দত্তা

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না; এবং পরক্ষণেই আত্মসংবরণ করিয়া লইয়া মৃদু হাসিয়া বলিল, কিন্তু ম্যালেরিয়া ত লোক চিনে ধরে না! আমি ত বরং না জেনে এসেচি, আপনি যে জেনে-শুনে জলের ধারে বসে আছেন? কৈ দেখি, কি মাছ ধরলেন?

লোকটি হাসিয়া কহিল, পুঁটি মাছ। কিন্তু দু’ ঘণ্টায় মাত্র দুটি পেয়েছি। মজুরি পোষায় নি। কিন্তু কি করি বলুন, আপনার মত আমিও প্রায় বিদেশী বললেই হয়। বাইরে বাইরে দিন কেটেছে, প্রায় কারুর সঙ্গেই তেমন আলাপ-পরিচয় নেই—কিন্তু বিকেলটা ত যা করে হোক কাটাতে হবে?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া সহাস্যে কহিল, আমারও প্রায় সেই দশা। আপনাদের বাড়ি বুঝি পূর্ণবাবুর বাড়ির কাছেই?

লোকটি কহিল, না। হাত দিয়া নদীর ওপার দেখাইয়া বলিল, আমাদের বাড়ি ঐ দিঘ্‌ড়ায়। এই বাঁশের পুল দিয়ে যেতে হয়।

গ্রামের নাম শুনিয়া বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, তা হলে বোধ হয় জগদীশবাবুর ছেলে নরেনবাবুকে আপনি চেনেন?

লোকটি মাথা নাড়িবামাত্রই বিজয়া একান্ত কৌতূহলবশে সহসা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল, তিনি কি রকম লোক, আপনি বলতে পারেন?

কিন্তু, বলিয়া ফেলিয়াই নিজের অভদ্র প্রশ্নে অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া উঠিল। এই লজ্জা লোকটির দৃষ্টি এড়াইল না। সে হাসিয়া বলিল, তার বাড়ি ত আপনি দেনার দায়ে কিনে নিয়েছেন; এখন তার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে আর ফল কি? কিন্তু যে সদুদ্দেশ্যে নিলেন সে -কথাও এ অঞ্চলের সবাই শুনেছে।

বিজয়া জিজ্ঞাসা করিল, একেবারে নেওয়া হয়ে গেছে—এই বুঝি এদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে?

লোকটি বলিল, হবারই কথা। জগদীশবাবুর সর্বস্ব আপনার বাবার কাছে বিক্রিকবালায় বাঁধা ছিল। তাঁর ছেলের সাধ্য নেই, তত টাকা শোধ করেন—মিয়াদও শেষ হয়েছে—খবর সবাই জানে কিনা!

বাড়িটি কেমন?

মন্দ নয়, বেশ বড় বাড়ি। যে জন্যে নিচ্ছেন, তার পক্ষে ভালই হবে। চলুন না, আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে।

চলিতে চলিতে বিজয়া কহিল, আপনি যখন গ্রামের লোক, তখন নিশ্চয় সমস্ত জানেন। আচ্ছা, শুনেছি নরেনবাবু বিলেত থেকে ভাল করেই ডাক্তারি পাশ করে এসেছেন। কোন ভাল জায়গায় প্র্যাক্‌টিস আরম্ভ কোরে আরও কিছুদিন সময় নিয়েও কি বাপের ঋণটা শোধ করতে পারেন না?

লোকটি ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সম্ভব নয়। শুনেছি, চীকিৎসা করাই নাকি তার সঙ্কল্প নয়।

বিজয়া বিস্মিত হইয়া কহিল, তবে তাঁর সঙ্কল্পটাই বা কি শুনি? এত খরচ-পত্র করে বিলেতে গিয়ে কষ্ট করে ডাক্তারি শেখবার ফলটাই বা কি হতে পারে। লোকটি বোধ হয় একেবারেই অপদার্থ।

ভদ্রলোক একটুখানি হাসিয়া বলিল, অসম্ভব নয়। তবে শুনেছি নাকি নরেনবাবু নিজে চিকিৎসা করে রোগ সারানোর চেয়ে, এমন কিছু একটা নাকি বার করে যেতে চান, যাতে ঢের ঢের বেশী লোকের উপকার হবে। শুনতে পাই, নানাপ্রকার যন্ত্রপাতি নিয়ে দিনরাত পরিশ্রমও খুব করেন।

বিজয়া চকিত হইয়া কহিল, সে ত ঢের বড় কথা। কিন্তু তাঁর বাড়ি-ঘরদোর গেলে কি করে এসব করবেন? তখন ত রোজগার করা চাই! আচ্ছা, আপনি ত নিশ্চয় বলতে পারবেন, বিলেত যাওয়ার জন্যে এখানকার লোকে তাঁকে ‘একঘরে’ করে রেখেছে কি না।

ভদ্রলোক কহিল, সে ত নিশ্চয়। আমার মামা পূর্ণবাবু তারও ত একপ্রকার আত্মীয়, তবুও পূজোর ক’দিন বাড়িতে ডাকতে সাহস করেন নি—কিন্তু তাতে তাঁর কিছুই আসে-যায় না। নিজের কাজকর্ম নিয়ে আছেন, সময় পেলে ছবি আঁকেন—বাড়ি থেকে বারই হন না। ঐ তাঁর বাড়ি, বলিয়া আঙুল দিয়া গাছপালায় ঘেরা একটা বৃহৎ অট্টালিকা দেখাইয়া দিল।

এই সময় বুড়া দরোয়ান পিছন হইতে ভাঙা-বাঙলায় জানাইল যে, অনেকদূর আসিয়া পড়া হইয়াছে, বাটী ফিরিতে সন্ধ্যা হইয়া যাইবে।

লোকটি ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, হাঁ, কথায় কথায় অনেক পথ এসে পড়েছেন।

তাহাকেও সেই বাঁশের সেতু দিয়াই গ্রামে ঢুকিতে হইবে, সুতরাং ফিরিবার মুখেও সঙ্গে সঙ্গে আসিতে লাগিল। বিজয়া মনে মনে ক্ষণকাল কি যেন চিন্তা করিয়া কহিল, তা হলে তাঁর কোন আত্মীয়-কুটুম্বের ঘরেও আশ্রয় পাবার ভরসা নেই বলুন?

লোকটি কহিল, একেবারেই না।

বিজয়া আবার কিছুক্ষণ চুপ করিয়া চলিয়া কহিল, তিনি যে কারও কাছে যেতে চান না, সে কথা ঠিক। নইলে এই মাসের শেষেই ত তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দেবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে—আর কেউ হলে অন্ততঃ আমাদের সঙ্গেও একবার দেখা করার চেষ্টা করতেন।

লোকটি কহিল, হয়ত তাঁর দরকার নেই—নয় ভাবেন, লাভ কি। আপনি ত আর সত্যিই তাঁকে বাড়িতে থাকতে দিতে পারবেন না!

বিজয়া কহিল, না পারলেও, আর কিছুকাল থাকতে দিতেও ত পারা যায়! দেনার দায়ে হাজার হলেও ত একজনকে তার বাড়ি-ছাড়া করতে সকলেরই কষ্ট হয়! কিন্তু আপনার কথাবার্তার ভাবে বোধ হয়, যেন তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে। কি বলেন, সত্যি নয়?

লোকটি শুধু হাসিল, কোন কথা কহিল না। পুলটির কাছেই তাহারা আসিয়া পড়িয়াছিল। সে ছোট ছিপটা কুড়াইয়া লইয়া কহিল, এই আমাদের গ্রামে ঢোকবার পথ। নমস্কার। বলিয়া হাত তুলিয়া নমস্কার করিয়া সেই বংশ-নির্মিত পুলটির উপর দিয়া টলিতে টলিতে কোনমতে পার হইয়া সঙ্কীর্ণ বন্যপথের ভিতরে অদৃশ্য হইয়া গেল।

বহুদিনের বৃদ্ধ ভৃত্য কানাই সিং বিজয়াকে শিশুকালে কোলে-পিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছিল, এবং সেই সঙ্গে সে দরোয়ানীর ন্যায্য অধিকারকেও বহুদূরে অতিক্রম করিয়া গিয়াছিল। সে কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এ বাবুটি কে মাইজী?

বিজয়া কিন্তু এতটাই বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল যে, বুড়ার প্রশ্ন তাহার কানেই পৌঁছিল না। সেই প্রায়ান্ধকার নদীতটের সমস্ত নীরব মাধুর্যকে সে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া স্বপ্নাবিষ্টের মত শুধু এই কথা ভাবিতে ভাবিতেই পথ চলিতে লাগিল—লোকটি কে, এবং আবার কবে দেখা হইবে?

সপ্তম পরিচ্ছেদ

রাসবিহারী বলিলেন, আমরাই নোটিশ দিয়েছি, আবার আমরাই যদি তাকে রদ করতে যাই, আর পাঁচজন প্রজার কাছে সেটা কি-রকম দেখাবে, একবার ভেবে দেখ দিকি মা।

বিজয়া কহিল, এই মর্মে একখানা চিঠি লিখে কেন তার কাছে পাঠিয়ে দিন না। আমার নিশ্চয় বোধ হচ্ছে, তিনি শুধু অপমানের ভয়েই এখানে আসতে সাহস করেন না।

রাসবিহারী জিজ্ঞাসা করিলেন, অপমান কিসের?

বিজয়া বলিল, তিনি নিশ্চয় ভেবেছেন, তাঁর প্রার্থনা আমরা মঞ্জুর করব না।

রাসবিহারী বিদ্রূপের ভাবে কহিলেন, মহা মানী লোক দেখচি! তাই অপমানটা ঘাড়ে নিয়ে আমাদের যেচে তাঁকে থাকতে দিতে হবে?

বিজয়া কাতর হইয়া কহিল, তাতেও দোষ নেই কাকাবাবু! অযাচিত দয়া করার মধ্যে কোন লজ্জা নেই।

রাসবিহারী কহিলেন, ভাল, লজ্জা নাহয় নেই; কিন্তু আমরা যে সমাজ-প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেচি, তার কি হবে বল দেখি?

0 Shares