দত্তা

স্টেশনে পৌঁছিয়া দেখিল, যে মাইক্রস্কোপ্‌টা এত দুঃখের মূল, সেইটাকে লইয়াই কালীপদ দাঁড়াইয়া আছে। সে কাছে আসিয়া বলিল, ডাক্তারবাবু, মাঠান আপনাকে এইটে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

নরেন তিক্তস্বরে কহিল, কেন?

কেন তাহা কালীপদ জানিত না। কিন্তু জিনিসটা যে ডাক্তারবাবুর, এবং ইহাকেই লক্ষ্য করিয়া যত প্রকারের অপ্রিয় ব্যাপার ঘটিয়া সম্মুখে এবং দ্বারের অন্তরাল হইতে কিছুই কালীপদর অবিদিত ছিল না। সে বুদ্ধি খাটাইয়া হাসিমুখে বলিল, আপনি ফিরে চেয়েছিলেন যে!

নরেন্দ্র মনে মনে অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, না চাইনি। দাম দেবার টাকার নেই আমার।

কালীপদ বুঝিল ইহা অভিমানের কথা। সে অনেক দিনের চাকর, টাকাকড়ি সম্বন্ধে বিজয়ার মনের ভাব এবং আচরণের বহু দৃষ্টান্ত সে চোখে দেখিয়াছে। সে তাহার সেই জ্ঞানটুকু আরও একটু ফলাও করিয়া একটু হাসিয়া, একটু তাচ্ছিল্যের ভাবে বলিল, ইঃ, ভারী ত দাম। মাঠানের কাছে দু-চার শ টাকা নাকি আবার টাকা! নিয়ে যান আপনি। যখন যোগাড় করতে পারবেন দামটা পাঠিয়ে দেবেন। অর্থ-সম্বন্ধে তাহার প্রতি বিজয়ার এই অযাচিত বিশ্বাস নরেন্দ্রের ক্রোধটাকে একটু নরম করিয়া আনিলেও তাহার কণ্ঠস্বরের তিক্ততা দূর করিতে পারিল না। তাই সে যখন দুই শতের পরিবর্তে চারি শত দিবার অক্ষমতা জানাইয়া কহিল, না না, তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও কালীপদ, আমার দরকার নেই। দু’শ টাকা বদলে চার শ’ টাকা আমি দিতে পারব না, তখন কালীপদ অনুনয়ের স্বরেই বলিয়া উঠিল, না ডাক্তারবাবু, তা হবে না—আপনি সঙ্গে নিয়ে যান—আমি গাড়িতে তুলে দিয়ে যাবো।

এই জিনিসটা সম্বন্ধে তাহার নিজের একটুখানি বিশেষ গরজ ছিল। বিলাসকে সে দু’চক্ষে দেখিতে পারিত না বলিয়া তাহার প্রতি অনেকটা আক্রোশবশতঃই নরেনের প্রতি তাহার একপ্রকার সহানুভূতি জন্মিয়াছিল। সেইজন্য দরোয়ানকে দিয়া পাঠাইতে বিজয়া আদেশ করিলেও কালীপদ নিজে যাচিয়া এতটা পথ এই ভারী বাক্সটা বহিয়া আনিয়াছিল। নরেন্দ্র মনে মনে ইতস্ততঃ করিতেছে কল্পনা করিয়া সে আরও একটু কাছে ঘেঁষিয়া গলা খাটো করিয়া বলিল, আপনি নিয়ে যান ডাক্তারবাবু। মাঠান ভাল হয়ে চাই কি দামটা আপনাকে ছেড়ে দিতেও পারেন।

এই ইঙ্গিত শুনিয়া নরেন্দ্র অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। বটে! সে ডাকিয়াছে অথচ বিলাস তাহার অপমান করিয়াছে— এ বুঝি তাহারই যৎকিঞ্চিৎ কৃপার বকশিশ!

কিন্তু প্ল্যাটফর্মের উপর আরও লোকজন ছিল বলিয়াই সে যাত্রা কালীপদর একটা ফাঁড়া কাটিয়া গেল। নরেন্দ্র কোনমতে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া বাহিরের পথটা হাত দিয়া নির্দেশ করিয়া শুধু বলিল—যাও আমার সুমুখ থেকে। বলিয়াই মুখ ফিরাইয়া আর একদিকে চলিয়া গেল। কালীপদ হতবুদ্ধি বিহ্বলের ন্যায় কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ব্যাপারটা যে কি হইল তাহার মাথার ঢুকিল না। মিনিট পনরো পরে গাড়ি আসিলে নরেন্দ্র যখন উঠিয়া বসিল তখন কালীপদ আস্তে আস্তে সেই ফার্স্টক্লাস কামরার জানালার কাছে আসিয়া ডাকিল, ডাক্তারবাবু!

নরেন্দ্র অন্যদিকে চাহিয়াছিল, মুখ ফিরাইতেই কালীপদর মলিন মুখের উপর চোখ পড়িল। চাকরটার প্রতি নিরর্থক রূঢ় ব্যবহার করিয়া সে মনে মনে একটু অনুতপ্ত হইয়াছিল; তাই একটু হাসিয়া সদয়কণ্ঠে কহিল, আবার কি?

সে এক টুকরা কাগজ এবং পেন্সিল বাহির করিয়া বলিল, আপনার ঠিকানাটা একটুখানি যদি—

আমার ঠিকানা নিয়ে কি করবে?

আমি কিছু করব না—মাঠান বলে দিলেন—

মাঠানের নামে এবার নরেন্দ্রর আত্মবিস্মৃতি ঘটিল, অকস্মাৎ সে প্রচণ্ড একটি ধমক দিয়া বলিয়া উঠিল—বেরো সামনে থেকে বলচি—পাজী নচ্ছার কোথাকার!

কালীপদ চমকিয়া দু’পা হটিয়া গেল—এবং পরক্ষণেই বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল।

সে ফিরিয়া আসিয়া যখন উপরের ঘরে প্রবেশ করিল তখন বিজয়া খাটের বাজুতে মাথা রাখিয়া চোখ বুজিয়া হেলান দিয়া বসিয়াছিল। পদশব্দে চোখ মেলিতেই কালীপদ কহিল, ফিরিয়ে দিলেন—নিলেন না।

বিজয়ার দৃষ্টিতে বেদনা বা বিস্ময় কিছুই প্রকাশ পাইল না। কালীপদ হাতের কাগজ ও পেন্সিলটা টেবিলের উপর রাখিয়া দিতে দিতে বলিল, বাবা, কি রাগ! ঠিকানা জিজ্ঞেস করায় যেন তেড়ে মারতে এলেন। ইহার উত্তরেও বিজয়া কথা কহিল না।

সমস্ত পথটা কালীপদ আপনা আপনি মহলা দিতে দিতে আসিতেছিল, মনিবের আগ্রহের জবাবে সে কি বলিবে? কিন্তু সে-পক্ষে লেশমাত্র উৎসাহ না পাইয়া সে চোখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, বিজয়ার দৃষ্টি তেমনি নির্বিকার, তেমনি শূন্য। হঠাৎ তাহার মনে হইল যেন সমস্ত জানিয়া-শুনিয়াই বিজয়া এই একটা মিথ্যা কাজে তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তাই সে অপ্রতিভভাবে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া শেষে আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গেল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যেই বিজয়ার রোগ সারিয়া গেল বটে, কিন্তু শরীর সারিতে দেরি হইতে লাগিল। বিলাস ভাল ডাক্তার দিয়া বলকারক ঔষধ ও পথ্যের বন্দোবস্ত করিতে ত্রুটি করিল না, কিন্তু দুর্বলতা যেন প্রতিদিন বাড়িয়াই যাইতে লাগিল। এদিকে ফাল্গুন শেষ হইতে চলিল, মধ্যে শুধু চৈত্র মাসটা বাকী; বৈশাখের প্রথম সপ্তাহেই ছেলের বিবাহ দিবেন রাসবিহারীর ইহাই সঙ্কল্প। কিন্তু পাত্র যত দিন দিন পরিপুষ্ট ও কান্তিমান হইয়া উঠিতে লাগিলেন,কন্যা তেমনি শীর্ণ ও মলিন হইয়া যাইতেছে দেখিয়া রাসবিহারী প্রত্যহ একবার করিয়া আসিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া যাইতে লাগিলেন। অথচ চেষ্টার কোন দিকে কিছুমাত্র ত্রুটি ইইতেছে না—তবে কি! সেই মাইক্রস্কোপ্‌-ঘটিত ব্যাপারটা বাহিরে হইতে কেমন করিয়া না জানি একটু অতিরঞ্জিত হইয়াই পিতা-পুত্রের কানে গিয়াছিল। শুনিয়া ছোটতরফ যতই লাফাইতে লাগিল, বড়তরফ ততই তাহাকে ঠাণ্ডা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে ছেলেকে তিনি বিশেষ করিয়া সতর্ক করিয়া দিলেন যে, এই সকল ছোটখাটো বিষয় লইয়া দাপাদাপি করিয়া বেড়ানো শুধু যে নিষ্প্রয়োজন তাই নয়, তাহার অসুস্থ দেহের উপর হাঙ্গামা করিতে গেলে হিতে বিপরীত ঘটাও অসম্ভব নয়। বিলাস পৃথিবীর আর যত লোককেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক, পিতার পাকাবুদ্ধিকে সে মনে মনে খাতির করিত। কারণ ঐহিক ব্যাপারে সে বুদ্ধির উৎকর্ষতার এত অপর্যাপ্ত নজির রহিয়া গেছে যে তাহার প্রামাণ্য-সম্বন্ধে সন্দেহ করা একপ্রকার অসম্ভব। সুতরাং এই লইয়া বুকের মধ্যে তাহার যত বিষই গাঁজাইয়া উঠিতে থাকুক, প্রকাশ্য বিদ্রোহ করিতে সাহস করে নাই। কিন্তু আর সহিল না। সেদিন হঠাৎ অতি তুচ্ছ কারণে সে কালীপদকে লইয়া পড়িল; এবং প্রথমটা এই-মারি-ত-এই-মারি করিয়া অবশেষে তাহার মাহিনা চুকাইয়া দিতে গোমস্তার প্রতি হুকুম করিয়া তাহাকে ডিসমিস্‌ করিল।

0 Shares