দত্তা

আর একটা কথা—বৃদ্ধের সকল অনুরোধ উপরোধ আন্দোলন আলোচনার মধ্যে যে ইঙ্গিতটা সকলের চেয়ে গোপন থাকিয়াও সর্বাপেক্ষা পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল সেটা বিলাসের অসীম ভালবাসা এবং ইহারই অবশ্যম্ভাবী ফল—প্রবল ঈর্ষা।

এই জিনিসটা বিজয়ার নিজের কাছেও অজ্ঞাত ছিল, তা নয়; কিন্তু বাহিরের আলোড়নে তাহা যেন নূতন তরঙ্গ তুলিয়া তাহার বুকে আসিয়া লাগিল। এতদিন যাহা শুধু তাহার হৃদয়ের তলদেশেই থিতাইয়া পড়িয়াছিল, তাহাই বাহিরের আঘাতে ফুলিয়া উঠিয়া হৃদয়ের উপরে ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। তাই রাসবিহারী বহুক্ষণ চলিয়া গেলেও তাঁহার আলাপের ঝঙ্কার দুই কানের মধ্যে লইয়া বিজয়া তেমনি নিঃশব্দে জানালার বাহিরে চাহিয়া বিভোর হইয়া বসিয়া রহিল। ঈর্ষা বস্তুটা সংসারে চিরদিনই নিন্দিত সত্য, তথাপি সেই নিন্দিত দ্রব্যটা আজ বিজয়ার চক্ষে বিলাসের অনেকখানি মলিনতা ফিকা করিয়া ফেলিল, এবং যাহাদিগকে প্রতিপক্ষ কল্পনা করিয়া এই দুটি পিতাপুত্রের সহস্র রকমের প্রতিহিংসার বিভীষিকা কাল হইতে তাহার প্রত্যেক মুহূর্ত নিরুদ্যম ও নির্জীব করিয়া আনিতেছিল, আজ আবার তাহাদিগকেই আপনার জন ভাবিতে পাইয়া যে যেন হাঁপ ফেলিয়া বাঁচিল।

কালীপদ আসিয়া বলিল, মাঠান, তাহলে এখন আমার যাওয়া হল না ব’লে বাড়িতে আর একখানা চিঠি লিখিয়ে দিই?

বিজয়া ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, আচ্ছা—

কালীপদ চলিয়া যাইতেছিল, বিজয়া তাহাকে আহ্বান করিয়া সলজ্জদ্বিধাভরে কহিল, না হয় আমি বলি কি কালীপদ, চিঠি যখন লিখে দেওয়াই হয়েছে, তখন মাসখানেকের জন্যে একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এস। ওঁর কথাটাও থাক, তোমার একবার বাড়ি যাওয়া—অনেকদিন ত যাওনি, কি বল?

কালীপদ মনে মনে আশ্চর্য হইল, কিন্তু সম্মত হইয়া কহিল, আচ্ছা, আমি মাস-খানেক ঘুরেই আসি মাঠান। এই বলিয়া সে প্রস্থান করিলে এই দুর্বলতায় বিজয়ার কি একরকম যেন ভারী লজ্জা করিতে লাগিল; কিন্তু তাই বলিয়া তাহাকে আর একবার ফিরাইয়া ডাকিয়া নিষেধ করিয়া দিতেও পারিল না। সেও লজ্জা করিতে লাগিল।

বিংশ পরিচ্ছেদ

প্রাচীরের ধারে যে কয়টা ঘর লইয়া বিজয়ার জমিদারির কাজকর্ম চলিত, তাহার সম্মুখেই এক সার ঘন-পল্লবের লিচুগাছ থাকায় বসতবাটীর উপরের বারান্দা হইতে ঘরগুলার কিছুই প্রায় দেখা যাইত না। তা ছাড়া, পূর্বদিকের প্রাচীরের গায়ে যে ছোট দরজাটা ছিল তাহা দিয়া যাতায়াত করিলে কর্মচারীদের কে কখন আসিতেছে যাইতেছে তাহার কিছুই জানিবার জো ছিল না।

সেই অবধি দয়াল বাড়ির মধ্যে আর আসেন নাই। কাজ করিতে কাছারিতে আসেন কি না, সঙ্কোচবশতঃ সে সংবাদও বিজয়া লয় নাই, আর বিলাসবিহারী যে এদিক মাড়ান না তাহা কাহাকেও কোন প্রশ্ন না করিয়াই সে স্বতঃসিদ্ধের মত মানিয়া লইয়াছিল। মধ্যে শুধু একদিন সকালে মিনিট-দশেকের জন্য রাসবিহারী দেখা করিতে আসিয়াছিলেন, কিন্তু সাধারণভাবে দুই-চারিটা অসুখের কথাবার্তা ছাড়া আর কোন কথাই হয় নাই।

মানুষের অন্তরের কথা অন্তর্যামীই জানুন, কিন্তু মুখের যেটুকু প্রসন্নতা এবং সৌহার্দ্য লইয়া সেদিন তিনি পুত্রের বিরুদ্ধে ওকালতি করিয়া গিয়াছিলেন, কোন অজ্ঞাত কারণে সে ভাব তাঁহার পরিবর্তিত হইয়াছে নিশ্চয় বুঝিয়া বিজয়া উদ্বেগ অনুভব করিয়াছিল। মোটের উপর সবটুকু জড়াইয়া একটা অতৃপ্তি অস্বস্তির মধ্যেই তাহার দিন কাটিতেছিল। এমন করিয়া আরও কয়েকদিন কাটিয়া গেল।

আজ অপরাহ্নবেলায় বিজয়া বাটীর কাছাকাছি নদীর তীরে একটুখানি বেড়াইবার জন্য একাকী বাহির হইতেছিল, বৃদ্ধ নায়েবমশাই একতাড়া খাতাপত্র বগলে লইয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল এবং ভক্তিভরে নমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মা কি কোথাও বার হচ্চেন? কানাই সিং কৈ?

বিজয়া হাসিমুখে বলিল, এই কাছেই একটুখানি নদীর তীরে ঘুরে আসতে যাচ্চি। দরোয়ানের দরকার নেই। আমাকে কি আপনার কোন আবশ্যক আছে?

নায়ের কহিল, একটু ছিল মা। না হয় কালকেই হবে। বলিয়া সে ফিরিবার উপক্রম করিতেই বিজয়া পুনরায় হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, দরকার যদি একটুখানিই হয় ত আজই বলুন না। অত খাতাপত্র নিয়ে কোথায় চলেছেন?

নায়েব সেইগুলাই দেখাইয়া কহিল, আপনার কাছেই এসেছি। গত বছরের হিসাবটা সারা হয়েচে—মিলিয়ে দেখে একটা দস্তখত করে দিতে হবে। তা ছাড়া, ছোটবাবু হুকুম দিয়েছেন হাল সনের জমাখরচটাতেও রোজ-তারিখে আপনার সই নেওয়া চাই।

বিজয়া অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া ফিরিয়া আসিয়া বাহিরের ঘরে বসিল। নায়েব সঙ্গে আসিয়া টেবিলের উপর সেগুলা রাখিয়া দিয়া একখানা খুলিবার উদ্যোগ করিতেই বিজয়া বাধা দিয়া প্রশ্ন করিল, এ হুকুম ছোটবাবু কবে দিলেন?

আজ সকালে দিয়েছেন।

আজ সকালে তিনি এসেছিলেন?

তিনি ত রোজই আসেন।

এখন কাছারি-ঘরে আছেন?

নায়েব ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি এইমাত্র চলে গেলেন।

সেদিনের হাঙ্গামা কোন আমলারই অবিদিত ছিল না। নায়েব বিজয়ার প্রশ্নের ইঙ্গিত বুঝিয়া ধীরে ধীরে অনেক কথাই কহিল। বিলাসবিহারী প্রত্যহ ঠিক এগারোটার সময় কাছারিতে উপস্থিত হন; কাহারও সহিত বিশেষ কোন কথাবার্তা কহেন না, নিজের মনে কাজ করিয়া পাঁচটার সময় বাড়ি ফিরিয়া যান। দয়ালবাবুর বাটীতে অসুখ আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তাঁহার আসিবার আবশ্যকতা নাই বলিয়া তাঁহাকে ছুটি দিয়াছেন ইত্যাদি অনেক ব্যাপার মনিবের গোচর করিল।

বিজয়া লজ্জিতমুখে নীরবে সমস্ত কাহিনী শুনিয়া বুঝিল, বিলাস এই নূতন নিয়ম নিদারুণ অভিমানবশেই প্রবর্তিত করিয়াছে। তথাপি এমন কথাও কহিল না যে, এতদিন যাঁহার সই লইয়া কাজ চলিতেছিল, আজও চলিবে—তাহার নিজের সই অনাবশ্যক। বরঞ্চ বলিল, এগুলো থাক, কাল সকালে একবার এসে আমার সই নিয়ে যাবেন। বলিয়া নায়েবকে বিদায় দিয়া সেইখানেই স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। বাহিরে দিনের আলো ক্রমশঃ নিবিয়া আসিল, এবং প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে শাঁখের শব্দে সন্ধ্যার শান্ত আকাশ চঞ্চল হইয়া উঠিল, তথাপি তাহার উঠিবার লক্ষণ দেখা গেল না। আরও কতক্ষণ যে সে এমনি একভাবে বসিয়া কাটাইত বলা যায় না; কিন্তু বেহারা আলো হাতে করিয়া ঘরে ঢুকিয়াই হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কর্ত্রীকে একাকী দেখিয়া যেমন চমকাইয়া উঠিল বিজয়া নিজেও তেমনি লজ্জা পাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং বাহিরে আসিয়াই একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেল।

যে জিনিসটি তাহার চোখে পড়িল, সে তাহার সুদূর কল্পনারও অতীত। সে কি কোন কারণে কোন ছলেও আর এ বাড়িতে পা দিতে পারে? অথচ সেই প্রায়ান্ধকারেও স্পষ্ট দেখা গেল সেদিনের সেই সাহেবটিই হ্যাট্‌-সমেত প্রায় সাড়ে-ছয় ফুট দীর্ঘদেহ লইয়া গেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে এবং সাধারণ বাঙালীর অন্ততঃ আড়াই গুণ লম্বা পা ফেলিয়া এই দিকেই আসিতেছে।

0 Shares