দত্তা

দয়াল বার বার করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন, না, না, না। তা কখনই নয়। কাল যখন তুমি তোমাদের বাগানের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলে, তখন ঠিক তোমার সুমুখের পথ দিয়েই যে তিনি হেঁটে গেছেন। তোমাকে ভাল করেই দেখে গেছেন—বোধ হয় অন্যমনস্ক ছিলে বলেই—

বিজয়া হঠাৎ চমকিয়া কহিল, তাঁর কি সাহেবি পোশাক ছিল? মাথায় হ্যাট ছিল?

দয়াল কৌতুকের প্রাবল্যে হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিতে লাগিলেন, কে বলবে যে খাঁটি সাহেব নয়? কে বলবে আমাদের স্বজাতি বাঙালী? আমি নিজেই যে হঠাৎ চমকে গিয়েছিলুম মা।

সুমুখ দিয়া গিয়াছেন, ঠিক চোখের উপর দিয়া গিয়াছেন, তাহাকে দেখিতে দেখিতে গিয়াছেন—অথচ সে একটি বারের বেশী দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করে নাই। পুলিশের কোন ইংরাজ কর্মচারী হইবে ভাবিয়া বরঞ্চ সে অবজ্ঞায় চোখ নামাইয়া লইয়াছিল। তাহার হৃদয়ের মধ্যে কি ঝড় বহিয়া গেল বৃদ্ধ তাহার কোন সংবাদই রাখিলেন না। তিনি নিজের মনে বলিয়া যাইতে লাগিলেন—মাঝে শুধু চৈত্র মাসটা বাকী। বৈশাখের প্রথম, না হয় বড় জোর দ্বিতীয় সপ্তাহেই বিবাহ। বললাম মায়ের যে শরীর সারে না ডাক্তারবাবু, একটা কিছু ওষুধ দিন, যাতে—তাঁহার মুখের কথাটা ঐখানেই অসমাপ্ত রহিয়া গেল।

এভাবে অকস্মাৎ থামিয়া যাইতে দেখিয়া বিজয়া মুখ তুলিয়া তাঁহার দৃষ্টি অনুসরণ করিতেই দেখিল, বিলাস ঘরে ঢুকিতেছে। একটা আলোচনা চলিতেছিল, তাহার আগমনে বন্ধ হইয়া গেল—প্রবেশমাত্রই অনুভব করিয়া বিলাসের চোখমুখ ক্রোধে কালো হইয়া উঠিল। কিন্তু আপনাকে যথাসাধ্য সংবরণ করিয়া সে নিকটে আসিয়া একখানা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল। ঠিক সম্মুখে প্রেস্‌ক্রিপশানটা পড়িয়া ছিল, দৃষ্টি পড়ায় হাত দিয়া সেখানা টেবিলের উপর হইতে তুলিয়া লইয়া আগাগোড়া তিন-চারবার করিয়া পড়িয়া যথাস্থলে রাখিয়া দিয়া কহিল, নরেন ডাক্তারের প্রেস্‌ক্রিপশান দেখচি। এলো কি করে—ডাকে নাকি?

কেহই সে কথার উত্তর দিল না। বিজয়া ঈষৎ মুখ ফিরাইয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল।

বিলাস হিংসায়-পোড়া একটুখানি হাসিয়া বলিল, ডাক্তার ত নরেন ডাক্তার! তাই বুঝি এঁদের ওষুধ খাওয়া হয় না, শিশির ওষুধ শিশিতেই পচে; তার পরে ফেলে দেওয়া হয়! তা না হয় হোলো কিন্তু এই কলির ধন্বন্তরিটি কাগজখানি পাঠালেন কি করে শুনি? ডাকে নাকি?

এ প্রশ্নেরও কেহ জবাব দিল না।

সে তখন দয়ালের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনি ত এতক্ষণ খুব লেকচার দিচ্ছিলেন—সিঁড়ি থেকেই শোনা যাচ্ছিল—বলি, আপনি কিছু জানেন?

এই জমিদারী সেরেস্তায় বিলাসবিহারীর অধীনে কর্ম গ্রহণ করা অবধি দয়াল মনে মনে তাহাকে বাঘের মত ভয় করিতেন। কালীপদর মুখে শুনিতেও কিছু বাকি ছিল না। সুতরাং প্রেস্‌ক্রিপসনখানা হাতে করা পর্যন্তই তাঁহার বুকের ভিতরটা বাঁশপাতার মত কাঁপিতেছিল। এখন প্রশ্ন শুনিয়া মুখের মধ্যে জিভটা তাঁহার এমনি আড়ষ্ট হইয়া গেল যে কথা বাহির হইল না।

বিলাস একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া ধমক দিয়া কহিল, একেবারে যে ভিজেবেড়ালটি হয়ে গেলেন? বলি জানেন কিছু?

চাকরির ভয় যে ভারাক্রান্ত দরিদ্রকে কিরূপ হীন করিয়া ফেলে, তাহা দেখিলে ক্লেশবোধ হয়। দয়াল চমকিয়া উঠিয়া অস্ফুট-স্বরে কহিলেন, আজ্ঞে হাঁ, আমিই এনেচি।

ওঃ—তাই বটে! কোথায় পেলেন সেটাকে?

দয়াল তখন জড়াইয়া জড়াইয়া কোন মতে ব্যাপারটা বিবৃত করিলেন।

বিলাস স্তব্ধভাবে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া কহিল, গেল বছরের হিসাবটা আপনাকে সারতে বলেছিলাম, সেটা সারা হয়েছে?

দয়াল বিবর্ণমুখে কহিলেন, আজ্ঞে, দু’দিনের মধ্যেই সেরে ফেলব।

হয়নি কেন?

বাড়িতে ভারী বিপদ যাচ্ছিল, রাঁধতে হতো—আসতেই পারিনি।

প্রত্যুত্তরে বিলাস কুৎসিত কটুকণ্ঠে দয়ালের জড়িমার নকল করিয়া হাত নাড়িয়া বলিল, আসতেই পারিনি! তবে আর কি, আমাকে রাজা করেছেন! বলিয়া তীব্রস্বরে কহিল, আমি তখনই বাবাকে বলেছিলাম, এ সব বুড়ো-হাবড়া নিয়ে আমার কাজ চলবে না।

এতক্ষণ পরে বিজয়া মুখ ফিরাইয়া চাহিল। তাহার মুখের ভাব প্রশান্ত, গম্ভীর; কিন্তু দুই চোখ দিয়া যেন আগুন বাহির হইতেছিল। অনুচ্চ কঠিন-কণ্ঠে কহিল, দয়ালবাবুকে এখানে কে এনেচে জানেন? আপনার বাবা নন—আমি।

বিলাস থমকিয়া গেল। তাহার এরূপ কণ্ঠস্বরও সে আর কখনো শুনে নাই, এরূপ চোখের চাহনিও আর কখন দেখে নাই। কিন্তু নত হইবার পাত্র সে নয়। তাই পলকমাত্র স্থির থাকিয়া জবাব দিল, যেই আনুক, আমার জানবার দরকার নেই। আমি কাজ চাই, কাজের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ।

বিজয়া কহিল, যাঁর বাড়িতে বিপদ তিনি কি করে কাজ করতে আসবেন?

বিলাস উদ্ধতভাবে বলিল, অমন সবাই বিপদের দোহাই পাড়ে। কিন্তু সে শুনতে গেলে ত আমার চলে না! আমি দরকারী কাজ সেরে রাখতে হুকুম দিয়েছিলাম, হয়নি কেন সেই কৈফিয়ত চাই। বিপদের খবর জানতে চাইনে।

বিজয়ার ওষ্ঠাধর কাঁপিতে লাগিল। কহিল, সবাই মিথ্যাবাদী নয়—সবাই মিথ্যা বিপদের দোহাই দেয় না; অন্ততঃ মন্দিরের আচার্য দেয় না। সে যাক, কিন্তু, আপনাকে জিজ্ঞাসা করি আমি, যখন জানেন, দরকারী কাজ হওয়া চাই-ই, তখন নিজে কেন সেরে রাখেন নি? আপনি কেন চারদিন কাজ কামাই করলেন? কি বিপদ হয়েছিল আপনার শুনি?

বিলাস বিস্ময়ে হতবুদ্ধিপ্রায় হইয়া কহিল, আমি নিজে খাতা সেরে রাখব! আমি কামাই করলাম কেন!

বিজয়া কহিল, হাঁ তাই। মাসে মাসে দু’শ টাকা মাইনে আপনি নেন। সে টাকা ত আমি শুধু শুধু আপনাকে দিইনে, কাজ করবার জন্যেই দিই।

বিলাস কলের পুতুলের মত কেবল কহিল, আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?

অসহ্য ক্রোধে বিজয়ার প্রায় হিতাহিত-জ্ঞান লোপ হইয়াছিল; সে তীব্রতর কণ্ঠে উত্তর দিল, কাজ করবার জন্য যাকে মাইনে দিতে হয় তাকে ও-ছাড়া আর কি বলে? আপনার অসংখ্য উৎপাত আমি নিঃশব্দে সয়ে এসেছি; কিন্তু যত সহ্য করেচি, অন্যায় উপদ্রব ততই বেড়ে গেছে। যান, নীচে যান। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ ছাড়া আজ থেকে আপনার সঙ্গে আর আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে, ঠিক সেই নিয়মে কাজ করতে পারেন করবেন, নইলে আপনাকে আমি জবাব দিলুম, আমার কাছারিতে আর ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।

বিলাস লাফাইয়া উঠিয়া দক্ষিণ হস্তের তর্জনী কম্পিত করিতে করিতে চীৎকার করিয়া বলিল, তোমার এত সাহস!

বিজয়া কহিল, দুঃসাহস আমার নয়, আপনার। আমার স্টেটেই চাকরি করবেন, আর আমারই উপর আমারই উপর অত্যাচার করবেন! আমাকে ‘তুমি’ বলবার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে? আমার চাকরকে আমারই বাড়িতে জবাব দেবার, আমার অতিথিকে আমারই চোখের সামনে অপমান করবার এ সকল স্পর্ধা কোথা থেকে আপনার জন্মাল?

0 Shares