দত্তা

নরেন গভীর বিস্ময়ভরে বলিল, এর মানে? কে বলেছে আপনি মন্দ লোক, কে বলেছে ও-সব কথা আপনাকে?

বিজয়ার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল; কহিল, আপনি বলেছেন। কেন নলিনীর সামনে আমাকে অমন করে অপমান করলেন? আমাকেই অপমান করলেন, আবার আমাকেই শাস্তি দিতে না খেয়ে চলে যাচ্ছেন? কি করেছি আপনার আমি? বলিতে বলিতেই তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল। বোধ করি, তাহাই সামলাইবার জন্য সে তৎক্ষণাৎ ও-দিকের জানালায় গিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল। নরেন হতবুদ্ধির মত বাক্‌শূন্য হইয়া চাহিয়া রহিল। এ অভিযোগের কোথায় কি যে জবাব আছে তাহাও যেন খুঁজিয়া পাইল না, ইহার কারণই বা কি তাহাও তেমনি ভাবিয়া পাইল না।

স্নানের জল প্রভৃতি দেওয়া হইয়াছে বেহারা জানাইয়া গেলে বিজয়া ফিরিয়া আসিয়া শান্তভাবে শুধু কহিল, আর দেরি করবেন না, যান।

স্নান সারিয়া নরেন্দ্র আহারে বসিল। বিজয়া একখানা পাখা হাতে করিয়া তাহার অদূরে আসিয়া যখন উপবেশন করিল, তখন অত্যন্ত সংগোপনে তাহার সর্বাঙ্গ আলোড়িত করিয়া যেন লজ্জার ঝড় বহিয়া গেল। বাতাস করিতে উদ্যত দেখিয়া নরেন সঙ্কুচিত হইয়া কহিল, আমাকে হাওয়া করবার দরকার নেই, আপনি পাখাটা রেখে দিন।

বিজয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, আপনার দরকার না থাকলেও আমার দরকার আছে। বাবা বলতেন, মেয়েমানুষকে শুধু হাতে কখনও বসতে নেই।

নরেন জিজ্ঞাসা করিল, আপনার খাওয়াও ত হয়নি!

বিজয়া কহিল, না। পুরুষমানুষদের খাওয়া না হলে আমাদের খেতেও নেই।

নরেন খুশী হইয়া বলিল, আচ্ছা, ব্রাহ্ম হলেও ত আপনাদের আচার-ব্যবহার আমাদের মতই।

বিজয়া এ কথা বলিল না যে, অনেক ব্রাহ্মবাড়িতেই তাহা নয়, বরঞ্চ ঠিক উলটো, শুধু তাহার পিতাই কেবল এই-সকল হিন্দু-আচার নিজের বাড়িতে বজায় রাখিয়া গিয়াছিলেন। বরঞ্চ কহিল, এতে আশ্চর্য হবার ত কিছু নেই। আমরা বিলেত থেকেও আসিনি, কাবুল থেকেও আমাদের আচার-ব্যবহার আমদানী করে আনতে হয়নি। এ-রকম না হলেই বরং আশ্চর্য হবার কথা।

চাকর দ্বারের কাছে আসিয়া কহিল, মা, সরকারমশাই হিসেবের খাতা নিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন কি যেতে বলে দেব?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ, আজ আর আমার দেখবার সময় হবে না, তাঁকে কাল একবার আসতে বলে দাও।

ভৃত্য চলিয়া গেলে নরেন বিজয়ার মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কহিল, এইটি আমাকে সবচেয়ে বেশী আনন্দ দেয়।

কোন্‌টি?

চাকরদের মুখের এই ডাকটি। বলিয়া হাসিয়া কহিল, আপনি ব্রাহ্মমহিলাও বটে, আলোকপ্রাপ্তাও বটে, এবং বিশেষ করে বড়মানুষও বটে। এমনি আলোক-পাওয়া অনেক বাড়িতেই আমাকে আজকাল চিকিৎসা করতে যেতে হয়। তাঁদের চাকর-বাকরেরা মেয়েদের বলে ‘মেম-সাহেব’। সত্যিকারের মেম-সাহেবরা এঁদের যে চক্ষে দেখে, তা জানেন বলেই বোধ করি মাইনে-করা চাকরদের দিয়ে ‘মেম-সাহেব’ বলিয়ে নিয়ে আত্মমর্যাদা বজায় রাখেন। বলিয়া প্রকাণ্ড একটা পরিহাসের মত হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া অট্টহাস্যে বাড়িটা পরিপূর্ণ করিয়া দিল। বিজয়া নিজেও হাসিয়া ফেলিল। নরেনের হাসি থামিলে সে পুনরায় কহিল, বাড়ির দাসী-চাকরের মুখের মাতৃ-সম্বোধনের চেয়ে ‘মেম-সাহেব’ ডাকটা যেন বেশী ইজ্জতের! প্রথম দিন আমি বুঝতেই পারিনি বেহারাটা ‘মেম’ বলে কাকে? চাকরটা কি বললে জানেন? বলে, ‘আমি অনেক সাহেব-বাড়িতে চাকরি করেচি, সত্যকারের মেম-সাহেব কি, তা খুব জানি। কিন্তু, কি করব ডাক্তারবাবু? নতুন হিন্দুস্থানী দরোয়ানটা গিন্নীকে ‘মাইজী’ বলে ফেলেছিল বলে মেম-সাহেব তার একটাকা জরিমানা করে দিলেন। চাকরিটা যে বজায় রইল এই তার ভাগ্যি। এমনি রাগ। আচ্ছা, আপনি বোধ হয় এরকম অনেক দেখেছেন, না?

বিজয়া হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।

নরেন কহিল, আমাকে এইটে একদিন দেখতে হবে, এই সব মেম-সাহেবদের ছেলে-মেয়েরা মাকে মা বলে, না ‘মেম-সাহেব’ বলে ডাকে! বলিয়া নিজের রসিকতার আনন্দে আর একবার ঘর ফাটাইয়া তুলিবার আয়োজন করিল।

বিজয়া হাসিমুখে কহিল, খেয়ে-দেয়ে সমস্ত দিন ধরে পরচর্চা করে আমোদ করবেন, আমার আপত্তি নেই; কিন্তু আমাকে কি আজ খেতে দেবেন না?

নরেন লজ্জিতভাবে তাড়াতাড়ি দু-চার গ্রাস গিলিয়া লইয়াই সব ভুলিয়া গেল। কহিল, আমিও ত চার-পাঁচ বছর বিলেতে ছিলুম, কিন্তু এই দিশী-সাহেবরা—

বিজয়া তর্জনী তুলিয়া কৃত্রিম শাসন করার ভঙ্গীতে কহিল, আবার পরের নিন্দে!

আচ্ছা, আর নয়—বলিয়া সে পুনরায় আহারে মন দিয়াই কহিল, কিন্তু আর খেতে পাচ্ছিনে—

বিজয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, বাঃ—কিছুই ত খাননি। না, এখন উঠতে পাবেন না। আচ্ছা, না হয় পরের নিন্দে করতে করতেই অন্যমনস্ক হয়ে খান, আমি কিছু বলব না।

নরেন হাসিতে গিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া উঠিল। কহিল,আপনি এতেই বলছেন খাওয়া হল না—কিন্তু আমার কলকাতার রোজকার খাওয়া যদি দেখেন ত অবাক হয়ে যাবেন। দেখছেন না, এই ক’মাসের মধ্যেই কি রকম রোগা হয়ে গেছি। আমার বাসায় বামুন-ব্যাটা হয়েছে যেমন পাজী, তেমনি বদমাইশ জুটেছে চাকরটা। সাত-সকালে রেঁধে রেখে কোথায় যায় তার ঠিকানা নেই—আমার কোন দিন ফিরতে হয় দুটো, কোন দিন বা চারটে বেজে যায়।

সেই ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত—দুধ কোন দিন বা বেড়ালে খেয়ে যায়, কোন দিন বা জানালা দিয়ে কাক ঢুকে সমস্ত ছড়াছড়ি করে রাখে—সে দেখলেই ঘৃণা হয়। অর্ধেক দিন ত একেবারেই খাওয়া হয় না।

রাগে বিজয়ার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। কহিল, এমন সব চাকর-বাকরদের দূর করে দিতে পারেন না? নিজের বাসায় এত টাকা মাইনে পেয়েও যদি এত কষ্ট, তবে চাকরি করাই বা কেন?

নরেন কহিল, এক হিসাবে আপনার কথা সত্যি। একদিন বাক্স থেকে কে দু শ’ টাকা চুরি করে নিলে, একদিন নিজেই কোথায় একশ’ টাকার নোট হারিয়ে ফেললুম। অন্যমনস্ক লোকের ত পদে পদে বিপদ কিনা! একটুখানি থামিয়া কহিল, তবে নাকি দুঃখ-কষ্ট আমার অনেকদিন থেকেই সয়ে গেছে, তাই তেমন গায়ে লাগে না। শুধু অত্যন্ত ক্ষিদের উপর খাওয়ার কষ্টটা এক-একদিন যেন অসহ্য বোধ হয়।

বিজয়া মুখ নীচু করিয়া চুপ করিয়া রহিল। নরেন কহিতে লাগিল, বাস্তবিক, চাকরি আমার ভালও লাগে না, পারিও না। অভাব আমার খুবই সামান্য—আপনার মত কোন বড়লোক দু’বেলা চারটি খেতে দিত, আর নিজের কাজ নিয়ে থাকতে পারতুম ত আমি আর কিছুই চাইতুম না—কিন্তু, সে-রকম বড়লোক কি আর আছে? বলিয়া আর এক দফা উচ্চহাসির ঢেউ তুলিয়া দিল। বিজয়া পূর্বের মতই নতমুখে নীরবে বসিয়া রহিল। নরেন কহিল, কিন্তু আপনার বাবা বেঁচে থাকলে, হয়ত এ সময়ে আমার অনেক উপকার হতে পারত—তিনি নিশ্চয় আমাকে উঞ্ছবৃত্তি থেকে রেহাই দিতেন।

0 Shares