দেনা-পাওনা

ষোড়শী কহিল, না, থাক।

ভিজে কাপড় গায়ে শুখোবে মা, অসুখ করবে যে?

ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল। দাসী তাহার শুষ্ক মুখের প্রতি চাহিয়া ব্যথার সহিত বলিল, ক’দিন যে উপোস করচ মা, তা কে জানে! মেলেচ্ছ ব্যাটাদের ঘরে যে তুমি জলটুকু ছোঁবে না তা আমি বেশ জানি। এইবেলা দুটো চাল-ডাল দোকান থেকে না হোক, আমার বাড়ি থেকে এনে রেখে যাইনে মা?

ষোড়শী মাথা নাড়িয়া শুধু কহিল, ও-সব এখন থাক রানীর মা।

এই দাসীটি কায়স্থের মেয়ে। তাহার বোধ-শোধ ছিল, এ লইয়া আর নিষ্ফল পীড়াপীড়ি করিল না। কাজকর্ম শেষ করিয়া, যাইবার সময় প্রশ্ন করিল, বাবাঠাকুরকে মন্দিরে দেখতে পেলে কি একবার আড়ালে ডেকে পাঠিয়ে দেব?

ষোড়শী কহিল, থাক, তার আবশ্যক নেই।

দাসী কহিল, তালা দেবার দরকার নেই, দোরটা তুমি ভেতর থেকেই বন্ধ করে দাও। কিন্তু, আচ্ছা মা, কেউ যদি কোন কথা জিজ্ঞেসা করে ত কি—

ষোড়শী ক্ষণকাল মাত্র চুপ করিয়া রহিল, তাহার পরে মুখ তুলিয়া কহিল, হাঁ, বলো আমি বাড়িতেই আছি। এবং রানীর মা চলিয়া গেলে সে দ্বার আর রুদ্ধ হইল না, তেমনিই উন্মুক্তই রহিল। সুমুখের বারান্দার উপরে নিঃশব্দে নতমুখে বসিয়া ঘণ্টা দুই-তিন যে কেমন করিয়া কোথা দিয়া চলিয়া গেল, ষোড়শী জানিতেও পারে নাই; কেবল একটা নির্দিষ্ট বেদনার মত তাহার মনের মধ্যে এই ভাবটা ছিল যে, এইবার তাহার একটা অত্যন্ত কঠোর দুঃসময় আসিতেছে। পরীক্ষাচ্ছলে একটা অতিশয় কদর্য আন্দোলন এইবার গ্রামের মধ্যে উত্তাল হইয়া উঠিবে। অথচ যুদ্ধের জন্য, আত্মরক্ষার জন্য আজ তাহার মন কিছুতেই বদ্ধপরিকর হইতে চাহিল না, বরঞ্চ সে যেন কেবলি তাহার কানে কানে এই কথাই কহিতে লাগিল, তুমি সন্ন্যাসিনী, এই সকল কথার বড় কথাটা আজ তোমার মনে রাখিতে হইবে। জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, একদিন যে তোমার এই দেহটা দেবতার কাছে উৎসর্গ করা হইয়াছিল, এই-সকল সত্যের বড় সত্যটা আজ তোমার কিছুতেই অস্বীকার করিলে চলিবে না। তোমাকে পণ রাখিয়া মিথ্যার বাজি যাহারা খেলিতেছিল, মরুক না তাহারা মারামারি কাটাকাটি করিয়া, তুমি এইবার মুক্তি লইয়া বাঁচো।

ঠিক এমনি সময়ে দ্বার খুলিয়া মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিত প্রাঙ্গণে আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, মা, এঁরা একবার তোমাকে ডাকচেন।

চল, বলিয়া ষোড়শী তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল। কেন, কোথায় বা কাহারা ডাকিতেছেন, প্রশ্নমাত্র করিল না, যেন এইজন্যই সে প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়াছিল। তাহার উদ্যত বিপদ সম্বন্ধে পুরোহিত বেচারার বোধ হয় কিছু আভাস দিবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ভৈরবীর মুখের প্রতি চাহিয়া তাহার কোন কথাই মুখে আসিল না।

আজ মন্দির-প্রাঙ্গণের বড় দ্বার খোলা। প্রবেশ করিতেই দেখিতে পাইল ও-ধারের দেয়ালের গায়ে-গোটা-দুই কালো রঙের পাঁঠা বাঁধা আছে, এবং বারান্দার এক প্রান্তে পূজার উপকরণ ভারে ভারে স্তূপাকার করা হইয়াছে। তথায় পাঁচ-ছয়জন বর্ষীয়সী রমণী বাক্যে এবং কার্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া আছেন, এবং সর্বাপেক্ষা প্রচণ্ড কলরব উঠিয়াছে প্রাঙ্গণের নাটমন্দিরের মধ্যে।

সেখানে রায়মহাশয়ের সুদৃশ্য এবং প্রশস্ত সতরঞ্চি বিছানো রহিয়াছে, এবং তাঁহাকে মধ্যবর্তী করিয়া গ্রামের প্রবীণের দল যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন হইয়া সম্ভবতঃ বিচার করিতেছে এবং তাহা ষোড়শীকে লইয়া। এতক্ষণ কে শুনিতেছিল বলা যায় না, অথচ আশ্চর্য এই যে, যাহার শোনা সবচেয়ে প্রয়োজন, সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই এই শতকণ্ঠের উদ্দাম বক্তৃতা একেবারে পলকে নিবিয়া গেল।

কিছুক্ষণ পর্যন্ত কোন পক্ষ হইতেই কোন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইল না। পুরুষেরা সকলেই ষোড়শীর পরিচিত, এবং মেয়েরাও যখন কাজ ফেলিয়া একে একে থামের আড়ালে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহারাও তাহার অপরিচিত নয়; কেবল যে মেয়েটি সকলের পরে মন্দিরের মধ্য হইতে বাহির হইয়া ধীরে ধীরে আসিয়া ঠিক তাহার সম্মুখের জোড়া-থামটা আশ্রয় করিয়া নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া তাহার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল, সে অচেনা হইলেও ষোড়শী একমুহূর্তে বুঝিল, এই হৈমবতী। এই মেয়েটি তাহার স্বামিগৃহ ছাড়িয়া বহুকাল যাবৎ বাপের বাড়ি আসিতে পারে নাই; তাই তাহার সম্বন্ধে জনশ্রুতিও এই বাপের বাড়ির দেশে উত্তরোত্তর বিবিধ হইয়াই উঠিতেছিল। সে অখাদ্য খানা খায়, ঘাগরা এবং জুতা-মোজা পরে, রাস্তায় পুরুষদের হাত ধরিয়া বেড়ায়, সে একেবারে খ্রীষ্টান মেমসাহেব হইয়া গেছে—এমনি কত কি! আজ কিন্তু ষোড়শী তাহার কিছুই দেখিতে পাইল না। পরনে একখানি মূল্যবান বেনারসী শাড়ি এবং গায়ে দু-একখানা দামী অলঙ্কার ব্যতীত, জুতা-মোজা-ঘাগরার কিছুই ছিল না। বরঞ্চ তাহার সিঁথির সিঁদুর এবং পায়ের আলতা বেশ মোটা করিয়াই দেওয়া, দেখিলে কোনমতেই মনে হয় না এ-সকল সে বিশেষ করিয়া কেবল আজকার জন্যই ধারণ করিয়া আসিয়াছে। সে সুন্দরী সত্য, কিন্তু অসাধারণ নয়। দেহের রঙটা হয়ত একটু ময়লার দিকেই, তবে ধনী-ঘরের মেয়েরা যেমন নিরন্তর মাজিয়া-ঘষিয়া বর্ণটাকে উজ্জ্বল করিয়া তোলে ইহাও তেমনি—তাহার অধিক নয়। নিমিষের দৃষ্টিপাতেই ষোড়শীর মনে হইল এই ধনী-গৃহিণী ধনের আড়ম্বরেও যেমন তাহার দেহকে বস্ত্রালঙ্কারের দোকান করিয়া সাজায় নাই, লজ্জা এবং নির্লজ্জতা কোনটার বাড়াবাড়িতেও তেমনি তাহার শিশুকালের গ্রামখানিকে বিড়ম্বিত করিয়া তোলে নাই। মেয়েটি নীরবে চাহিয়া রহিল, হয়ত শেষ পর্যন্ত এমনি নীরবেই রহিবে, কিন্তু ইহারই সম্মুখে নিজের আসন্ন দুর্গতির আশঙ্কায় ষোড়শীর লজ্জায় ঘাড় হেঁট হইয়া গেল।

আরও মিনিট দুই-তিন নিঃশব্দে কাটিয়া গেলে বৃদ্ধ সর্বেশ্বর শিরোমণি প্রথমে কথা কহিলেন, ষোড়শীকে উদ্দেশ করিয়া অতিশয় সাধুভাষায় তাঁহাদের অভিমত ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, আজ হৈমবতী তাঁর পুত্রের কল্যাণে যে পূজা দিতেছেন, তাতে তোমার কোন অধিকার থাকবে না, তাঁর এই সঙ্কল্প তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, তোমাকে দিয়ে তাঁর কার্য সুসিদ্ধ হবে না।

0 Shares