দেনা-পাওনা

ক্রমশঃ ধীরে ধীরে সূর্যদেব অপর প্রান্তে হেলিয়া পড়িলেন, এবং তাহারই একটা দীপ্ত রশ্মি হইতে মুখ ফিরাইতে গিয়া হঠাৎ বহুদূরে পরপারের মাঠের মধ্যে জমিদারের পালকিখানা তাহার চোখে পড়িল। এই দিকেই যখন তাহারা গিয়াছে, তখন এক সময়ে নিকট দিয়াই গিয়াছে, সে খেয়াল করে নাই, হয়ত চেষ্টা করিলে একটু দেখা যাইতে পারিত, কিন্তু এখন অজ্ঞাতসারে শুধু কেবল তাহার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িল।

অপরাহ্ন সায়াহ্নে এবং সায়াহ্ন সন্ধ্যায় অবসান হইতে অধিক বিলন্ব হইল না। ষোড়শী গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করিয়া যখন উঠিয়া দাঁড়াইল তখনও মানুষ চেনা যায়, কিন্তু মাঠে লোক ছিল না। এবং এই নির্জন পথটা অতিক্রম করিয়া যখন নিজের গৃহের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল তখন অন্ধকার গাঢ়তর হইয়াছে। কাহারও সহিত সাক্ষাৎ না হইলেও তাহার মনের মধ্যে ঝড় বহিতেছিল, কিন্তু সদর দরজায় তালা বন্ধ দেখিয়া সে যেন একটা কঠিন দায় হইতে অব্যাহতি পাইয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। ঘুরিয়া খিড়কির দ্বারে গিয়া দেখিল ভিতর হইতে তাহা আবদ্ধ; ইহাই সে প্রত্যাশা করিয়াছিল, কিন্তু এই কবাটটা সে বাহির হইতে খুলিবার কৌশল জানিত। অনতিবিলম্বে ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ঘরে ঘরে তালা বন্ধ, কেহ কোথাও নাই—সমস্ত বাড়িটা অন্ধকার, শূন্য খাঁখাঁ করিতেছে।

সন্ন্যাসিনীকে অনেক উপবাস করিতে হয়, খাওয়ার কথা তাহার মনেও ছিল না; কোথাও নিরালায় একটু শুইতে পাইলেই সে আপাততঃ বাঁচিয়া যাইত; কিন্তু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিবার যখন উপায় নাই, তখন বারান্দার উপরেই একধারে সে নিজের অঞ্চলটা পাতিয়া শুইয়া পড়িল। তারাদাস গৃহে নাই, কেন নাই, কি জন্য নাই, কোথায় গিয়াছে, এই-সকল কূট প্রশ্নমালা হইতে তাহার নিরতিশয় শ্রান্ত দেহ-মন অত্যন্ত সহজেই সরিয়া দাঁড়াইল। এবং রাত্রিটার মত যে সে নিরুপদ্রবে ঘুমাইতে পাইবে, এই তৃপ্তিটুকু লইয়াও সে দেখিতে দেখিতে নিদ্রিত হইয়া পড়িল।

ভোরবেলা ষোড়শীর যখন ঘুম ভাঙ্গিল তাহার অব্যবহিত পরেই সদর দরজায় চাবি খোলার শব্দ হইল, এবং যে বিধবা স্ত্রীলোকটি মন্দিরের ও গৃহের কাজকর্ম করে, সে আসিয়া প্রবেশ করিল। ষোড়শীকে দেখিয়া সে অধিক বিস্মিত হইল না—কখন এলে মা, রাত্তিরেই? খিড়কির দোর খুলে ঢুকেছিলে বুঝি?

ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া সায় দিলে সে বলিল, এই কথাই সক্কলে বলাবলি করছিল মা, রাজাবাবু ত অ-বেলায় চলে গেল, এইবার তোমাকে ছেড়ে দেবে। খাওয়া-দাওয়া হয়নি বুঝি? কি করব মা, ঘরের চাবি বাবাঠাকুর ত রেখে যায়নি, সঙ্গে নে গেছে। তা হোক গে, দোকান থেকে ডাল-চাল এনে দি, কাঠকুটো দুটো যোগাড় করে দি, চান করে এসে যা হোক দু’মুঠো ফুটিয়ে নিয়ে মুখে দাও। তার পরে যা হবার তা হবে।

ষোড়শী জিজ্ঞাসা করিল, বাবা কোথায় গেছেন জানিস রানীর মা?

রানীর মা কহিল, শুনচি ত মা, কে নাকি তার বোনের মেয়ে আছে, তাকেই আনতে গেছে—এলো বলে। আজ বড়কর্তাবাবুর নাতির মানত পূজো, আজ কি আর কোথাও থাকবার জো আছে? মন্দিরে ত পহর রাত থাকতে ধুম লেগে গেছে মা!

ষোড়শীর দপ্‌ করিয়া মনে পড়িল, আজ মঙ্গলবার, আজ জনার্দন রায়ের দৌহিত্রের মানত পূজা উপলক্ষে জয়চণ্ডীর মন্দিরে তুমুল কাণ্ড। আজ কোনমতে কোথাও তাহার লুকাইয়া থাকিবার পথ নাই। সে দেবীর ভৈরবী, এতবড় ব্যাপারে তাহাকে হাজির হইতেই হইবে।

এইখানে জনার্দন রায়ের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। লোকটি যেমন ধনী, তেমনি ভীষণ। একবার একজন প্রজার বেগার দেওয়ার উপলক্ষে ষোড়শীর সহিত ইঁহার অত্যন্ত মনোমালিন্য ঘটে, সে কথা কোন পক্ষই আজও বিস্মৃত হয় নাই। এবং কেবল ষোড়শীই নয়, এ অঞ্চলের সকলেই ইঁহাকে অত্যন্ত ভয় করে। জমিদার ইঁহাকে খাতির করে, এককড়ি ইঁহার হাত-ধরা। অনাদায়ী বৎসরে ইনিই জমিদারের সদর খাজনার যোগান দেন। দুই শত বিঘা ইঁহার নিজ চাষ এবং ধান-চাল-গুড় হইতে তেজারতি ও বন্ধকী কারবার ইঁহার একচেটে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

অথচ এই বড়কর্তাই একদিন অতি নিঃস্ব ছিলেন। জনশ্রুতি এইরূপ যে, এ সমস্তই তাঁহার মধ্যম জামাতা মিস্টার বসুর টাকা। তিনি পশ্চিমের কোন্‌ একটা হাইকোর্টের বড় ব্যারিস্টার। বিলাত হইতে ফিরিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিয়া জাতিতে উঠিয়াছেন। আজ তাঁহারই একমাত্র পুত্রের সর্ববিধ মঙ্গল-কামনায় চণ্ডীর পূজার আয়োজন হইতেছে। এবং আয়োজন কেবল আজ নয়, মাসাধিক কাল হইতেই গ্রামের মধ্যে ইহার কথাবার্তা চলিয়াছে। বড়কর্তার যে মেয়েটি এতবড় ঘরে পড়িয়াছে, সেই হৈমবতীকে ষোড়শী ছেলেবেলায় চিনিত। তাহার চেয়ে বয়সে সামান্য কিছু ছোটই হইবে। মন্দির-প্রাঙ্গণে যে ছোট্ট পাঠশালাটি এখনও বসে, সকলের সঙ্গে সেও পড়িতে আসিত; এবং খেলাচ্ছলে যদি কোনদিন ষোড়শী উপস্থিত হইত, দেবীর ভৈরবী বলিয়া সকলের সঙ্গে সেও প্রণাম করিয়া পদধূলি লইত। আজ সে বড়ঘরের ঘরণী। আজ হয়ত তাহার দেহে সৌন্দর্য এবং ঐশ্বর্যের মণিমাণিক্য ধরে না, আজ হয়ত সে তাহাকে চিনিতেও পারিবে না। কিন্তু একদিন এমন ছিল না। সেদিন তাহার রূপ এবং বয়স কোনটাই বেশী ছিল না; তবু যে এতবড় ঘরে পড়িয়াছে, শুনা যায়, সে কেবল এই দেবীর মাহাত্ম্যে। কোন্‌ এক অমাবস্যায় নাকি এক সিদ্ধ তান্ত্রিক দেবী-দর্শনে আসিয়াছিলেন; রায় মহাশয় গোপনে এই কন্যার কল্যাণেই কি-সব যাগ-যজ্ঞ করাইয়া লইয়াছিলেন। এই পুত্রটিও নাকি তাঁহারই করুণায়। হতাশ হইয়া হৈম বিদেশে এই দেবীকেই মানত করিয়া পুত্রলাভ করিয়াছে।

দাসী কাজ করিতে করিতে কহিল, মা, মন্দিরে আজ হঠাৎ কখন ডাক পড়ে বলা যায় না, এই বেলা কেন চানটানগুলো সেরে নিলে না?

ষোড়শী অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতেছিল, মন্দিরের ডাক পড়ার নামে চমকিয়া উঠিল। কিন্তু সেজন্য না হোক, বেলা বাড়িবার পূর্বেই নিভৃতে স্নান করিয়া আসাই ভাল মনে করিয়া সে কালবিলম্ব না করিয়া খিড়কির দ্বার দিয়া পুষ্করিণীতে চলিয়া গেল। এই পুকুরটায় পাড়ার কেহ বড় একটা আসে না, তাই সেখানে কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইল না। ফিরিয়া আসিয়া দেখিল ভিজা কাপড় ছাড়িবার দ্বিতীয় বস্ত্র নাই, গা-মাথা মুছিবার একটা গামছা পর্যন্ত বাহিরে নাই। রানীর মা লক্ষ্য করিয়া ক্ষুণ্ণ হইল। সে তারাদাসকে দেখিতে পারিত না, রাগ করিয়া কহিল, বিটলে খড়কুটোটি পর্যন্ত তালাবন্ধ করে গেছে—আমার একখানি কাচা মটকার কাপড় আছে মা, নে আসবো? তাতে ত দোষ নেই?

0 Shares