দত্তা

আজ আর তাহাকে পুলিশ কর্মচারী বলিয়া ভুল হয় নাই। কিন্তু আনন্দের সেই অপরিমিত দীপ্ত রেখাটিকে যে তাহার বিশ্বজোড়া ভয় ও নিরাশার অন্ধকার চক্ষের পলকে গিলিয়া ফেলিল। গাছপালায় ঘেরা, আঁকাবাঁকা পথের মাঝে মাঝে তাহার দেহ অদৃশ্য হইতে লাগিল বটে, কিন্তু পথের কাঁকরে তাহার জুতার শব্দ ক্রমেই সন্নিকটবর্তী হইতে লাগিল। বিজয়া মনে মনে বুঝিল, তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া বসানো ভয়ানক অন্যায়, কিন্তু দ্বারের বাহির হইতে অবহেলায় বিদায় দেওয়াও যে অসাধ্য!

এই অবস্থা-সঙ্কট হইতে পরিত্রাণের উপায় কোন দিকে খুঁজিয়া না পাইয়া, যে মুহূর্তে পথের বাঁকে কামিনী গাছের পাশে সেই দীর্ঘ ঋজুদেহ তাহার সুমুখে আসিয়া পড়িল, সেই মুহূর্তেই সে পিছন ফিরিয়া দ্রুতবেগে তাহার ঘরের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করিল। বৃদ্ধ নায়েব কিছুই লক্ষ্য করে নাই, নিজের মনে চলিয়াছিল; অকস্মাৎ সাহেব দেখিয়া ত্রস্ত হইয়া উঠিল।

কিন্তু সাহেবের প্রশ্নে চিনিতে পারিয়া আশ্বস্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন হইয়া জবাব দিল, হাঁ, উনি বাহিরের ঘরেই আছেন, বলিয়া চলিয়া গেল। প্রশ্ন এবং উত্তর দুই-ই বিজয়ার কানে গেল। ক্ষণেক পরেই ঘরে ঢুকিয়া নরেন্দ্র নমস্কার করিল। লাঠি এবং টুপি টেবিলের উপর রাখিয়া সহাস্যে কহিল, এই যে দেখচি আমার ওষুধে চমৎকার ফল হয়েছে। বাঃ!

ক্ষণেক পূর্বেই বিজয়া মনে মনে ভাবিয়াছিল, আজ বুঝি সে চোখ তুলিয়া চাহিতেও পারিবে না—একটা কথার জবাব পর্যন্ত তাহার মুখে ফুটিবে না। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এই লোকটির কেবল কণ্ঠস্বর শুনিবামাত্রই শুধু যে তাহার দ্বিধা-সঙ্কোচই ভোজবাজির মত অন্তর্হিত হইয়া গেল তাই নয়, তাহার হৃদয়ের অন্ধকার, অজ্ঞাত কোণে সুরবাঁধা বীণার তারের উপর কে যেন না জানিয়া আঙুল বুলাইয়া দিল; এবং একমুহূর্তেই বিজয়া তাহার সমস্ত বিষাদ বিস্মৃত হইয়া বলিয়া উঠিল, কি করে জানলেন? আমাকে দেখে, না কারো কাছে শুনে?

নরেন্দ্র বলিল, শুনে। কেন, আপনি কি দয়ালবাবুর কাছে শোনেন নি যে, আমার ওষুধ খেতে পর্যন্ত হয় না, শুধু প্রেস্‌ক্রিপশানটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলেও অর্ধেক কাজ হয়। বলিয়া নিজের রসিকতায় প্রফুল্ল হইয়া অট্টহাস্যে ঘর কাঁপাইয়া তুলিল।

বিজয়া বুঝিল, সে দয়ালের কাছে সমস্ত শুনিয়াই তবে আজ ব্যঙ্গ করিতে আসিয়াছে। তাই এই অসঙ্গত উচ্চহাস্যে মনে মনে রাগ করিয়া ঠোক্কর দিয়া বলিল, ওঃ—তাই বুঝি বাকি অর্ধেকটা সারাবার জন্যে দয়া করে আবার ওষুধ লিখে দিতে এসেছেন?

খোঁচা খাইয়া নরেনের হাসি থামিল। কহিল, বাস্তবিক বলচি, এ এক আচ্ছা তামাশা।

বিজয়া কহিল, তাই বুঝি এত খুশী হয়েছেন?

নরেনের মুখ গম্ভীর হইল। কহিল, খুশি হয়েছি! একেবারে না। অবশ্য এ কথা একেবারে অস্বীকার করতে পারিনে যে, শুনেই প্রথমে একটু আমোদ বোধ করেছিলাম, কিন্তু তার পরেই বাস্তবিক দুঃখিত হয়েচি। বিলাসবাবুর মেজাজটা তেমন ভাল নয় সত্যি—অকারণে খামকা রেগে উঠে পরকে অপমান করে বসেন, কিন্তু তাই বলে আপনিও যে অসহিষ্ণু হয়ে কতকগুলো অপমানের কথা বলে ফেলবেন সেও ত ভাল নয়। ভেবে দেখুন দিকি, কথাটা প্রকাশ পেলে ভবিষ্যতে কতবড় একটা লজ্জা এবং ক্ষোভের কারণ হবে। আমাকে বিশ্বাস করুন, বাস্তবিকই শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছি। আমার জন্যে আপনাদের মধ্যে এরূপ একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটায়—

এই লোকটির হৃদয়ের পবিত্রতায় বিজয়া মনে মনে মুগ্ধ হইয়া গেল। তথাপি পরিহাসের ভঙ্গীতে কহিল, কিন্তু হাসিও চাপতে পাচ্ছেন না। বলিয়া নিজেও হাসিয়া ফেলিল।

নরেন জোর করিয়া এবার ভয়ানক গম্ভীর হইয়া কহিল, কেন আপনি বার বার তাই মনে করচেন? যথার্থই আমি অতিশয় ক্ষুণ্ণ হয়েচি। কিন্তু তখন আমি আপনাদের সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া পুনরায় কহিল, সেই দিনই নীচে তাঁর বাবা সমস্ত কথা জানিয়ে বললেন, ঈর্ষা! দয়ালবাবুও কাল তাই বললেন। শুনে আমি কি লজ্জা পেয়েচি বলতে পারিনে। কিন্তু এত লোকের মধ্যে আমাকে ঈর্ষা করবার মত কি আমার আছে আমি তাও ত ভেবে পাইনে। আপনারা ব্রাহ্মসমাজের,আবশ্যক হলে সকলের সঙ্গেই কথা কন—আমার সঙ্গেও কয়েছেন। এতে এমন কি দোষ তিনি দেখতে পেয়েছেন, আমি ত খুঁজে পাইনে। যাই হোক, আমাকে আপনারা মাপ করবেন—আর ওই বাংলায় কি বলে——অভি—অভিনন্দন! আমিও আপনাকে তাই জানিয়ে যাচ্ছি—আপনারা সুখী হোন।

সে নিজের আচরণের উল্লেখ করিতে গিয়াও যে বিজয়ার সেদিনের আচরণ সম্বন্ধে লেশমাত্র ইঙ্গিত করে নাই, বিজয়া তাহা লক্ষ্য করিয়াছিল। কিন্তু তাহার শেষ কথাটায় বিজয়ার দুই চক্ষু অকস্মাৎ অশ্রুপ্লাবিত হইয়া গেল। সে ঘাড় ফিরাইয়া কোনমতে চোখের জল সামলাইতে লাগিল।

প্রত্যুত্তরের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই নরেন জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, সেদিন কালীপদকে দিয়ে হঠাৎ স্টেশনে মাইক্রস্কোপটা পাঠিয়েছিলেন কেন বলুন ত?

বিজয়া রুদ্ধস্বর পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, আপনার জিনিস আপনি নিজেই ত ফিরে চেয়েছিলেন।

নরেন বলিল, তা বটে; কিন্তু দামের কথাটা ত তাকে দিয়ে বলে পাঠান নি? তা হলে ত আমার—

বিজয়া কহিল, না। জ্বরের উপর আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু সে ভুলের শাস্তিও ত আপনি আমাকে কম দেননি!

নরেন লজ্জিত হইয়া কহিল, কিন্তু কালীপদ যে বললে—

বিজয়া বাধা দিয়া বলিল, সে আমি শুনেচি। কিন্তু যাই কেন না সে বলুক, আপনাকে উপহার দেবার মত স্পর্ধা আমার থাকতে পারে—এমন কথা কি করে আপনি বিশ্বাস করলেন? আর সত্যিই তাই যদি করে থাকি, নিজের হাতে কেন শাস্তি দিলেন না? কেন চাকরকে দিয়ে আমার অপমান করলেন? আপনার আমি কি করেছিলুম? বলিতে বলিতেই তাহার গলা যেন ভাঙ্গিয়া আসিল।

নরেন লজ্জিত এবং অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া বিজয়ার মুখের পানে চাহিয়া দেখিল, সে ঘাড় ফিরাইয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া আছে। মুখ তাহার চোখে পড়িল না, চোখে পড়িল শুধু তাহার গ্রীবার উপর হীরার কণ্ঠীর একটুখানি—দীপালোকে বিচিত্র রশ্মি প্রতিফলিত করিতেছে। উভয়েই কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর নরেন্দ্র ক্ষুণ্ণকণ্ঠে ধীরে ধীরে কহিল, কাজটা যে আমার ভাল হয়নি সে আমি তখনি টের পেয়েছিলাম, কিন্তু ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছিল। কালীপদর দোষ কি?

তার ওপর রাগ করা কিছুতেই আমার উচিত হয়নি। আবার একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, দেখুন, ঐ ঈর্ষা জিনিসটা যে কত মন্দ এবার আমি ভাল করেই টের পেয়েছি। ও যে শুধু নিজের ঝোঁকেই বেড়ে চলে তাই নয়; সংক্রামক ব্যাধির মত অপরকেও আক্রমণ করতে ছাড়ে না। এখন ত আমি বেশ জানি, আমাকে ঈর্ষা করার মত ভ্রম বিলাসবাবুর আর কিছু হতেই পারে না। তাঁর বাবাও সে জন্যে লজ্জা এবং দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আপনি শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন যে, আমার নিজেরও তখন বড় কম ভুল হয়নি।

0 Shares