দত্তা

দয়াল অত্যন্ত সহজভাবে বুঝাইয়া বলিলেন, সন্ধ্যার পরেই লগ্ন—আজ যে তোমার বিবাহ বিজয়া! ভাগ্যক্রমে দিনক্ষণ সমস্ত পাওয়া গেছে—না গেলেও আজই দিতে হত, কিছুতেই অনাথা করা যেত না; তা যাক, সমস্তই ঠিকঠাক মিলে গেছে। তাই ত কানা ভট‌চায্যিমশাই হেসে বললেন, এ যেন তোমাদের জন্যেই পাঁজিতে আজকের দিনটি সৃষ্টি হয়েছিল।

বিজয়ার মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। কহিল, আপনি কি আমার হিন্দু-বিবাহ দেবেন?

দয়াল কহিল, হিন্দু—বিবাহ কি বিবাহ নয় মা? কিন্তু সাম্প্রদায়িক মত মানুষকে এমনি বোকা করে আনে যে, কাল সমস্ত বেলাটা ভেবে ভেবেও এই তুচ্ছ কথাটার কোন কুল- কিনারা খুঁজে পাইনি। কিন্তু নলিনী আমাকে একটি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিলে। বললে, মামা, তাঁর বাবা তাঁকে যাঁর হাতে দিয়ে গেছেন, তোমরা তাঁর হাতেই তাঁকে দাও; নইলে ব্রাহ্ম— বিবাহের ছল করে যদি অপাত্রে দান কর ত অধর্মের সীমা থাকবে না। আর মনের মিলনই সত্যিকার বিবাহ। নইলে বিয়ের মন্তর বাংলা হবে কি সংস্কৃত হবে, ভট্‌চায্যিমশাই পড়াবেন কিংবা আচার্যমশাই পড়াবেন, তাতে কি আসে যায় মামা? এতবড় জটিল সমস্যাটা যেন একেবারে জল হয়ে গেল বিজয়া। মনে মনে বললুম, ভগবান! তোমার ত কিছুই অগোচর নেই! এদের বিবাহ আমি যে—কোন মতেই দিই না, তোমার কাছে যে অপরাধী হব না, সে নিশ্চয় জানি। তবুও বললুম, কিন্তু একটা কথা আছে যে নলিনী! বিজয়া যে তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁরা যে তারই উপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত হয়ে আছেন। এ সত্য ভাঙ্গবে কি করে?

নলিনী বললে, মামা তুমি ত জান, বিজয়ার অন্তর্যামী কখনো সায় দেননি। তাঁর চেয়ে কি বিজয়ার বলাটাই বড় হল? তার হৃদয়ের সত্যকে লঙ্ঘন করে কি তার মুখের কথাটাকেই বড় করে তুলতে হবে?

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, তুই এ-সব শিখলি কোথায় মা?

নলিনী বললে, আমি নরেনবাবুর কাছেই শিখেছি। তিনি বার বার বললেন, সত্যের স্থান বুকের মধ্যে, মুখের মধ্যে নয়। কেবল মুখ দিয়ে বার হয়েছে বলেই কোন জিনিস কখনো সত্য হয়ে উঠে না। তবুও তাকেই যারা সকলের অগ্রে, সকলের ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে চায়, তারা সত্যকে ভালবাসে বলেই করে না, তারা সত্যভাষণের দম্ভকেই ভালবাসে বলে করে।

একটুখানি চুপ করিয়া বলিলেন, তুমি নরেনকে জান না মা, সে যে তোমাকে কত ভালবাসে, তাও হয়ত ঠিক জান না। সে এমন ছেলে যে, অসত্যের বোঝা তোমার মাথায় তুলে দিয়ে তোমাকে গ্রহণ করতে কিছুতেই রাজী হত না। একবার আগাগোড়া তার কাজগুলো মনে করে দেখ দিকি বিজয়া!

বিজয়া কিছুই কহিল না। নিঃশব্দে নতমুখে কাঠের মত দাঁড়াইয়া রহিল।

নলিনী ভিতরে কাজে ব্যস্ত ছিল। খবর পাইয়া ছুটিয়া আসিয়া বিজয়াকে জড়াইয়া ধরিল। কানে কানে কহিল, তোমাকে সাজাবার ভার আজ নরেনবাবু আমাকে দিয়েছেন। চল, বলিয়া তাহাকে একপ্রকার জোর করিয়া টানিয়া লইয়া গেল।

ঘণ্টা-দুই পরে তাহাকে ফুল ও চন্দনে সজ্জিত করিয়া নলিনী বধূর আসনে বসাইয়া সম্মুখে বড় জানালাটা খুলিয়া দিতেই তাহার লজ্জিত মুখের উপর দক্ষিণের বাতাস এবং আকাশের জ্যোৎস্না যেন একই কালে তাহার স্বর্গত মাতা-পিতার আশীর্বাদের মত আসিয়া পড়িল।

যিনি সম্প্রদান করিতে বসিলেন, শোনা গেল, তিনি কোন্‌ এক সুদূর-সম্পর্কে বিজয়ার পিসী। একচক্ষু ভট্টাচার্যমশাই মন্ত্র পড়াইতে বসিয়া দাবী করিলেন, দুই-তিন পুরুষ পূর্বে তাঁরাই ছিলেন জমিদার-বাটীর কুল-পুরোহিত।

বিবাহ অনুষ্ঠান সমাধা হইয়া গিয়াছে—বর-বধূকে তুলিবার আয়োজন হইতেছে, এমন সময়ে রাসবিহারী আসিয়া বিবাহ-সভায় উপস্থিত হইলেন। দয়াল উঠিয়া দাঁড়াইয়া সসম্মানে অভ্যর্থনা করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিলেন, এস ভাই, এস। শুভকর্ম নির্বিঘ্নে শেষ হয়ে গিয়েছে—আজকের দিনে আর মনের মধ্যে কোন গ্লানি রেখো না ভাই—এদের তুমি আশীর্বাদ কর।

রাসবিহারী ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া সহজ গলায় কহিলেন, বনমালীর মেয়ের বিবাহটা কি শেষে হিঁদুর মতেই দিলে দয়াল? আমাকে একটু জানালে ত এর প্রয়োজন হত না।

দয়াল থতমত খাইয়া কহিল, সমস্ত বিবাহই ত এক ভাই।

রাসবিহারী কঠোরস্বরে কহিলেন, না। কিন্তু বনমালীর মেয়ে কি তার বাপের গ্রাম থেকে আজীবন নির্বাসন-দুঃখও একবার ভেবে দেখলে না?

নলিনী পাশেই দাঁড়াইয়া ছিল—সে কহিল, তাঁর মেয়ে তার স্বর্গীয় পিতার সত্যকার আজ্ঞাটাই পালন করছে, অনুষ্ঠানের কথা ভাববার সময় পায়নি। আপনি নিজেও ত বনমালীবাবুর যথার্থ ইচ্ছাটা জানতেন। তাতে ত ত্রুটি হয়নি।

রাসবিহারী এই দুর্মুখ মেয়েটার প্রতি একটা ক্রুর দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া শুধু বলিলেন, হুঁ। বলিয়া ফিরিতে উদ্যত হইতেছিলেন—নলিনী আবদারের সুরে কহিল, বাঃ—আপনি বুঝি বিয়ে-বাড়ি থেকে শুধু শুধু চলে যাবেন? সে হবে না, আপনাকে খেয়ে যেতে হবে! আমি মামাকে দিয়ে কত কষ্ট করে আপনাকে নেমন্তন্ন করে আনিয়েছি।

রাসবিহারী কথা কহিলেন না, শুধু আর একটা অগ্নিদৃষ্টি তাহার প্রতি নিক্ষেপ করিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।

(সমাপ্ত)

0 Shares