দত্তা

রাসবিহারী বিজ্ঞভাবে অল্প হাস্য করিয়া কহিলেন, কেউ বলেনি মা, আমি বাতাসে খবর পাই। তা না হলে কি এতবড় জমিদারিটা এতদিন চালাতে পারতাম?

বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তাঁরা কতটা দাবী করছেন?

রাসবিহারী মনে মনে হিসাব করিয়া বলিলেন, তা হবে বৈ কি—খুব কম হলেও সেটা বিঘে-দুই হবে।

বিজয়া তাচ্ছিল্যের সহিত কহিল, এই! তা হলে তাঁরাই নিন। এটুকু জায়গা নিয়ে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।

রাসবিহারী অত্যধিক বিস্ময়ের ভান করিয়া ক্ষোভের সহিত কহিলেন, এরকম কথা তোমার মত মেয়ের মুখে আমি আশা করিনি মা। আজ বিনা বাধায় যদি দু’বিঘে ছেড়ে দিই, কাল যে আবার দু’শ বিঘে ছেড়ে দিতে হবে না তাই বা কে বললে?

কিন্তু আশ্চর্য, এত বড় তিরস্কারেও বিজয়া বিচলিত হইল না। সে সহজভাবে প্রত্যুত্তর করিল, কিন্তু সত্যিই ত আর দু’শ বিঘে আমাদের ছাড়তে হচ্ছে না! আমি বলি, সামান্য কারণে মামলা-মকদ্দমার দরকার নেই।

রাসবিহারী মর্মাহত হইলেন। বারংবার মাথা নাড়িয়া কহিলেন, কিছুতেই হতে পারে না মা, কিছুতেই হতে পারে না। তোমার বাবা যখন আমার উপর সমস্ত নির্ভর করে গেছেন, এবং যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি বিনা প্রতিবাদে দু’বিঘে কেন, দু’আঙুল জায়গা ছেড়ে দিলেও ঘোর অধর্ম হবে। তা ছাড়া আরও অনেক কারণ আছে যার জন্যে পুরোনো দলিলগুলো একবার ভাল করে দেখা দরকার। একবার কষ্ট করে ওঠো মা, বাক্সটা উপর থেকে আনিয়ে দাও।

বিজয়া উঠিবার কোন লক্ষণ প্রকাশ করিল না। বরঞ্চ জিজ্ঞাসা করিল, আরও কারণ আছে?

রাসবিহারী বলিলেন, হাঁ।

বিজয়া কহিল, কি কারণ?

রাসবিহারী মনে মনে অত্যন্ত বিরক্ত হইলেও আত্মসংবরণ করিয়া জবাব দিলেন, কারণ ত একটা নয়—মুখে মুখে তার কি কৈফিয়ত তোমাকে দেব মা?

এই সময় সরকারমশায় তাঁহার খাতাপত্রের জন্য আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকিতেই, বিজয়া লজ্জিতভাবে তাড়াতাড়ি কহিল, এ-বেলায় আর হয়ে উঠল না, ও-বেলা এসে নিয়ে যাবেন।

সরকার ‘যে আজ্ঞে’, বলিয়া ফিরিতেছিল—বিজয়া ডাকিয়া বলিল, একটা কাজ আছে কিন্তু। কাছারির ওই নতুন দরোয়ানটা কতদিন বাহাল হয়েছে জানেন?

সরকার কহিল, মাস-তিনেক হবে বোধ হয়।

বিজয়া কহিল, তা যতই হোক, ওকে আর দরকার নেই। এখনো এ মাসের প্রায় কুড়ি দিন বাকী, এই ক’টা দিনের মাইনে বেশী দিয়ে আজই ‘ওকে জবাব দেবেন।

সরকার বিস্ময়াপন্ন হইয়া চাহিয়া রহিল। ইচ্ছাটা তাহার অপরাধের কথা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু সাহস করিল না।

বিজয়া তাহা বুঝিয়াই কহিল, না, দোষের জন্য নয়, তবে লোকটাকে আমার ভাল লাগে না বলেই ছাড়িয়ে দিচ্চি। কিন্তু, মাইনেটা পুরো মাসের দেবেন।

রাসবিহারীর মুখ পলকের জন্য রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছিল; কিন্তু পলকের মধ্যেই আপনাকে সামলাইয়া লইয়া হাসিয়া কহিলেন, তা হলে বিনা দোষে কারো অন্ন মারাটা কি ভালো মা?

বিজয়া তাহার জবাব না দিয়া চুপ করিয়া রহিল দেখিয়া সরকার ভরসা পাইয়া কহিতে গেল—তা হলে তাকে—

হাঁ, বিদায় করে দেবেন—আজই। বলিয়া বিজয়া খাতায় মন দিল। সরকার তবুও কিছু একটা প্রত্যাশা করিয়া খানিকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া চলিয়া গেলে রাসবিহারী মিনিট-পাঁচেক স্তব্ধভাবে থাকিয়া তাঁহার প্রার্থনার পুনরাবৃত্তি করিয়া কহিলেন, একটু কষ্ট স্বীকার করে না উঠলেই যে নয় মা। পুরোনো দলিলগুলো একবার আগাগোড়া বেশ করে পড়া যে চাই-ই।

বিজয়া মুখ না তুলিয়াই কহিল, কেন?

রাসবিহারী গম্ভীর হইয়া কহিলেন, বললাম বিশেষ কারণ আছে। তবুও বারবার এক কথা বলবার ত আমার সময় নেই, বিজয়া।

বিজয়া তাহার খাতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়াই আস্তে আস্তে কহিল, তা বলেছেন সত্যি; কিন্তু কারণ ত একটাও দেখান নি।

না দেখালে কি তুমি উঠবে না? বলিয়া কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া এবার তিনি ধৈর্য হারাইয়া ফেলিলেন, কহিলেন, তার মানে, তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?

বিজয়া নিরুত্তর অধোমুখে কাজ করিতে লাগিল—কোন উত্তর দিল না। তাহার এই নীরবতার অর্থ এত সুস্পষ্ট, এত তীক্ষ্ণ যে, ক্রোধে রাসবিহারীর মুখ কালো হইয়া উঠিল। তিনি হাতের লাঠিটা মেঝেতে ঠুকিয়া বলিলেন, কিসের জন্যে আমাকে তুমি এতবড় অপমান করতে সাহস কর বিজয়া? কিসের জন্যে তুমি আমাকে অবিশ্বাস কর শুনি?

বিজয়া শান্তকণ্ঠে কহিল, আমাকেও ত আপনি বিশ্বাস করেন না! আমার পয়সায় আমারি উপর গোয়েন্দা নিযুক্ত করলে মনের ভাব কি হয় আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারেন, এবং তার পর আমার সম্পত্তির মূল দলিলপত্র হস্তগত করার তাৎপর্য যদি আমি আর কিছু বলে সন্দেহ করি, সে কি অস্বাভাবিক? না সে আপনাকে অপমান করা?

রাসবিহারী একেবারে নির্বাক, স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাঁহার এতবড় পাকা চাল কলিকাতায় বিলাসিতার মধ্যে যত্ন-আদরে প্রতিপালিত একটা অনভিজ্ঞ বালিকার কাছে ধরা পড়িতে পারে এ সম্ভাবনা তাঁহার পাকা মাথায় স্থান পায় নাই; এবং ইহাই সে মুখের উপর অসঙ্কোচে নালিশ করিবে—সে ত স্বপ্নের অগোচর!

রাসবিহারী অনেকক্ষণ বিমূঢ়ের মত বসিয়া থাকিয়া আর একবার যুদ্ধের জন্য কোমর বাঁধিয়া দাঁড়াইলেন; এবং এই প্রকৃতির লোকের যাহা চরম অস্ত্র তাহাই তূণীর হইতে বাহির করিয়া এই অসহায় বালিকার প্রতি নির্মমভাবে নিক্ষেপ করিলেন। কহিলেন, বনমালীর মুখ রাখবার জন্যেই এ কাজ করেছি। বন্ধুর কর্তব্য বলেই তোমার চলাফেরার প্রতি আমাকে নজর রাখতে হয়েচে। একটা অজানা অচেনা হতভাগাকে মাঠের মধ্যে থেকে ধরে এনে যে কাল সমস্ত বেলাটা কাটালে, তার মানে কি আমি বুঝতে পারিনে? শুধু কি তাই? সেদিন দুপুর রাত্রি পর্যন্ত তার সঙ্গে হাসি-তামাশা গল্প করেও তোমার যথেষ্ট হল না, সে রাত্রে কলকাতায় ফিরতে পারলে না, ছল করে তাকে এইখানেই থাকতে হল। এতে তোমার লজ্জা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের যে ঘরে-বাইরে মুখ পুড়ে গেল! সমাজে কারও সামনে মাথা তোলবার যে আর জো রইল না।

কথাটা এত বড় মর্মান্তিক না হইলে হয়ত বিজয়া অপমানে ক্রোধে সঙ্গে সঙ্গেই চীৎকার করিয়া প্রতিবাদ করিত, কিন্তু এ আঘাত যেন তাহাকে অসাড় করিয়া ফেলিল।

রাসবিহারী আড়চোখে চাহিয়া তাঁহার ব্রহ্মাস্ত্রের প্রচণ্ড মহিমা বিজয়ার রক্তহীন মুখের উপর নিরীক্ষণ করিয়া অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সহিত ক্ষণকাল চুপ করিয়া রহিলেন; তারপরে বলিলেন, তবে এগুলো কি ভাল, না এ-সকল নিবারণ করার চেষ্টা করা আমার কাজ নয়?

বিজয়া স্তব্ধ হইয়া আছে দেখিয়া তিনি পুনরায় জোর দিয়া কহিলেন, না, চুপ করে থাকলে হবে না বিজয়া—তোমাকে জবাব দিতে হবে।

তবুও যখন বিজয়া কথা কহিল না, তখন তিনি হাতের লাঠিটা পুনরায় মেঝেতে ঠুকিয়া তাড়া দিয়া কহিলেন, না, চুপ করে থাকলে চলবে না। এ-সকল গুরুতর ব্যাপার—জবাব দেওয়া চাই।

0 Shares