দেনা-পাওনা

এককড়ি সাহস দিয়া বলিল, ভয় কি হুজুর, ওষুধ এলো বলে। বল্লভ ডাক্তারের একশিশি মিক্সচার খেলেই সব ভাল হয়ে যাবে।

জীবানন্দ মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না এককড়ি, তোমাদের বল্লভের মিক্সচার তোমাদেরই থাক, আমাকে তুমি কেবল কলকাতা যাবার একটা বন্দোবস্ত আজই করে দাও। এই বলিয়া তিনি যে দ্বার দিয়া ষোড়শী কয়েক মুহূর্ত পূর্বে অন্যত্র সরিয়া গিয়াছিল, সেইদিকে উৎসুকচক্ষে চাহিয়া রহিলেন।

কিন্তু কেহই ফিরিয়া আসিল না। মিনিট দু-তিন পরে তাঁহার অধৈর্য আর মানা মানিল না, কহিলেন, ওঁকে একবার ডেকে দিয়ে তুমি যাবার একটা ব্যবস্থা কর গে এককড়ি! আজ যাওয়া আমার চাই-ই।

এ সঙ্কেত এককড়ি চক্ষের নিমিষে বুঝিল, এবং যে আজ্ঞে হুজুর, বলিয়া তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল। কিন্তু ফিরিয়া আসিতে তাহার বিলম্ব হইতে লাগিল, এবং মিনিট-পনর বিলম্বে যখন সে যথার্থই আসিল, তখন একাকীই আসিল; কহিল, তিনি নেই, বাড়ি চলে গেছেন হুজুর!

জীবানন্দ বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। ব্যগ্র ব্যাকুলকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, আমাকে না জানিয়ে চলে যাবেন? এমন হতেই পারে না এককড়ি!

বিশ্বাস করা সত্যই কঠিন। অলকা কোন ব্যবস্থা না করিয়াই চলিয়া গেল, একটা কথা বলিয়া গেল না—ডাক্তারের অভিমতটুকু শুনিয়া যাইবার পর্যন্ত তাহার ধৈর্য রহিল না—এ কথা জীবানন্দ কিছুতেই যেন মনের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিলেন না।

এককড়ি বলিল, হাঁ হুজুর, তিনি ডাক্তারবাবু যাবার পরেই চলে গেছেন। বাইরে গোপাল কাওরা বসে আছে, সে দেখেচে ভৈরবী সোজা চলে গেলেন।

জীবানন্দ আর প্রতিবাদ করিলেন না। এককড়ি কহিল, তাহলে একটু বেলাবেলি যাত্রা করবার ব্যবস্থা করি গে হুজুর?

পরিচ্ছেদ – সাত

জমিদারের বিলাসকুঞ্জ হইতে ষোড়শী যখন নিঃশব্দে সরিয়া গেল, তখন বেলা বোধ হয় ন’টা-দশটা। এমন করিয়া চলিয়া আসাটা তাহার বিশ্রী ঠেকিতে লাগিল, কিন্তু তখনই মনে হইল, বলিয়া কহিয়া বিদায় লইয়া আসাটা আরও অশোভন, আরও বাড়াবাড়ি হইত। কিন্তু গেটের বাইরে আসিয়া দেখিল আর একপদও অগ্রসর হওয়া চলে না। এবার নাবী বর্ষায় কৃষকদের ধান্য-রোপণের কাজকর্ম তখনও মাঠে শেষ হইয়া যায় নাই, উহাদের মাঝখান দিয়া গ্রামের একমাত্র পথ। এই প্রকাশ্য দিনের বেলায় এই পথের উপর দিয়া মুখ উঁচু বা নিচু করিয়া কোনভাবেই হাঁটিয়া যাইতে তাহার পা উঠিল না। আকাশের বিদ্যুৎ একমুহূর্তে অন্ধকারের পর্দা তুলিয়া মেঘাচ্ছন্ন পৃথিবীর বক্ষটাকে যেমন সুস্পষ্ট করিয়া দেয়, দূরের ঐ চাষীগুলাও ঠিক তেমনি করিয়া চক্ষের পলকে ষোড়শীর বিগত রাত্রিটাকে তাহার কাছে অত্যন্ত অনাবৃত করিয়া দিল। আবরণের নীচে যে এত জিনিস ঢাকা ছিল, কোন মানুষের জীবনেই যে একটা রাত্রির মধ্যে এতবড় ব্যাপার ঘটিয়া উঠিতে পারে, দেখিতে পাইয়া সে ক্ষণিকের জন্য যেন হতজ্ঞান হইয়া রহিল। সম্পূর্ণ একটা দিনও কাটে নাই, মাত্র কাল সায়াহ্নবেলায় অপমানের প্রবল তাড়নে দিগ্বিদিক্‌ না ভাবিয়া এই পথ দিয়াই সে হাঁটিয়া গেছে, কিন্তু তাহার পরে? তাহার পরের ঘটনা ঘটিতে মানুষের বহু যুগ লাগিতে পারে, অথচ তাহার লাগে নাই। এ যেন একটা ভোজবাজি হইয়া গেল, তাই আজ পরিচিত পথটারই ও ধারে তাহার জন্য কি যে অপেক্ষা করিয়া আছে তাহা কল্পনা করিতেও পারিল না। ফটকের বাহিরে বাগানের ধার দিয়া একটা পায়ে-হাঁটা পথ নদীর দিকে গিয়াছে, কেবলমাত্র সম্মুখের রাস্তাটা বলিয়াই সে এই পথ দিয়া ধীরে ধীরে নদীর তীরে আসিয়া দাঁড়াইল। এদিকে গ্রাম নাই, গরু-ছাগল চরাইতে ক্কচিৎ কোন রাখাল বালক ভিন্ন এ পথে সচরাচর কেহ চলে না—এই নিরালা স্থানটায় সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করিয়া সে অন্ধকারে গা ঢাকিয়া ঘরে ফিরিবে মনে করিয়া একটা প্রাচীন তেঁতুলগাছের তলায় বসিয়া পড়িল।

এতক্ষণ পর্যন্ত সে ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়িয়াছিল; তাহাতে বর্তমানের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই তাহার মনে ছিল না। এইবার যে ভবিষ্যৎ সাগ্রহে তাহার পথ চাহিয়া আছে, তাহার কথাই একটি একটি করিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা করিতে লাগিল। তাহাদের ছোট গ্রামে এতক্ষণ কোন কথাই কাহারো অবিদিত নাই; জমিদার তাহাকে ধরিয়া আনিয়াছে, সারারাত্রি আটক রাখিয়াছে—এই কয়দিনের অত্যাচারে গ্রামে ইহা এমনিই একটা সাধারণ ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছে যে, এজন্য বিশেষ কোনরূপ চিন্তিত হইবার আবশ্যক নাই। এমন কি, কেন যে সে মিথ্যা করিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের কবল হইতে জমিদারকে উদ্ধার করিয়াছে, এ রহস্যোদ্ভেদ করিবারও গ্রামে বুদ্ধিমান লোকের অভাব হইবে না।

এ যে একটা বড় রকমের ঘুষের ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিবে। কিন্তু আসল বিপদ হইতেছে তাহার পিতা তারাদাসকে লইয়া! বহুকাল হইতেই উভয়ের সহজ-সম্বন্ধটা বাহিরের অগোচরে ভিতরে ভিতরে পচিয়া উঠিতেছিল, এইবার তাহা ঘৃণার বাষ্পে অনেকখানি স্থান ব্যাপিয়া জ্বলিতে থাকিবে। ইহার শিখা কাহারও দৃষ্টি হইতে আড়াল করা সম্ভব হইবে না। সংসারে সে লোকটার অসাধ্য কার্য নাই। তাহার অনেক কুকর্মে বাধা দিয়া পিতা ও কন্যার মধ্যে অনেক গোপন সংগ্রাম হইয়া গেছে, চিরদিন পিতাকেই পরাভব মানিতে হইয়াছে, অথচ, নানা কারণে এতকাল তাহাকে ষোড়শীর মাতার সম্বন্ধে মৌন থাকিতেই হইয়াছে। কিন্তু আজ যখন তারাদাস ক্রোধবশে একবার কথাটা প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে, তখন আর সে কোনমতেই চুপ করিয়া থাকিবে না। এই কলঙ্কের কালি দুই হাতে ছড়াইয়া নিজের সঙ্গে আর একজনের সর্বনাশ করিয়া তবে গ্রাম হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবে। ইহা যে অকিঞ্চিৎকর নয়, ইহা যে তাহার সমস্ত ভবিষ্যৎটাকে আঁধার করিয়া তুলিবে, তাহাও ষোড়শী দূর হইতে স্পষ্ট দেখিতে লাগিল; কিন্তু সেই অন্ধকারের অভ্যন্তরে যে কি সঞ্চিত আছে, তাহার কোন আভাসই তাহার চোখে পড়িল না। বেলা বাড়িয়া উঠিতে লাগিল, এইখানে বসিয়া ভিতরের উদ্যোগ-আয়োজনের অস্পষ্ট কোলাহল মাঝে মাঝে তাহার কানে আসিতে লাগিল, এবং তাহারই ফাঁকে ফাঁকে জীবানন্দের মুখের অলকা নাম, তাহার সলজ্জ ক্ষমাভিক্ষা, তাহার ব্যাকুল প্রার্থনা, এমনি কত-কি যেন একটা ভুলে-যাওয়া কবিতার ভাঙ্গাচোরা চরণের মত রহিয়া রহিয়া তাহার মনের মধ্যে অকারণে আনাগোনা করিতে লাগিল; অথচ সে সঙ্কট ওই গ্রামখানার মধ্যে তাহারই প্রতীক্ষায় উদ্যত হইয়া আছে, তাহার বিভীষিকা সেই মনের মধ্যেই অনুক্ষণ তেমনি ভীষণ হইয়াই রহিল।

0 Shares