দত্তা

বিজয়া মুখ ফিরাইয়া প্রশ্ন করিল, আপনার ভুল কি-রকম?

নরেন অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল, আমাকে নিরর্থক ও-রকম অপমান করায় আপনি যে সত্যিই ক্লেশ বোধ করেছিলেন, সে ত আপনার কথা শুনে সবাই বুঝতে পেরেছিল। তার উপর রাসবিহারীবাবু যখন নীচে গিয়ে তাঁর ছেলের ওই ঈর্ষার কথাটা তুলে আমাকে দুঃখ করতে নিষেধ করলেন, তখন হঠাৎ দুঃখটা আমার যেন বেড়ে গেল। কেবলি মনে হতে লাগল নিশ্চয় কিছু কারণ আছে; নইলে শুধু শুধু কেউ কারুকে হিংসা করে না। আপনাকে আজ আমি যথার্থ বলচি, তারপর আট-দশদিন বোধ করি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তেইশ ঘণ্টা শুধু আপনাকেই ভাবতুম। আর আপনার অসুখের সেই কথাগুলোই মনে পড়ত। তাই ত বলছিলুম—এ কি ভয়ানক ছোঁয়াচে রোগ। কাজকর্ম চুলোয় গেল—দিবারাত্রি আপনার কথাই শুধু মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। এর কি আবশ্যক ছিল বলুন ত! আর শুধু কি তাই? দু-তিনদিন এই পথে অনর্থক হেঁটে গেছি কেবল আপনাকে দেখবার জন্যে। দিন-কতক সে আচ্ছা পাগলা ভূত আমার ঘাড়ে চেপেছিল! বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

বিজয়া মুখ ফিরাইয়া চাহিল না, একটা কথার জবাব দিল না, নীরবে উঠিয়া পাশের দরজা দিয়া বাটীর ভিতরে চলিয়া গেল; এবং আর একজনের মুখের হাসি চক্ষের পলকে নিবিয়া গেল। যে পথে সে বাহির হইয়া গেল, সেই অন্ধকারের মধ্যেই নির্নিমেষে চাহিয়া নরেন হতবুদ্ধি হইয়া শুধু ভাবিতে লাগিল, না জানিয়া এ আবার কোন্‌ নূতন অপরাধের সে সৃষ্টি করিয়া বসিল!

সুতরাং বেহারা আসিয়া যখন কহিল, আপনি যাবেন না, আপনার চা তৈরি হচ্চে—তখন নরেন ব্যস্ত হইয়াই বলিয়া উঠিল, আমার চা দরকার নেই ত।

কিন্তু মা আপনাকে বসতে বলে দিলেন, বলিয়া বেহারা চলিয়া গেল। ইহাও নরেন্দ্রকে কম আশ্চর্য করিল না।

প্রায় মিনিট-পনের পরে চাকরের হাতে চা এবং নিজের হাতে জলখাবারের থালা লইয়া বিজয়া প্রবেশ করিল। সে যে সহস্র চেষ্টা করিয়াও তাহার মুখের উপর হইতে রোদনের ছায়া মুছিয়া ফেলিতে পারে নাই তাহা অস্পষ্ট দীপালোকে হয়ত আর কাহারও চোখে ধরা পড়িত না—কিন্তু ডাক্তারের অভ্যস্ত চক্ষুকে সে ফাঁকি দিতে পারিল না, কিন্তু এবার আর সে সহসা কোন মন্তব্য প্রকাশ করিয়া বসিল না। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সে অনেক বিষয়েই সতর্ক হইতে শিখিয়াছিল। যেদিন প্রায় অপরিচিত হইয়াও অন্তরের সামান্য কৌতূহল ও ইচ্ছার চাঞ্চল্য দমন করিতে না পারিয়া হাত দিয়া বিজয়ার মুখ তুলিয়া ধরিয়াছিল, আজ আর তাহার সেদিন ছিল না। তাই সে চুপ করিয়াই রহিল।

চাকর টেবিলের উপর চা রাখিয়া দিয়া চলিয়া গেল। বিজয়া তাহারই পাশে খাবারের থালা রাখিয়া নিজের জায়গায় গিয়া বসিল। নরেন তৎক্ষণাৎ থালাটা কাছে টানিয়া লইয়া এমনিভাবে আহারে মন দিল যেন এই জন্যই সে প্রতীক্ষা করিতেছিল।

মিনিট পাঁচ-ছয় নিঃশব্দে কাটিবার পর বিজয়াই প্রথমে কথা কহিল। নীরবতার গোপন ভার আর সে সহিতে না পারিয়া হঠাৎ যেন জোর করিয়াই হাসিয়া বলিল, কৈ, আপনার সেই পাগলা ভূতটার কথা শেষ করলেন না?

নরেন বোধ করি অন্য কথা ভাবিতেছিল, তাই সে মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কার কথা বলচেন?

বিজয়া কহিল, সেই পাগলা ভূতটা, যে দিন-কতক আপনার কাঁধে চেপেছিল, সে নেবে গেছে ত?

এবার নরেনও হাসিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ গেছে।

বিজয়া কহিল, যাক। তাহলে বেঁচে গেছেন বলুন। নইলে আরও কত দিন যে আপনাকে ঘোড়দৌড় করিয়ে নিয়ে বেড়াত কে জানে!

নরেন চায়ের পেয়ালা মুখে তুলিয়া লইয়া শুধু বলিল, হাঁ।

বিজয়া পুনরায় ভাল কিছু একটা বলিতে চাহিল বটে, কিন্তু হঠাৎ আর কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কেবল আকণ্ঠ উচ্ছ্বসিত দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া লইয়া চুপ করিয়া গেল। পরের ঘাড়ের ভূত ছাড়ার আনন্দের জের টানিয়া চলা কিছুতেই আর তাহার শক্তিতে কুলাইল না।

আবার কিছুক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত ঘরটা স্তব্ধ হইয়া রহিল। নরেন ধীরেসুস্থে চায়ের বাটিটা নিঃশেষ করিয়া টেবিলের উপর রাখিয়া দিল; পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া বলিল, আর দশ মিনিট সময় আছে, আমি চললুম।

বিজয়া মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিল, কলকাতায় ফিরে যাবার এই বুঝি শেষ ট্রেন?

নরেন উঠিয়া দাঁড়াইয়া টুপিটা মাথায় দিয়া বলিল, আরও একটা আছে বটে, সে কিন্তু ঘণ্টা-দেড়েক পরে। চললুম—নমস্কার। বলিয়া লাঠিটা তুলিয়া একটু দ্রুতপদেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

একবিংশ পরিচ্ছেদ

বিলাস যথাসময়ে কাছারিতে আসিয়া নিজের কাজ করিয়া বাড়ি চলিয়া যাইত; নিতান্ত প্রয়োজন হইলে কর্মচারী পাঠাইয়া বিজয়ার মত লইত, কিন্তু আপনি আসিত না। তাহাকে ডাকাইয়া না পাঠাইলে যে নিজে যাচিয়া আসিবে না, ইহাও বিজয়া বুঝিয়াছিল। অথচ তাহার আচরণের মধ্যে অনুতাপ এবং আহত অভিমানের বেদনা ভিন্ন ক্রোধের জ্বালা প্রকাশ পাইত না বলিয়া বিজয়ার নিজেরও রাগ পড়িয়া গিয়াছিল।

বরঞ্চ, আপনার ব্যবহারের মধ্যেই কেমন যেন একটা নাটক অভিনয়ের আভাস অনুভব করিয়া তাহার মাঝে মাঝে ভারী লজ্জা করিত। প্রায়ই মনে হইত, কত লোকেই না জানি এই লইয়া হাসি-তামাশা করিতেছে। তা ছাড়া যে লোক সকলের চক্ষেই এতদিন সর্বময় হইয়া বিরাজ করিতেছিল, বিশেষ করিয়া জমিদারির কাজে-অকাজে সে যাহাদিগকে শাসন করিয়া শত্রু করিয়া তুলিয়াছে, তাহাদের সকলের কাছে তাহাকে অকস্মাৎ এতখানি ছোট করিয়া দিয়া বিজয়া আপনার নিভৃত হৃদয়ে সত্যকার ব্যথা অনুভব করিতেছিল। পূর্বের অবস্থাকে ফিরাইয়া না আনিয়া শুধু এই ঘটনাকে কোনমতে সে যদি সম্পূর্ণ ‘না’ করিয়া দিতে পারিত তাহা হইলে বাঁচিয়া যাইত। এমনি যখন তাহার মনের ভাব, সেই সময় হঠাৎ একদিন বিকালে কাছারির বেহারা আসিয়া জানাইল বিলাসবাবু দেখা করিতে চান।

ব্যাপারটা একেবারে নূতন। বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই কহিল, আসতে বল। তাহার মনের ভিতরটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় দুলিতে লাগিল; কিন্তু বিলাস প্রবেশ করিতেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া শান্তভাবে নমস্কার করিয়া কহিল, আসুন। বিলাস আসন গ্রহণ করিয়া বলিল, কাজের ভিড়ে আসতে পারিনে, তোমার শরীর ভাল আছে?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

সেই ওষুধটাই চলছে?

বিজয়া ইহার উত্তর দিল না, কিন্তু বিলাসও প্রশ্নের পুনরুক্তি না করিয়া অন্য কথা কহিল। বলিল, কাল নব-বৎসরের নূতন দিন—আমার ইচ্ছা হয় সকলকে একত্র করে কাল সকালবেলা একটু ভগবানের নাম করা হয়।

সে যে তাহার প্রশ্ন লইয়া পীড়াপীড়ি করিল না, কেবল ইহাতেই বিজয়ার মনের উপর হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। সে খুশী হইয়া বলিয়া উঠিল, এ ত খুব ভাল কথা।

বিলাস বলিল, কিন্তু নানা কারণে মন্দিরে যাওয়ার সুবিধে হলো না। যদি তোমার অমত না হয় ত আমি বলি এইখানেই—

0 Shares