দত্তা

বিজয়া তেমনি মুখ লুকাইয়া রাখিয়াই ভগ্নকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, না—না, মরণ ছাড়া আর আমার কোন পথ নেই।

দয়াল কহিতে গেলেন, ছি মা, কিন্তু—

বিজয়া প্রবলবেগে মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিল, না—না, এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই। আমি কথা দিয়েছি—বেঁচে থাকতে সে আমি ভাঙ্গতে পারব না দয়ালবাবু। মরতে না পারলে আমি—, বলিতে বলিতেই আবার তাহার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল। দয়ালের গলা দিয়াও আর কথা বাহির হইল না। তিনি নীরবে ধীরে ধীরে তাহার চুলের মধ্যে শুধু হাত বুলাইতে লাগিলেন।

পরেশের মা বাহির হইতে ছেলেকে দিয়া বলাইল, মাঠান, বেলা তিনটে বেজে গেল যে!

সংবাদ শুনিয়া দয়াল অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, এবং স্নানাহারের জন্য নির্বন্ধের সহিত পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিয়া তাহার মুখখানি তুলিয়া ধরিবার যত্ন করিতে লাগিলেন।

পরেশ পুনরায় কহিল, তোমার জন্যে কেউ যে খেতে পারছি নে মাঠান।

তখন চোখ মুছিয়া বিজয়া উঠিয়া বসিল, এবং কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়া ধীরপদে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

দয়াল কহিলেন, নরেন, তোমারও ত এখনো খাওয়া হয়নি?

নরেন অন্যমনস্ক হইয়া কি ভাবিতেছিল, মুখ তুলিয়া কহিল, না।

তবে আমার সঙ্গে বাড়ি চল।

চলুন, বলিয়া সে দ্বিরুক্তি না করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং দয়ালের সঙ্গে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

ষড্‌বিংশ পরিচ্ছেদ

সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় আসন্ন বিবাহোৎসব উপলক্ষে কয়েকটা প্রয়োজনীয় কথাবার্তার পরে পিতাপুত্র রাসবিহারী ও বিলাসবিহারী প্রস্থান করিলে বিজয়া তাহার পড়িবার ঘরে প্রবেশ করিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। দয়াল এমনি তন্ময় হইয়া বসিয়াছিলেন যে কাহারও আগমন লক্ষ্যও করিলেন না। তিনি কখন আসিয়াছেন, কতক্ষণ বসিয়া আছেন, বিজয়া জানিত না। কিন্তু তাঁহার সেই তদগত ভাব দেখিয়া ধ্যান ভাঙ্গিয়া কৌতূহল নিবৃত্ত করিতে তাহার প্রবৃত্তি হইল না; সে যেমন আসিয়াছিল, তেমনি নিঃশব্দে চলিয়া গেল। কিন্তু প্রায় ঘণ্টা-খানেক পরে ফিরিয়া আসিয়াও যখন দেখিতে পাইল, তিনি একই ভাবে বসিয়া আছেন, তখন ধীরে ধীরে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

দয়াল চকিত হইয়া কহিলেন, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি মা।

বিজয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, তা হলে ডাকেন নি কেন?

দয়াল কহিলেন, তোমরা কথা কইছিলে বলে আর বিরক্ত করিনি। কাল দুপুরবেলা আমার ওখানে তোমার নিমন্ত্রণ রইল মা। না মা, না সে কিছুতেই হবে না। পাছে ‘না’ বলে বিদায় কর, সেই ভয়ে এই পথ হেঁটে আবার নিজে এসেছি। কিন্তু দুপুর রোদে হেঁটে যেতে পারবে না বলে দিচ্ছি; আমি পালকি-বেহারা ঠিক করে রেখেছি, তারা এসে তোমাকে ঠিক সময়ে নিয়ে যাবে।

বৃদ্ধের সকরুণ কথায় বিজয়ার চোখ ছলছল করিয়া আসিল; কহিল, একটা চিঠি লিখে পাঠালেও আমি ‘না’ বলতুম না। কেন অনর্থক আবার নিজে হেঁটে এলেন?

দয়াল উঠিয়া আসিয়া বিজয়ার একটা হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, মনে থাকে যেন, বুড়ো ছেলেকে কথা দিচ্ছ মা। না গেলে আবার আমাকে ছুটে আসতে হবে— কোন মতেই ছাড়ব না।

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা।

কিন্তু এই আগ্রহাতিশয্যে সে মনে মনে বিস্মিত হইল। একে ত ইতিপূর্বে কোনদিনই তিনি নিমন্ত্রণ করেন নাই। তাহাতে সান্ধ্যভোজনের পরিবর্তে এই মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা, এবং প্রতিশ্রুতি-পালনের জন্য এইরূপ বারংবার সনির্বন্ধ অনুরোধ, কেমন যেন ঠিক সহজ এবং সাধারণ নয় বলিয়াই তাহার সন্দেহ হইল। আজ দুপুরবেলাও যে এই অকারণ নিমন্ত্রণের সঙ্কল্প তাঁহার মনের মধ্যে ছিল না, তাহা নিশ্চিত; অথচ ইহারই মধ্যে যানবাহনের বন্দোবস্ত পর্যন্ত করিয়া আসিতে তিনি অবহেলা করেন নাই।

মনের অস্বস্তি গোপন করিয়া বিজয়া ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কারণটা কি, শুনতে পাইনে?

দয়াল লেশমাত্র ইতস্ততঃ না করিয়া উত্তর দিলেন, না মা, সেটি তোমাকে পূর্বাহ্নে জানাতে পারব না।

বিজয়া কহিল, তা না বলেন, নিমন্ত্রিতদের নাম বলুন?

দয়াল কহিলেন, তুমি ত সবাইকে চিনবে না মা। তাঁরা আমার ঐ পাড়ারই বন্ধু। যাঁদের চিনবে, তাঁদের একজনের নাম রাসবিহারী, অপরের নাম নরেন্দ্র।

দয়াল চলিয়া গেলে বিজয়া বহুক্ষণ পর্যন্ত স্থির হইয়া বসিয়া মনে মনে ইহার হেতু অনুসন্ধান করিতে লাগিল; কিন্তু যতই ভাবিতে লাগিল, কি একটা অশুভ সংশয়ে মনের অন্ধকার নিরন্তর বাড়িয়াই চলিতে লাগিল।

কিন্তু পরদিন বেলা আড়াইটা পর্যন্ত যখন পালকি আসিয়া পৌঁছিল না, বিজয়া প্রস্তুত হইয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল, তখন একদিকে যেমন বিস্ময়ের অবধি রহিল না, অপর দিকে তেমনি একটা আরাম বোধ করিতে লাগিল। পরেশের মা সঙ্গে যাইবে, এইরূপ একটা কথা ছিল। সে বোধ করি এইবার লইয়া দশবার আসিয়া কিছু খাইবার জন্য বিজয়াকে পীড়াপীড়ি করিল, এবং বুড়া দয়ালের ভীমরতি হইয়াছে কিনা, এবং নিমন্ত্রণের কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে কিনা, জিজ্ঞাসা করিল। অথচ লোক পাঠাইয়া সংবাদ লইতেও বিজয়ার সঙ্কোচ বোধ হইতেছিল, কারণ সত্যই যদি কোন অচিন্তনীয় কারণে তিনি নিমন্ত্রণ করিবার কথা বিস্মৃত হইয়া থাকেন, ত তাঁহাকে অপরিসীম লজ্জায় ফেলা হইবে। এই অভূতপূর্ব অবস্থা-সঙ্কটের মধ্যে তাহার দ্বিধাগ্রস্ত মন কি করিবে, কিছুই যখন নিশ্চয় করিতে পারিতেছে না, এমন সময় পরেশ হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া খবর দিল, পালকি আসিতেছে।

বিজয়া যখন যাত্রা করিল, তখন বেলা অপরাহ্ন। রাসবিহারী তাঁহার জনমজুর লইয়া অতিশয় ব্যস্ত, তাড়াতাড়ি পালকির পার্শ্বে আসিয়া সহাস্যে বলিলেন, দয়ালের হঠাৎ এমন লোক খাওয়ানোর ধুম পড়ে গেল কেন, সে ত জানিনে। সন্ধ্যার পর আমাকেও যেতে হবে, বিশেষ করে বলে গেছেন। কিন্তু পালকি পাঠাতে রাত্রি করলে যেতে পারব না, সে কিন্তু বলে দিয়ো মা।

দয়ালের বাটীর দ্বারের উপর আম্র-পল্লবের সারি দেওয়া, উভয় পার্শ্বে জলপূর্ণ কলস— বিজয়া বিস্মিত হইল। ভিতরে পা দিতেই—দয়াল গ্রামস্থ জন-কয়েক ভদ্রলোকের সহিত আলাপ করিতেছিলেন—ছুটিয়া আসিয়া ‘মা’ বলিয়া তাহার হাত ধরিলেন।

সিঁড়িতে উঠিতে উঠিতে বিজয়া রুষ্ট অভিমানের সুরে কহিল, ক্ষিদেয় আমার প্রাণ বেরিয়ে গেল, এই বুঝি আপনার মধ্যাহ্নভোজনের নেমন্তন্ন?

দয়াল স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিলেন, আজ যে তোমাদের খেতে নেই মা। নরেন ত নির্জীব হয়ে শুয়েই পড়েছে। আজ একটা দিনের জন্যে অন্ততঃ কানা ভট‌চায্যিমশায়ের শাসন মানতেই হবে যে।

দ্বিতলের সম্মুখের হলে বিবাহের সমস্ত আয়োজন প্রস্তুত রহিয়াছে। এগুলা কি, ঠিক না বুঝিয়াও বিজয়ার নিভৃত অন্তর কাঁপিয়া উঠিল—সে মুখ ফুটিয়া জিজ্ঞাসা করিতে পর্যন্ত সাহস করিল না।

0 Shares