দত্তা

তাহার উত্তর দিল বিলাস। সে রুক্ষস্বরে কহিল, আপনি কি তাই মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন নাকি? কিন্তু কার সঙ্গে কথা কচ্ছেন, সেটা ভুলে যাবেন না।

আগন্তুক হাসিয়া একটুখানি জিভ কাটিয়া কহিল, সে আমি ভুলিনি, এবং ঝগড়া করতেও আসিনি। বরঞ্চ, কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি বলেই ভাল করে জেনে যেতে এসেছি।

বিলাস বিদ্রূপের ভঙ্গিতে কহিল, বিশ্বাস হয়নি কেন?

আগন্তুক কহিল, কেমন করে হবে বলুন দেখি? নিরর্থক নিজের প্রতিবেশীর ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করবেন—এ বিশ্বাস না হওয়াই ত স্বাভাবিক।

ধর্মমত লইয়া তর্ক-বিতর্ক বিলাসের কাছে ছেলেবেলা হইতেই অতিশয় উপাদেয়। সে উৎসাহে প্রদীপ্ত হইয়া, প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের কণ্ঠে কহিল, আপনার কাছে নিরর্থক বোধ হলেই যে কারও কাছে তার অর্থ থাকবে না, কিংবা আপনি ধর্ম বললেই সকলে তাকে শিরোধার্য করে মেনে নেবে, তার কোন হেতু নেই। পুতুলপূজো আমাদের কাছে ধর্ম নয়, এবং তার নিষেধ করাটাও আমরা অন্যায় বলে মনে করিনে।

আগন্তুক গভীর বিস্ময়ে বিজয়ার মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, আপনিও কি তাই বলেন নাকি?

তাহার বিস্ময় বিজয়াকে যেন আঘাত করিল, কিন্তু সে-ভাব গোপন করিয়া সে সহজ সুরেই জবাব দিল, আমার কাছে কি আপনি এর বিরুদ্ধ মন্তব্য শোনবার আশা করে এসেছিলেন?

বিলাস সগর্বে হাস্য করিয়া কহিল, বোধ হয়। কিন্তু, উনি ত বিদেশী লোক—খুব সম্ভব আপনাদের কিছুই জানেন না।

আগন্তুক ক্ষণকাল নীরবে বিজয়ার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া তাহাকেই কহিল, আমি বিদেশী না হলেও, এ গ্রামের লোক নয়—সে কথা ঠিক। তবুও এ আমি সত্যিই আপনার কাছে আশা করিনি। পুতুল-পূজো কথাটা আপনার মুখ থেকে বার না হলেও, সাকার-নিরাকার উপাসনার পুরানো ঝগড়া আমি এখানে তুলব না। আপনারা যে ব্রাহ্মসমাজের তা-ও আমি জানি। কিন্তু এ ত সে নয়। গ্রামের মধ্যে এই একটি পূজা। সমস্ত লোক সারা বৎসর এই তিনটি দিনের আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। এই বলিয়া আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, গ্রাম আপনার, প্রজারা আপনার ছেলেমেয়ের মত; আপনার আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের আনন্দ-উৎসব শতগুণে বেড়ে যাবে, এই আশাই ত সকলে করে। কিন্তু তা না হয়ে এতবড় দুঃখ, এতবড় নিরানন্দ বিনা অপরাধে আপনার দুঃখী প্রজাদের মাথায় নিজে তুলে দেবেন, এ বিশ্বাস করা কি সহজ? আমি ত বিশ্বাস করতে পারিনি।

বিজয়া সহসা উত্তর দিতে পারিল না। দুঃখী প্রজাদের নামে তাহার কোমল চিত্ত ব্যথায় ভরিয়া উঠিল। ক্ষণকালের জন্য কেহই কোন কথা কহিতে পারিল না, শুধু বিলাসবাবু বিজয়ার সেই নিঃশব্দ স্নেহার্দ্র-মুখের প্রতি চাহিয়া ভিতরে ভিতরে উষ্ণ এবং উদ্বিগ্ন হইয়া তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলিয়া উঠিল, আপনি অনেক কথা কইচেন। সাকার-নিরাকারের তর্ক আপনার সঙ্গে করব, এত অপর্যাপ্ত সময় আমাদের নেই। তা’ সে চুলোয় যাক, আপনার মামা একটি কেন, একশ’টা পুতুল গড়িয়ে ঘরে বসে পুজো করতে পারেন, তাতে কোন আপত্তিই নেই। শুধু কতকগুলো ঢাক-ঢোল-কাঁসি অহোরাত্র ওঁর কানের কাছে পিটে ওঁকে অসুস্থ করে তোলাতেই আমাদের আপত্তি।

আগন্তুক একটুখানি হাসিয়া কহিল, অহোরাত্র ত বাজে না! তা’ সকল উৎসবেই একটু হৈচৈ গণ্ডগোল হয়, বলিয়া বিজয়াকে বিশেষ করিয়া উদ্দেশ করিয়া বলিল, অসুবিধে যদি কিছু হয়, না হয় হলই। আপনারা মায়ের জাত, এদের আনন্দের অত্যাচার আপনি সইবেন না ত কে সইবে?

বিজয়া তেমনি নিরুত্তরেই বসিয়া রহিল। বিলাস শ্লেষের শুষ্ক হাসি হাসিয়া বলিল, আপনি ত কাজ আদায়ের ফন্দিতে ছেলেমেয়ের উপমা দিলেন, শুনতেও মন্দ লাগল না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিজেই যদি মুসলমান হয়ে মামার কানের কাছে মহরম শুরু করে দিতেন, তাঁর সেটা ভাল বোধ হত কি? তা’ সে যাই হোক, বকাবকি করবার সময় নেই আমাদের, বাবা যে হুকুম দিয়েছেন, তাই হবে। কলকাতা থেকে ওঁকে দেশে এনে, মিছামিছি একরাশ ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজিয়ে ওঁর কানের মাথা খেয়ে ফেলতে আমরা দেব না—কিছুতেই না।

তাহার অভদ্র ব্যঙ্গ ও উষ্মার আতিশয্যে আগন্তুকের চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল। সে বিলাসের মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কহিল, আপনার বাবা কে এবং তাঁর নিষেধ করবার কি অধিকার, আমার জানা নেই; কিন্তু আপনি যে মহরমের অদ্ভুত উপমা দিলেন, এটা হিন্দুর রোশনচৌকি না হয়ে সেই মুসলমানদের মহরমের কাড়া-নাকাড়ার বাদ্য হলে কি করতেন শুনি? এ শুধু নিরীহ স্বজাতির প্রতি অত্যাচার বৈ ত নয়!

বিলাস অকস্মাৎ চৌকি ছাড়িয়া লাফাইয়া উঠিল। চোখ রাঙাইয়া ভীষণকণ্ঠে চেঁচাইয়া কহিল, বাবার সম্বন্ধে তুমি সাবধান হয়ে কথা কও বলে দিচ্চি, নইলে এখনি অন্য উপায়ে শিখিয়ে দেব তিনি কে এবং তাঁর কি অধিকার!

আগন্তুক আশ্চর্য হইয়া বিলাসের মুখের প্রতি চাহিল, কিন্তু ভয়ের চিহ্নমাত্র তাহার মুখে দেখা দিল না। দেখা দিল বিজয়ার মুখে। তাহার বাটীতে বসিয়া তাহারই এক অপরিচিত অতিথির প্রতি এই একান্ত অশিষ্ট আচরণে ক্রোধে, লজ্জায় তাহার সমস্ত মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। আগন্তুক মুহূর্তকালমাত্র বিলাসের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল; পরক্ষণেই তাহাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া বিজয়ার প্রতি চোখ ফিরাইয়া কহিল, আমার মামা বড়লোক নন, তাঁর পূজার আয়োজন সামান্যই। তবুও এইটিই একমাত্র আপনার দরিদ্র প্রজাদের সমস্ত বছরের আনন্দ-উৎসব। হয়ত আপনার কিছু অসুবিধা হবে, কিন্তু তাদের মুখ চেয়ে কি এটুকু আপনি সহ্য করে নিতে পারবেন না?

বিলাস ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া সম্মুখের টেবিলের উপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, না, পারবেন না, একশবার পারবেন না। কতকগুলো মূর্খ চাষার পাগলামি সহ্য করবার জন্যে কেউ জমিদারি করে না। তোমার আর কিছু বলবার না থাকে ত তুমি যাও—মিথ্যে আমাদের সময় নষ্ট কোরো না। বলিয়া সে হাত দিয়া দরজা দেখাইয়া দিল।

তাহার উৎকট উত্তেজনায় ক্ষণকালের জন্য আগন্তুক ভদ্রলোকটি যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেল। সহসা তাহার মুখে প্রত্যুত্তর যোগাইল না। কিন্তু পিতার কাছে বিজয়া নিষ্ফল শিক্ষা পায় নাই—সে শান্ত, ধীরভাবে বিলাসের মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনার বাবা আমাকে মেয়ের মত ভালবাসেন বলেই এঁদের পূজো নিষেধ করেছেন; কিন্তু আমি বলি, হলই বা তিন-চারদিন একটু গোলমাল—

কথা শেষ করিতে না দিয়াই বিলাস তেমনি উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করিয়া উঠিল—সে অসহ্য গণ্ডগোল! আপনি জানেন না বলেই—

বিজয়া হাসিমুখে বলিল, তা হোক গণ্ডগোল—তিন দিন বৈ ত নয়! আর আপনি আমার অসুবিধের ভাবনা ভাবচেন—কিন্তু কলকাতা হলে কি করতেন বলুন ত? সেখানে অষ্টপ্রহর কেউ কানের পাশে তোপ দাগতে থাকলেও ত চুপ করে সহ্য করতে হতো? বলিয়া আগন্তুক যুবকটির পানে চাহিয়া কহিল, আপনার মামাকে জানাবেন, তিনি প্রতিবার যেমন করেন, এবারেও তেমনি পূজো করুন, আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।

0 Shares