দত্তা

চিকিৎসক বিজয়ার সকালে-বিকালে যৎকিঞ্চিৎ ভ্রমণের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। সেদিন সকালে সে নদীর তীরে একটু ঘুরিয়া ফিরিয়া বাটী ফিরিতেই কালীপদ অশ্রুবিকৃতস্বরে বলিল, মা, ছোটবাবু আমাকে জবাব দিলেন।

বিজয়া আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

কালীপদ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, কর্তাবাবু স্বর্গে গেছেন, কিন্তু তেনার কাছে কখন গালমন্দ খাইনি মা, কিন্তু আজ—বলিয়া সে ঘন ঘন চোখ মুছিতে লাগিল; তার পরে কান্না শেষ করিয়া যাহা কহিল; তাহার মর্ম এই যে, যদিচ সে কোন অপরাধ করে নাই, তথাপি ছোটবাবু তাহাকে দু’চক্ষে দেখিতে পারেন না। ডাক্তারবাবুর কাছে সেই বাক্সটা দিতে যাওয়ার কথা কেন আমি তাঁহাকে নিজে জানাই নাই, কেন আমি তাঁহাকে ঘরে ডাকিয়া আনিয়াছিলাম—ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজয়া চৌকির উপর অত্যন্ত শক্ত হইয়া বসিয়া রহিল—বহুক্ষণ পর্যন্ত একটা কথাও কহিল না। পরে জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কোথায়?

কালীপদ বলিল, কাছারি-ঘরে বসে কাগজ দেখচেন।

বিজয়া ক্ষণকাল ইতস্ততঃ করিয়া কহিল, আচ্ছা, দরকার নেই—এখন তুই কাজ কর গে যা। বলিয়া সে নিজেও চলিয়া গেল। ঘণ্টা-খানেক পরে জানালা দিয়া দেখিতে পাইল, বিলাস কাছারি-ঘর হইতে বাহির হইয়া বাড়ি চলিয়া গেল। কেন যে আজ সে তত্ত্ব লইতে বাড়ি ঢুকিল না তাহা সে বুঝিল।

দয়াল আরোগ্য হইয়া আবার নিয়মিত কাজে আসিতেছিলেন। সন্ধ্যার পূর্বে ঘরে ফিরিবার সময় এক-একদিন বিজয়া তাঁহার সঙ্গ লইত, এবং কথা কহিতে কহিতে কতকটা পথ আগাইয়া দিয়া পুনরায় ফিরিয়া আসিত।

নরেনের প্রতি দয়ালের অন্তঃকরণ সম্ভ্রমে কৃতজ্ঞতায় একেবারে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। পীড়ার কথা উঠিলে বৃদ্ধ এই নবীন চিকিৎসকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় সহস্র-মুখ হইয়া উঠিতেন। বিজয়া চুপ করিয়া শুনিত কিন্তু কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করিত না বলিয়াই দয়াল মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিতেন না যে, তাঁহার একান্ত ইচ্ছা ইঁহাকে ডাকাইয়াই একবার বিজয়ার অসুখের কথাটা জিজ্ঞাসা করা হয়। ভিতরের রহস্য তখনো তাঁহার সম্পূর্ণ অগোচর ছিল বলিয়াই বিজয়ার নীরব উপেক্ষায় তিনি মনে মনে পীড়া অনুভব করিয়া সহস্র প্রকার ইঙ্গিতের দ্বারা প্রকাশ করিতে চাহিতেন, হোক সে ছেলেমানুষ, কিন্তু যে-সব নামজাদা বিজ্ঞ চিকিৎসকের দল তোমার মিথ্যা চিকিৎসা করিয়া টাকা এবং সময় নষ্ট করচে, তাদের চেয়ে সে ঢের বেশী বিজ্ঞ এ আমি শপথ করে বলতে পারি।

কিন্তু, এই গোপন রহস্যের আভাস পাইতে তাঁহার বেশী দিন লাগিল না। দিন পাঁচ-ছয় পরেই একদিন সহসা তিনি বিজয়ার ঘরে আসিয়া বলিলেন, কালীপদকে আর ত আমি বাড়িতে রাখতে পারিনে মা।

বিজয়ার এ আশঙ্কা ছিলই; তথাপি সে জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

দয়াল কহিলেন, তুমি যাকে বাড়িতে রাখতে পারলে না, আমি তাকে রাখব কোন্‌ সাহসে বল দেখি মা?

বিজয়া মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, কিন্তু সেটাও ত আমারই বাড়ি।

দয়াল লজ্জা পাইয়া বলিলেন, তা ত বটেই। আমরা সকলেই ত তোমার আশ্রিত মা। কিন্তু—

বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তিনি কি আপনাকে রাখতে নিষেধ করেছেন?

দয়াল চুপ করিয়া রহিলেন।

বিজয়া বুঝিতে পারিয়া কহিল, তবে আমার কাছেই কালীপদকে পাঠিয়ে দেবেন। সে আমার বাবার চাকর, তাকে আমি বিদায় দিতে পারব না।

দয়াল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সঙ্কোচের সহিত কহিলেন, কাজটা ভাল হবে না মা। তাঁর অবাধ্য হওয়াও তোমার কর্তব্য নয়।

বিজয়া ভাবিয়া বলিল, তা হলে আমাকে কি করতে বলেন?

দয়াল কহিলেন, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কালীপদ নিজেই বাড়ি যেতে চাচ্চে। আমি বলি, কিছুদিন সে তাই যাক।

বিজয়া অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বলিল, তবে তাই হোক। কিন্তু যাবার আগে এখানে তাকে একবার পাঠিয়ে দেবেন।

দীর্ঘশ্বাসের শব্দে চকিত হইয়া বৃদ্ধ মুখ তুলিতেই এই তরুণীর মলিন মুখের উপর একটা নিবিড় ঘৃণার ছবি দেখিতে পাইয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। সেদিন এ সম্বন্ধে আর কোন কথা বলিতে তাঁহার সাহস হইল না।

ইহার পর চার-পাঁচদিন দয়ালকে আর দেখিতে পাওয়া গেল না। বিজয়া কাছারি-ঘরে সংবাদ লইয়া জানিল, তিনি কাজেও আসেন নাই, শুনিয়া উদ্বিগ্নচিত্তে ভাবিতেছে, লোক পাঠাইয়া সংবাদ লওয়া প্রয়োজন কিনা, এমনি সময়ে দ্বারের বাহিরে তাঁহারই কাশির শব্দে বিজয়া সানন্দে উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে ঘরে আনিয়া বসাইল।

দয়ালের স্ত্রী চিররুগ্না। হঠাৎ তাঁহারই অসুখের বাড়াবাড়িতে কয়েকদিন তিনি বাহির হইতে পারেন নাই। নিজেকেই পাক করিতে হইতেছিল। অথচ তাঁহার নিরুদ্বেগ মুখের চেহারায় বিজয়া বুজিতে পারিল, বিশেষ কোন ভয় নাই। তথাপি প্রশ্ন করিল, এখন তিনি কেমন আছেন?

দয়াল বলিলেন, আজ ভাল আছেন। নরেনবাবুকে চিঠি লিখতে কাল বিকেলে এসে তিনি ওষুধ দিয়ে গেছেন। কি অদ্ভুত চিকিৎসা মা, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই পীড়া যেন বারো আনা আরোগ্য হয়ে গেছে।

বিজয়া মুখ টিপিয়া হাসিয়া কহিল, ভাল হবে না? আপনাদের সকলের কি সোজা বিশ্বাস তাঁর উপরে?

দয়াল বলিলেন, সে কথা সত্যি। কিন্তু বিশ্বাস ত শুধু শুধু হয় না মা, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি কিনা, মনে হয়, ঘরে পা দিলেই যেন সমস্ত ভাল হয়ে যাবে।

তা হবে, বলিয়া বিজয়া আবার একটুখানি হাসিল। এবার দয়াল নিজেও একটু হাসিয়া কহিলেন, শুধু তাঁরই চিকিৎসা করে যাননি মা, আরও একজনের ব্যবস্থা করে গেছেন বলিয়া তিনি টেবিলের উপর এক টুকরো কাগজ মেলিয়া ধরিলেন।

একখানা প্রেসক্রিপশান। উপরে বিজয়ার নাম লেখা। লেখাটুকুর উপর চোখ পড়িবামাত্রই ওই কয়টা অক্ষর যেন আনন্দের বাণ হইয়া বিজয়ার বুকে আসিয়া বিঁধিল। পলকের জন্য তাহার সমস্ত মুখ আরক্ত হইয়াই একেবারে ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হইয়া গেল। বৃদ্ধ নিজের কৃতিত্বের পুলকে এমনি বিভোর হইয়াছিলেন যে, সেদিকে দৃষ্টিপাতও করিলেন না। বলিলেন, তোমাকে কিন্তু উপেক্ষা করতে দেব না মা। ওষুধটা একবার পরীক্ষা করে দেখতেই হবে, তা বলে দিচ্চি।

বিজয়া আপনাকে সামলাইয়া লইয়া কহিল, কিন্তু এ যে অন্ধকারে ঢিল ফেলা—

বৃদ্ধ গর্বে প্রদীপ্ত হইয়া বলিলেন, ইস! তাই বুঝি! এ কি তোমার নেটিভ ডাক্তার পেয়েছ মা, যে দক্ষিণা দিলেই ব্যবস্থা লিখে দেবে? এ যে বিলাতের বড় পাস-করা ডাক্তার! নিজের চোখে না দেখে যে এঁরা কিছুই করেন না। এঁদের দায়িত্ববোধ কি সোজা মা?

অকৃত্রিম বিস্ময়ে বিজয়া দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, নিজের চোখে দেখে কি রকম? কে বললে আমাকে তিনি দেখে গেছেন? এ শুধু আপনার মুখের কথা শুনেই ওষুধ লিখে দিয়েছেন।

0 Shares