দত্তা

বিজয়া উৎসুক-দৃষ্টিতে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি করে জানলেন? তাঁকে ত আপনি চিনতেন না?

নরেন কহিল, না, আমিও তাঁকে কখনও দেখিনি, তিনিও বোধ হয় কখনো দেখেন নি। কিন্তু তবুও আমাকে খুব ভালবাসতেন। কে আমাকে টাকা দিয়ে বিলেত পাঠিয়েছিলেন জানেন? তিনিই। আচ্ছা, আমাদের ঋণের সম্বন্ধে আপনাকে কি কখনও তিনি কিছু বলে যাননি?

বিজয়া কহিল, বলাই ত সম্ভব। কিন্তু আপনি ঠিক কি ইঙ্গিত করচেন, তা না বুঝলে ত জবাব দিতে পারিনে।

নরেন ক্ষণকাল মনে মনে কি চিন্তা করিয়া কহিল, থাক গে। এখন এ আলোচনা একবারেই নিষ্প্রয়োজন।

বিজয়া ব্যগ্র হইয়া কহিল, না, বলুন। আমি শুনতে চাই।

নরেন আবার একটু ভাবিয়া বলিল, যা চুকে-বুকে শেষ হয়ে গেছে, তা শুনে আর কি হবে বলুন?

বিজয়া জিদ করিয়া কহিল, না, তা হবে না। আমি শুনতে চাই, আপনি বলুন।

তাহার আগ্রহাতিশয্য দেখিয়া নরেন হাসিল; কহিল, বলা শুধু যে নিরর্থক তাই নয়—বলতে আমার নিজেরও লজ্জা হচ্চে। হয়ত আপনার মনে হবে আমি কৌশলে আপনার সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে—বিজয়া অধীর হইয়া কথার মাঝখানেই বলিল, আমি আর খোশামোদ করতে পারিনে আপনাকে—পায়ে পড়ি, বলুন।

খাওয়া-দাওয়ার পরে।

না, এখ্‌খুনি—

আচ্ছা বলচি বলচি। কিন্তু একটা কথা পূর্বে জিজ্ঞাসা করি, আমাদের বাড়িটার বিষয়ে কোন কথা কি তিনি কখনো আপনাকে বলেন নি?

বিজয়া অধিকতর অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল, কিন্তু কোন উত্তর দিল না। নরেন মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, আচ্ছা,রাগ করতে হবে না আমি বলচি। যখন বিলেত যাই তখনই বাবার কাছে শুনেছিলুম আপনার বাবাই আমাকে পাঠাচ্চেন। আজ তিনদিন হল, দয়ালবাবু আমাকে একতাড়া চিঠি দেন। যে ঘরটায় ভাঙ্গাচোরা কতকগুলো আসবাব পড়ে আছে, তারই একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে চিঠিগুলো ছিল—বাবার জিনিস বলে দয়ালবাবু আমার হাতেই দেন। পড়ে দেখ‌লুম, খান-দুই চিটি আপনার বাবার লেখা। শুনেছেন বোধ হয় শেষ-বয়সে বাবা দেনার জ্বালায় জুয়া খেলতে শুরু করেন। বোধ করি সেই ইঙ্গিতই একটা চিঠির গোড়ায় ছিল। তার পরে নীচের দিকে এক জায়গায় তিনি উপদেশের ছলে সান্ত্বনা দিয়ে বাবাকে লিখেছিলেন, বাড়িটার জন্যে ভাবনা নেই—নরেন আমারও ত ছেলে, বাড়িটা তাকে যৌতুক দিলাম।

বিজয়া মুখ তুলিয়া কহিল, তার পরে?

নরেন কহিল, তার পরে সব অন্যান্য কথা। তবে এ পত্র বহুদিন পূর্বের লেখা। খুব সম্ভব, তাঁর এ অভিপ্রায় পরে বদলে গিয়েছিল বলেই কোন কথা আপনাকে বলে যাওয়া আবশ্যক মনে করেন নি।

পিতার শেষ ইচ্ছাগুলি বিজয়ার অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়িয়া দীর্ঘশ্বাস পড়িল। কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, তা হলে বাড়িটা দাবী করবেন বলুন, বলিয়া হাসিল।

নরেন নিজেও হাসিল। প্রস্তাবটা চমৎকার পরিহাস কল্পনা করিয়া কহিল, দাবী নিশ্চয় করব, এবং আপনাকেও সাক্ষী মানব। আশা করি সত্য কথাই বলবেন।

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, নিশ্চয়। কিন্তু সাক্ষী মানবেন কেন?

নরেন কহিল, নইলে প্রমাণ হবে কিসে? বাড়িটা যে সত্যই আমার সে কথা ত আদালতে প্রতিষ্ঠিত করা চাই।

বিজয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, অন্য আদালতের দরকার নেই—বাবার আদেশই আমার আদালত। ও বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব।

তাহার মুখের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর ঠিক রহস্যের মত শোনাইল না বটে, কিন্তু সে ছাড়া যে আর কি হইতে পারে তাহাও মনে ঠাঁই দেওয়া যায় না। বিশেষতঃ বিজয়ার পরিহাসের ভঙ্গী এত নিগূঢ় যে, শুধু মুখ দেখিয়া জোর করিয়া কিছু বলা অত্যন্ত কঠিন। তাই নরেন্দ্র নিজেও ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, তা হলে তাঁর চিঠিটা চোখে না দেখেই বোধ হয় বাড়িটা দিয়ে দেবেন?

বিজয়া কহিল, না, চিঠি আমি দেখতে চাই। কিন্তু, এই কথাই যদি তাতে থাকে তাঁর হুকুম আমি কোন মতেই অমান্য করব না।

নরেন্দ্র কহিল, তাঁর অভিপ্রায় যে শেষ পর্যন্ত এই ছিল তারই বা প্রমাণ কোথায়?

বিজয়া উত্তর দিল, ছিল না তার ত প্রমাণ নেই।

নরেন্দ্র কহিল, কিন্তু, আমি যদি না নিই? দাবী না করি?

বিজয়া কহিল, সে আপনার ইচ্ছা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনার পিসীর ছেলেরা আছেন। আমার বিশ্বাস, অনুরোধ করলে তারা দাবী করতে অসম্মত হবেন না।

নরেন্দ্র হাসিয়া কহিল, এ বিশ্বাস আমারও আছে। এমন কি, হলফ করে বলতেও রাজী আছি।

বিজয়া এ হাসিতে যোগ দিল না—চুপ করিয়া রহিল।

নরেন্দ্র পুনরায় কহিল, অর্থাৎ, আমি নিই, না নিই, আপনি দেবেনই?

বিজয়া কহিল, অর্থাৎ বাবার দান করা জিনিস আমি আত্মসাৎ করব না এই আমার প্রতিজ্ঞা।

তাহার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখিয়া নরেন মনে মনে বিস্মিত হইল, মুগ্ধ হইল। কিন্তু নিঃশব্দে কিছুক্ষণ থাকিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, ও বাড়ি যখন সৎকর্মে দান করেছেন তখন আমি না নিলেও আপনার আত্মসাৎ করার পাপ হবে না। তা ছাড়া, ফিরিয়ে নিয়ে কি করব বলুন? আপনার কেউ নেই যে তারা বাস করবে। আমাকে বাইরের কোথাও না কোথাও কাজ করতেই হবে। তার চেয়ে যে ব্যবস্থা, হয়েছে, সেই ত সবচেয়ে ভাল হয়েছে। আরও এক কথা এই যে বিলাসবাবুকে কোনও মতেই রাজী করাতে পারবেন না।

এই শেষ কথাটায় বিজয়া মনে মনে জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, নিজের জিনিসে অপরকে রাজী করানোর চেষ্টা করার মত অপর্যাপ্ত সময় আমার নেই। কিন্তু, আপনি ত আর এক কাজ করতে পারেন। বাড়ি যখন আপনার দরকার নেই, তখন তার উচিত মূল্য আমার কাছে নিন। তা হলে চাকরিও করতে হবে না, অথচ নিজের কাজও স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। আপনি সম্মত হোন নরেনবাবু।

এই একান্ত মিনতিপূর্ণ অনুনয়ের স্বর অকস্মাৎ শরের মত গিয়া নরেনের হৃদয়ে বিঁধিয়া তাহাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল; এবং যদিচ বিজয়ার অবনতমুখে এই মিনতির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পড়িয়া লইবার সুযোগ মিলিল না, তথাপি ইহা পরিহাস নয় সত্য, ইহাও বুঝিতে বিলম্ব ঘটিল না। পিতৃঋণের দায়ে তাহাকে গৃহহীন করিয়া এই মেয়েটি যে সুখী নয়, বরঞ্চ হৃদয়ে ব্যথাই অনুভব করিতেছে, এবং কোন একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া তাহার দুঃখের ভার লঘু করিয়া দিতে চায় ইহা নিশ্চয় বুঝিয়া তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। কিন্তু, তাই বলিয়া এরূপ প্রস্তাবও ত স্বীকার করা চলে না। যাহা প্রাপ্য নয় গরীব বলিয়া তাহাই বা কিরূপে ভিক্ষা লইবে? আরও একটা কথা আছে। যে সকল সাংসারিক ব্যাপার পূর্বে একেবারেই সমস্যা ছিল, তাহার অনেকগুলিই এখন এই লোকটির কাছে সহজ হইয়া গেছে। সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, বিলাসের সম্বন্ধে বিজয়া আবেগের উপর যাহাই কেন না বলুক, তাহার বাধা ঠেলিয়া শেষ পর্যন্ত এ সঙ্কল্প কিছুতেই কার্যে পরিণত করিতে পারিবে না। ইহাতে শুধু কেবল তাহার লজ্জা এবং বেদনাই বাড়িবে আর কিছু হইবে না।

0 Shares