দত্তা

নরেন্দ্রকে পাশের একটা ঘরে বসাইয়া তিনি ভূমিকাচ্ছলে কহিলেন, পাঁচজনের সামনে তোমাকে বাবুই বলি আর যাই বলি, বাবা, এটা কিন্তু ভুলতে পারিনে তুমি আমাদের সেই জগদীশের ছেলে। বনমালী, জগদীশ দুইজনেই স্বর্গীয় হয়েছেন, শুধু আমিই পড়ে আছি। কিন্তু আমরা তিনজনে যে কি ছিলাম সে আভাস তোমাকে ত সেইদিনই দিয়েছিলাম, কিন্তু খুলে বলতে পারিনে—নরেন আমার বুক যেন ফেটে যেতে চায়।

নরেন চুপ করিয়া রহিল।

হঠাৎ রাসবিহারীর আর একদিনের কথাগুলা যেন মনে পড়ায় বলিয়া উঠিলেন, ওই দরকারী যন্ত্রটা বিক্রি করায় আমি সত্যিই তোমার উপর বড় বিরক্ত হয়েছিলাম নরেন। একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, কিন্তু দেখ বাবা, এই বিরক্ত হয়েছিলাম কথাটা বড় রূঢ়। হইনি বলতে পারলেই সাংসারিক হিসাবে হয় ভাল—বলতে শুনতে সব দিকেই নিরাপদ—কিন্তু যাক। বলিয়া একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া অনেকটা যেন আত্মগত ভাবেই পুনরায় কহিতে লাগিলেন, আমার দ্বারা যা অসাধ্য তা নিয়ে দুঃখ করা বৃথা। কত লোকের অপ্রিয় হই, কত লোকে গাল দেয়, বন্ধুরা বলেন, ‘বেশ, মিথ্যা বলতে যখন কোন কালেই পারলে না রাসবিহারী, তখন, তা বলতেও আমরা বলিনে, কিন্তু, একটু ঘুরিয়ে বললেই যদি গালমন্দ হতে নিস্তার পাওয়া যায়, তাই কেন করো না?’ আমি শুনে শুধু অবাক হয়ে ভাবি বাবা, যা ঘটেনি, তা বানিয়ে বলা, ঘুরিয়ে বলা যায় কি করে? এরা আমার ভালই চায়, তা বুঝি, কিন্তু সেই মঙ্গলময় আমাকে যে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেছেন, সে অসাধ্যসাধন করিই বা আমি কেমন করে? যাক বাবা, নিজের সম্বন্ধে আলোচনা করতে আমি কোন দিনই ভালবাসি নে—এতে আমার বড় বিতৃষ্ণা। পাছে তুমি দুঃখ পাও, তাই এত কথা বলা। বলিয়া উদাস-নেত্রে কড়িকাঠের দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া চোখ নামাইয়া কহিলেন, আর একটা কথা কি জান নরেন, এই সংসারে চিরকাল আছি বটে, চুল পাকিয়েও ফেললাম সত্য,কিন্তু কি করলে, কি বললে যে এখানে সুখ-সুবিধে মেলে তা আজও এই পাকা-মাথাটায় ঢুকল না। নইলে, তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম এ কথা মুখের ওপর বলে তোমার মনে আজ ক্লেশ দেব কেন?

নরেন বিনয়ের সহিত বলিল, যা সত্য তাই বলেছেন—এতে দুঃখ করবার ত কিছু নেই।

রাসবিহারী ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন না না, ও কথা বলো না নরেন—কঠোর কথা মনে বাজে বৈ কি! যে শোনে তার ত বাজেই, যে বলে, তারও কম বাজে না বাবা। জগদীশ্বর!

নরেন অধোমুখে চুপ করিয়া রহিল। রাসবিহারী অন্তরের ধর্মোচ্ছ্বাস সংযত করিয়া লইয়া পরে বলিতে লাগিলেন, কিন্তু তার পরে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম, সে কি কথা! সে অনেক দুঃখই নিজের অমন আবশ্যকীয় জিনিসটা বিক্রি করে গেছে। তার মূল্য যাই হোক, কিন্তু কথা যখন দেওয়া হয়েছে তখন, আর ত ভাবাও চলে না, দাম দিতেও বিলম্ব করা চলে না।

মনে মনে বললাম, আমার বিজয়া-মা যখন ইচ্ছে, যতদিনে ইচ্ছে টাকা দিন, কিন্তু আমি টাকাটা পাঠিয়ে দিই-ই। সে বেচারা যখন ঐ টাকা নিয়েই তবে বিদেশে যাবে, একটা দিনও ত দেরি করা কর্তব্য নয়। তার উপর সে যখন আমার জগদীশের ছেলে!

নরেন তখনকার কটু কথাগুলা স্মরণ করিয়া বেদনার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, তার কি দাম দেবার দেবার ইচ্ছে ছিল না?

বৃদ্ধ গম্ভীর হইয়া বলিলেন, না, সে কথা আমার ত মনে হয়নি নরেন। কিন্তু তবে কি জান—না, থাক। বলিয়া তিনি সহসা মৌন হইলেন।

চারিশত টাকায় যাচাই করা কথাটা একবারে নরেনের জিহ্বায় আসিয়া পড়িল, কিন্তু সেই সঙ্গেই কেমন একটা ক্লেশ বোধ হওয়ার এ সম্বন্ধে আর কোন কথা সে কহিল না।

রাসবিহারী এইবার দরকারী কথাটা পাড়িলেন। তিনি লোক চিনিতেন। নরেনের আজিকার কথাবার্তায় ও ব্যবহারে তাঁহার ঘোর সন্দেহ জন্মিয়াছিল যে, এখনও সে আসল কথাটা জানে না এবং এই সকল অন্যমনস্ক ও উদাসীন-প্রকৃতির মানুষগুলোর একেবারে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া না দিলে নিজ হইতে অনুসন্ধান করিয়াও ইহারা কোন দিনই কিছু জানিতে চাহে না। বলিলেন, বিলাসের আচরণে আজ আমি যেমন দুঃখ তেমনি লজ্জা কিছু জানিতে চাহে না। বলিলেন, বিলাসের আচরণে আজ আমি যেমন দুঃখ তেমনি লজ্জা বোধ করেছি। ওই মাইক্রস্কোপ্‌টার কথাই বলি। বিজয়া একবার যদি তার মত নিয়ে সেটা কিন্‌ত, তা হলে ত কোন কথাই উঠতে পারত না। তুমিই বল দেখি, এ কি তার কর্তব্য ছিল না?

বিজয়ার কর্তব্যটা ঠিক বুঝিতে না পারিয়া নরেন্দ্র জিজ্ঞাসুমুখে চাহিয়া রহিল। রাসবিহারী কহিলেন, তার অসুখের খবর পেয়েই বিলাস যে কি রকম উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছে, এ ত আমার বুঝতে বাকি নেই। হওয়াই স্বাভাবিক—সমস্ত ভালমন্দ, সমস্ত দায়িত্ব ত শুধু তারই মাথার উপরে। চিকিৎসা এবং চিকিৎসক স্থির করা ত তারই কাজ। তার অমতে ত কিছুই হতে পারে না। বিজয়া নিজেও ত অবশেষে তা বুঝলেন, কিন্তু দুদিন পূর্বে চিন্তা করলে ত এ-সব অপ্রিয় ব্যাপার ঘটতে পারত না। নিতান্ত বালিকা নয়—ভাবা ত উচিত ছিল।

কেন যে উচিত ছিল, তাহা তখন পর্যন্তও বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া নরেন বৃদ্ধের প্রশ্নে সায় দিতে পারিল না। কিন্তু তবুও তাহার বুকের ভিতরটা আশঙ্কায় তোলপাড় করিতে লাগিল। অথচ, বুঝিয়া লইবার মত কথাও তাহার কণ্ঠ দিয়া বাহির হইল না। সে শুধু শঙ্কিত দুই চক্ষু বৃদ্ধের মুখের প্রতি মেলিয়া নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

রাসবিহারী বলিলেন, তুমি কিন্তু বাবা, বিলাসের মনের অবস্থা বুঝে মনের মধ্যে কোন গ্লানি রাখতে পাবে না। আর একটা অনুরোধ আমার এই রইল নরেন, এদের বিবাহ ত বৈশাখেই হবে, যদি কলকাতাতেই থাকো, শুভকর্মে যোগ দিতে হবে তা বলে রাখলাম।

নরেন কথা কহিতে পারিল না, শুধু ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, আচ্ছা।

রাসবিহারী তখন পুলকিত-চিত্তে অনেক কথা বলিতে লাগিলেন, এ বিবাহ যে মঙ্গলময়ের একান্ত অভিপ্রেত, এবং বর-কন্যার জন্মকাল হইতেই যে স্থির হইয়া ছিল, এবং এই প্রসঙ্গে বিজয়ার পরলোকগত পিতার সহিত তাঁহার কি কি কথা হইয়াছিল ইত্যাদি বহু প্রাচীন ইতিহাস বিবৃত করিতে করিতে সহসা বলিয়া উঠিলেন, ভাল কথা, কলকাতাতেই কি এখন থাকা হবে? একটু সুবিধে-টুবিধে হবার কি আশা—

নরেন্দ্র কহিল, হাঁ। একটা বিলাতি ওষুধের দোকানে সামান্য একটা কাজ পেয়েছি।

রাসবিহারী খুশি হইয়া বলিলেন, বেশ—বেশ। ওষুধের দোকান—কাঁচা পয়সা। টিকে থাকতে পারলে আখেরে গুছিয়ে নিতে পারবে।

নরেন এ ইঙ্গিতের ধার দিয়াও গেল না। কহিল, আজ্ঞে হাঁ।

শুনিয়া রাসবিহারী আর কৌতূহল দমন করিতে পারিলেন না। একটু ইতস্ততঃ করিয়া প্রশ্ন করিলেন, তা হলে মাইনেটা কি-রকম দিচ্চে?

0 Shares