম্ব হইল না। বিলাস কহিল, না বাবা, এ-রকম impertinence সহ্য হয় না। তা ছাড়া আমার এ বাড়ির চাকরগুলো হয়েছে যেমন হতভাগা তেমনি বজ্জাত। কালই আমি ব্যাটাদের সব দূর করে তবে ছাড়ব।

রাসবিহারী আবার একটু হাস্য করিয়া সস্নেহ তিরস্কারের ভঙ্গীতে এবার বোধ করি ঘরের দেওয়ালগুলোকে শুনাইয়া বলিলেন, এর মন খারাপ হয়ে থাকলে যে কি বলে, তার ঠিকানাই নেই। আর শুধু ছেলেকেই বা দোষ দেব কি, আমি বুড়োমানুষ, আমি পর্যন্ত অসুখ শুনে কি-রকম চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম! বাড়িতেই হল একজনের বসন্ত, তার উপর উনি ভয় দেখিয়ে গেলেন।

এতক্ষণ পর্যন্ত নরেন্দ্র কোন কথা কহে নাই; এইবার সে বাধা দিয়া কহিল, না, আমি কোন রকম ভয় দেখিয়ে যাইনি।

বিলাস মাটিতে একটা পা ঠুকিয়া সতেজে কহিল, আল্‌বৎ ভয় দেখিয়ে গেছেন। কালীপদ সাক্ষী আছে।

নরেন কহিল, কালীপদ ভুল শুনেচে।

প্রত্যুত্তরে বিলাস আর একটা কি কাণ্ড করিতে যাইতেছিল, তাহার পিতা থামাইয়া দিয়া বলিলেন, আঃ—কি কর বিলাস? উনি যখন অস্বীকার করছেন, তখন কি কালীপদকে বিশ্বাস করতে হবে? নিশ্চয়ই ওঁর কথা সত্যি।

তথাপি বিলাস কি যেন বলিবার প্রয়াস করিতেই বৃদ্ধ কটাক্ষে নিষেধ করিয়া বলিলেন, এই সামান্য অসুখেই মাথা হারিয়ো না বিলাস, স্থির হও। মঙ্গলময় জগদীশ্বর যে শুধু আমাদের পরীক্ষা করবার জন্যেই বিপদ পাঠিয়ে দেন, বিপদে পড়লে তোমরা সকলের আগে এই কথাটাই কেন ভুলে যাও আমি ত ভেবে পাইনে।

একটু স্থির থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, আর তাই যদি একটা ভুল অসুখের কথা বলেই থাকেন তাতেই বা কি? কত পাস-করা ভাল ভাল বিচক্ষণ ডাক্তারের যে ভ্রম হয়, উনি ত ছেলেমানুষ। বলিয়া নরেন্দ্রের প্রতি মুখ তুলিয়া বলিলেন, যাক—জ্বর ত তা হলে অতি সামান্যই আপনি বলছেন? চিন্তা করবার ত কোন কারণ নেই এই ত আপনার মত?

নরেন্দ্র আসিয়া পর্যন্ত অনেক অপমান নীরবে সহিয়াছিল, কিন্তু এইবার একটা বাঁকা জবাব না দিয়া থাকিতে পারিল না। কহিল, আমার বলায় কি আসে যায় বলুন? আমার ওপর ত নির্ভর করছেন না। বরং তার চেয়ে কোন ভাল পাশ-করা বিচক্ষণ ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর মতামত নেবেন।

কথাটার নিহিত খোঁচা যাই থাক, এ জবাব দিবার তাহার অধিকার ছিল। কিন্তু বিলাস একেবারে লাফাইয়া উঠিয়া মারমুখী হইয়া চেঁচাইয়া উঠিল—তুমি কার সঙ্গে কথা কইচ মনে করে কথা কয়ো বলে দিচ্চি। এ ঘর না হয়ে আর কোথাও হলে তোমার বিদ্রূপ করা—

এই লোকটার কারণে-অকারণে প্রথম হইতেই একটা ঝগড়া বাধাইয়া তুমুল কাণ্ড করিয়া তুলিবার প্রাণপণ চেষ্টা দেখিয়া নরেন্দ্র বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল। কিন্তু কেন, কিসের জন্য—কোথায় তাহার ব্যবহারের মধ্যে কি অপরাধ ঘটিতেছে কিছুই সে স্থির করিয়া উঠিতে পারিল না। আসল কারণ হইতেছে এই যে, কোথায় যে ওই লোকটার অন্তর্দাহ, নরেন্দ্র তাহা আজিও জানিত না। বিজয়া এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের অনুসন্ধিৎসু প্রতিবেশীর দল যখন বিলাসের সহিত তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধের আলোচনা করিয়া সময়ের সদ্ব্যবহার করিত, তখন ভিন্ন-গ্রামবাসী এই নবীন বৈজ্ঞানিকের অখণ্ড মনোযোগ কীটাণুকীটের সম্বন্ধ-নিরূপণেই ব্যাপৃত থাকিত; গ্রামের জনশ্রুতি তাহার কানে পৌঁছিত না। তাহার পরে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার দিনে যখন কথাটা পাকা হইয়া রাষ্ট্র হইতে কোথাও আর বাকি রহিল না তখন সে কলিকাতায় চলিয়া গেছে। আজ পিতা-পুত্রের কথার ভঙ্গীতে মাঝে মাঝে কি যেন একটা অনির্দেশ্য এবং অস্পষ্ট ব্যথার মত তাহাকে বাজিতেছিল বটে, কিন্তু চিন্তার দ্বারা তাহাকে সুস্পষ্ট করিয়া দেখিবার সময় কিংবা প্রয়োজন কিছুই তাহার ছিল না। ঠিক এই সময়ে বিজয়া এদিকে মুখ ফিরাইল। নরেন্দ্রের মুখের প্রতি ব্যথিত, উৎপীড়িত দুটি চক্ষু ক্ষণকাল নিবদ্ধ করিয়া কহিল, আমি যতদিন বাঁচব, আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব। কিন্তু এঁরা যখন অন্য ডাক্তার দিয়ে আমার চিকিৎসা করা স্থির করেছেন, তখন আর আপনি নিরর্থক অপমান সইবেন না। কিন্তু ফিরে যাবার পথে দয়ালবাবুকে একবার দেখে যাবেন শুধু এই মিনতিটি রাখবেন। বলিয়া প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই সে পুনরায় মুখ ফিরাইয়া শুইল। রাসবিহারী অনেক পূর্বেই আসল ব্যাপারটা বুঝিয়াছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিলেন, বিলক্ষণ! তুমি যাঁকে ডেকে পাঠিয়েছ তাঁকে অপমান করে কার সাধ্য!

তারপর ছেলেকে নানাপ্রকার র্ভৎসনার মধ্যে বারংবার এই কথাটাই প্রচার করিতে লাগিলেন যে, অসুখের গুরুত্ব কল্পনা করিয়া উৎকণ্ঠায় বিলাসের হিতাহিত জ্ঞান লোপ পাইয়াছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র ও অদ্বিতীয় নিরাকার পরব্রহ্মের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অনেক আধ্যাত্মিক ও নিগূঢ় তত্ত্ব-কথার মর্মোদঘাটন করিয়া দেখাইয়া দিলেন। নরেন্দ্র কোন কথা কহিল না। পিতা ও পুত্রের নিকট হইতে তত্ত্বকথা ও অপমানের বোঝা নিঃশব্দে দুই স্কন্ধে ঝুলাইয়া লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং লাঠি ও ছোট ব্যাগটি হাতে করিয়া তেমনি নীরবে বাহির হইয়া গেল। রাসবিহারী পিছন হইতে ডাকিয়া কহিলে, নরেন্দ্রবাবু, আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আলোচনা করবার আছে—বলিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া ছেলেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, একমাত্র ও অদ্বিতীয়রূপে বিজয়ার ঘরের মধ্যে অধিষ্ঠিত রাখিয়া দ্রুতবেগে তাহার অনুসরণ করিয়া নীচে নামিয়া গেলেন।

0 Shares