দত্তা

দয়াল বলিলেন, না, কোন কথাই না। কিন্তু কিছু জানবার থাকলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে আমি কালই তোমাকে বলতে পারি।

বিজয়া বিস্মিত হইয়া কহিল, কালই বলতে পারবেন কেমন করে?

দয়াল কহিলেন, তা বোধ হয় পারি। আজকাল তিনি প্রত্যহই আমাদের ওখানে আসেন কিনা।

বিজয়া শঙ্কিত হইয়া কহিল, আপনার স্ত্রীর অসুখ আবার বেড়েচে, কৈ, সে কথা ত আপনি আমাকে বলেন নি!

দয়াল একটু হাসিয়া বলিলেন, না, এখন তিনি বেশ ভালই আছেন। নরেনের চিকিৎসা আর ভগবানের দয়া। বলিয়া তিনি হাত জোড় করিয়া তাঁর উদ্দেশে প্রণাম করিলেন।

বিজয়ার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। সে দয়ালের মুখের দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল, তবে কেন তাঁকে প্রত্যহ আসতে হয়?

দয়াল প্রসন্ন-মুখে কহিতে লাগিলেন, আবশ্যক না থাকলেও জন্মভূমির মায়া কি সহজে কাটে মা! তা ছাড়া, আজকাল নরেনের কাজকর্ম কম, সেখানে বন্ধু-বান্ধবও বিশেষ কেউ নেই—তাই সন্ধ্যেবেলাটা এখানেই কাটিয়ে যান। বিশেষ, আমার স্ত্রী ত তাকে একেবারে ছেলের মতোই ভালবাসেন। ভালবাসার ছেলেও বটে। কিন্তু কথায় কথায় যদি এতদূরেই এসে পড়লে মা, একবার চল না কেন তোমার এ বাড়িতে?

চলুন, বলিয়া বিজয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল।

দয়াল বলিতে লাগিলেন, আমি ত এমন নির্মল, এমন স্বভাবতঃ ভদ্রলোক আমার এতটা বয়সে কখনো দেখতে পাইনি। নলিনীর ইচ্ছে সে বি. এ. পাশ করে ডাক্তারি পড়ে। এ বিষয়ে তাকে কত উৎসাহ, কত সাহায্য যে করেন তার সীমা নেই।

বিজয়া চমকিয়া উঠিল। কলিকাতা হইতে প্রত্যহ এতদূরে আসিয়া সন্ধ্যা অতিবাহিত করিবার এই সন্দেহটাই এতক্ষণ তাহার বুকের ভিতরে বিষের মত ফেনাইয়া উঠিতেছিল। দয়াল ফিরিয়া চাহিয়া স্নেহার্দ্রকণ্ঠে কহিলেন, তবে আর গিয়ে কাজ নেই মা—তুমি শ্রান্ত হয়ে পড়েচ।

বিজয়া কহিল, না চলুন।

তাহার গতির মৃদুতা লক্ষ্য করিয়াই দয়াল ক্লান্তির কথা তুলিতেছিলেন; কিন্তু তাহার মুখের চেহারা দেখিতে পাইলে এ কথা তিনি মুখে আনিতেও পারিতেন না।

তখন প্রতি পদক্ষেপে যে কঠিন ধরণী বিজয়ার পদতল হইতে সরিয়া যাইতেছিল, এ কথা অনুমান করা দয়ালের পক্ষে অসম্ভব। তাই তিনি পুনরায় নিজের মনেই বলিতে লাগিলেন, নরেনের সাহায্যে এর মধ্যেই নলিনী অনেকগুলো বই শেষ করে ফেলেচে। লেখাপড়ায় দু’জনারই বড় অনুরাগ।

অনেকক্ষণ নিঃশব্দে চলার পরে বিজয়া প্রাণপণ চেষ্টায় আপনাকে সংযত করিয়া লইয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আর কিছু সন্দেহ করেন না?

দয়াল বিশেষ কোনরূপ বিস্ময় প্রকাশ করিলেন না। সহজভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, কিসের সন্দেহ মা?

এ প্রশ্নের জবাব বিজয়া তৎক্ষণাৎ দিতে পারিল না। তাহার বুক যেন ভাঙ্গিয়া যাইতে লাগিল। শেষে বলিল, আমার মনে হয় নলিনীর সম্বন্ধে তাঁর মনের ভাব স্পষ্ট করে স্বীকার করা উচিত।

দয়াল সায় দিয়া কহিলেন, ঠিক কথা। কিন্তু তার ত এখনো সময় যায়নি মা। বরঞ্চ আমার মনে হয়, দুজনের পরিচয় আরও একটু ঘনিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সহসা কিছু না বলাই উচিত।

বিজয়া বুঝিল, এ প্রশ্ন অপরের মনেও উদয় হইয়াছে। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, কিন্তু, নলিনীর পক্ষে ত ক্ষতিকর হতে পারে। তাঁর মন স্থির করতে হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু ইতিমধ্যে নলিনীর—

সঙ্কোচ ও বেদনার কথাটা আর তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। কিন্তু, দয়াল বোধ করি সমস্যার এই দিকটা তেমন চিন্তা করিয়া দেখেন নাই। সন্দিগ্ধস্বরে বলিলেন, সত্যি কথা। কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে যতদূর শুনেছি, তাতে—কিন্তু, তোমাকে ত বলেছি, নরেনকে আমরা খুব বিশ্বাস করি। তাঁর দ্বারা যে কারও কোন ক্ষতি হতে পারে, তিনি যে ভুলেও কারও প্রতি অন্যায় করতে পারেন এ ত আমি ভাবতে পারিনে।

তিনি ভাবিতে নাই পারুন, কিন্তু তবুও ঠিক সেই সময়েই অন্যায় যে কোথায় এবং কতদূর পর্যন্ত পৌঁছিতেছিল সে শুধু অন্তর্যামীই জানিতেছিলেন।

উভয়ে যখন দয়ালের বসিবার ঘরে প্রবেশ করিলেন তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘনাইয়া আসিয়াছে। একটা টেবিলের দু’দিকে দুখানা চেয়ারে বসিয়া নরেন্দ্র ও নলিনী। সম্মুখে খোলা বই। অক্ষর অস্পষ্ট হইয়া উঠায় পড়া ছাড়িয়া তখন ধীরে ধীরে আলোচনা শুরু হইয়াছিল। নলিনী এই দিকে চাহিয়া বসিয়াছিল, সে-ই বিজয়াকে প্রথমে দেখিতে পাইয়া কলকণ্ঠে সংবর্ধনা করিল। কিন্তু, বিজয়ার মুখ বেদনায় যে বিবর্ণ হইয়া গেল—তাহা সন্ধ্যার ম্লান আলোকে তাহার চোখে পড়িল না। নরেন্দ্র তাড়াতাড়ি চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া নমস্কার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ভাল আছেন?

বিজয়া নমস্কারও ফিরাইয়া দিল না, প্রশ্নের উত্তরও দিল না। যেন দেখিতেই পায় নাই, এমনি ভাবে তাহার প্রতি সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া নলিনীকে কহিল, কৈ, আপনি ত আর একদিনও গেলেন না?

নরেন সুমুখে আসিয়া হাসিমুখে কহিল, আর আমাকে বুঝি চিনতেও পারলেন না?

বিজয়া শান্ত অবজ্ঞার সহিত জবাব দিল, চিনতে পারলেই চেনা দরকার নাকি?

নলিনীকে কহিল, চলুন আপনার মামীমার সঙ্গে আলাপ করে আসি। বলিয়া পলকমাত্র এদিকে আর একবার দৃষ্টিপাত করিয়া তাহাকে একপ্রকার ঠেলিয়া লইয়া উপরে চলিয়া গেল।

নলিনী সিঁড়ির কয়েক ধাপ উপর হইতে ডাকিয়া কহিল, কিন্তু চা না খেয়ে যেন পালাবেন না নরেনবাবু।

নরেন ইহারও জবাব দিতে পারিল না—বিস্ময়ে, অপমানে একেবারে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, এবং বৃদ্ধ দয়াল তাহার এই অপ্রত্যাশিত লজ্জার অংশ লইবার জন্য বিরসমুখে সেইখানেই নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিন্তু, তবুও কেমন করিয়া যেন তাঁহার কেবলি সন্দেহ হইতে লাগিল, যাহা বাহিরে প্রকাশ পাইল ইহা ঠিক সেই বস্তুই নয়—এই অকারণ অবমাননার অন্তরালে দৃষ্টির আড়ালে যাহা রহিয়া গেল তাহা আর যাহাই হোক উপেক্ষা অবহেলা নয়।

কিছু পরে চায়ের জন্যে উপরে ডাক পড়িলে আজ নরেন্দ্র দয়ালের অনুরোধ এড়াইয়া নীচেই রহিয়া গেল। কিন্তু তাহাকে একাকী ফেলিয়া দয়াল উপরে যাইতে পারিতেছেন না দেখিয়া তৎক্ষণাৎ সহাস্যে কহিল, আমি ঘরের লোক, আমার কথা ভাববেন না দয়ালবাবু। কিন্তু, আপনার মান্য অতিথিটির সম্মান রাখা আবশ্যক। আপনি শীঘ্র যান।

দয়াল দুঃখিত এবং লজ্জিতভাবে উপরে যাইবার উপক্রম করিয়া কহিলেন, তা হলে তুমি কি একটু বসবে?

ভৃত্য আলো দিয়া গিয়াছিল। নরেন খোলা বইটা কাছে টানিয়া লইয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে হাঁ, বসবো বৈ কি!

প্রায় আধঘণ্টা পরে আবার তিনজনে নীচে নামিয়া আসিলে নরেন বই রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আজ না থাকিয়া চলিয়া গেলেই বোধ করি ইঁহারা আরাম অনুভব করিতেন, কারণ এই তাহার একাকী অপেক্ষা করাটাই সকলকে একসঙ্গে যেন লজ্জা ও কুণ্ঠার কশাঘাত করিল।

0 Shares