দেনা-পাওনা

সন্তানের প্রতি ভৈরবীর এই ঐকান্তিক আশীর্বচনেও মায়ের মন হইতে অপ্রসন্নতা ঘুচিল না। সে কুণ্ঠিতস্বরে কহিল, কিন্তু আজকের দিনটা যে একটু অন্যরকমের দিদি! আপনি নিজের হাতে পূজো না করলে যে ওঁদের কাছে ভারী ছোট হয়ে যাবো! বলিয়া সে একবার উন্মুক্ত দ্বার দিয়া বাহিরের বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।

ষোড়শীর নিজের দৃষ্টিও উহাকে অনুসরণ না করিয়া পারিল না। দেখিল সকলে এইদিকেই চাহিয়া আছে। তাহাদের চোখ ও মুখের উপর উৎকট কলহের চিহ্ন একান্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে—ঠিক যেন অধীর সৈনিকের দল কেবলমাত্র তাহাদের অধিপতির ইঙ্গিতের অপেক্ষায় বহু দুঃখে তাহাদের যুদ্ধ-বেগ সংযত করিয়া আছে। কিন্তু রায়মহাশয় সে ইঙ্গিত দিলেন না। তিনি ঘোর সংসারী লোক, মুহূর্তেই বুঝিলেন উপস্থিত ক্ষেত্রে তিনি প্রকাশ্যে ধনী কন্যা-জামাতার বিরুদ্ধাচরণ করিতে পারেন না। অল্পকালেই তাঁহার রক্তচক্ষু অবনত হইয়া আসিল, এবং কাহাকেও আর একটি কথাও না কহিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিয়া ধীরে ধীরে মন্দির-প্রাঙ্গণ ত্যাগ করিয়া গেলেন। দুই-চারিজন অনুগত ব্যক্তি ভিন্ন কেহই তাঁহার সঙ্গ লইল না। বৃদ্ধ শিরোমণিমহাশয় রহিয়া গেলেন, এবং অনেকেই ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কি গড়ায় জানিবার জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিল।

হৈম মিনতি করিয়া কহিল, মা-ভৈরবীর আশীর্বাদ আমরা মাতা-পুত্র মাথায় করে নিলাম, কিন্তু সে আশীর্বাদ আমি আপনাকে দিয়েই পাকা করে নিতে চাই দিদি।বেশ, আমি অপেক্ষা করতে পারব; পূজো আজ বন্ধ থাক—যেদিন আপনি আদেশ করবেন, এই উদ্যোগ-আয়োজন আবার নাহয় সেই দিনই হবে।

ষোড়শী মাথা নাড়িয়া কহিল, সে সুবিধে আর হবে কিনা এ কথা ত আজ তোমাকে নিশ্চয় করে বলতে পারবো না বোন!

হৈম সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তবে কি মা-চণ্ডীর ভৈরবী আর আপনি থাকবেন না?

ষোড়শী শুধু বলিল, আজও ত তাই আছি।

হৈম কহিল, তবে? বলিয়াই দেখিতে পাইল দ্বারের চৌকাঠ ধরিয়া শিরোমণি দাঁড়াইয়া আছেন। চোখাচোখি হইতেই তিনি সদর্পে অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিলেন, তোমার বাবা আর আমি সেই কথাই ত এতক্ষণ বকে মরচি গো! ভালো, আমাদের সবুর সইবে। উনি কাল হোক, পরশু হোক, দু’দিন পরে হোক, দশদিন পরে হোক, পূজা করুন। দিন তার জবাব!

হৈম ষোড়শীর মুখের প্রতি নির্নিমেষে চাহিয়া রহিল, কিন্তু সে তার কোন উত্তর দিল না।

শিরোমণি ভৈরবীর ম্লানমুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া সহাস্যে কহিল, মা হৈম, এ ত সোজা প্রশ্ন নয়! এ পীঠস্থান, জাগ্রত দেবতা, দেবীর ভৈরবী ছাড়া এ দেব-অঙ্গ স্পর্শ করা ত যে-সে স্ত্রীলোকের কর্ম নয়! বুকের জোর থাকে, থাকুন উনি মায়ের ভৈরবী—আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা জানি সে আর ওঁর সাধ্যই নেই।

ইঙ্গিতটা এতই সুস্পষ্ট যে লজ্জায় হৈমর পর্যন্ত মাথা হেঁট হইয়া গেল। ষোড়শী নিজেও অভিভূতের মত ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অকস্মাৎ আপনাকে আপনি ধাক্কা মারিয়া যেন সম্পূর্ণ সচেতন করিয়া তুলিল। শিরোমণিকে সে কোন উত্তর করিল না, কিন্তু বুড়ো পূজারীকে হঠাৎ একটা ধমক দিবার মত তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিয়া উঠিল, ছোট ঠাকুরমশাই, তুমি ইতস্ততঃ করচ কিসের জন্যে? আমার আদেশ রইল, দেবীর পূজা যথারীতি সেরে তুমি নিজের প্রাপ্য নিয়ো, বাকী মন্দিরের ভাঁড়ারে বন্ধ করে চাবি আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো। হৈমর প্রতি চাহিয়া কহিল, অনেক আয়োজন করেচ, এ-সব নষ্ট করা উচিত হবে না ভাই। আমি আশীর্বাদ করে যাচ্চি এতেই তোমার ছেলের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ হবে। আমার নিজের পূজা-আহ্নিক এখনো বাকী রয়েচে, আমি এখন চললাম—সময় যদি পাই ত আবার আসব। এই বলিয়া সে আর বাদানুবাদ না করিয়া বাহির হইয়া গেল।

মুহূর্তকয়েকের জন্য সকলেই নির্বাক্‌ হইয়া রহিল, কিন্তু ক্ষণপরেই অপমান ও অবহেলায় বৃদ্ধ শিরোমণি অঙ্কুশ-আহত পশুর ন্যায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার বয়সোচিত মর্যাদাবোধ ও ছদ্মগাম্ভীর্য কোথায় ভাসিয়া গেল, দৃষ্টিবহির্ভূত ষোড়শীর উদ্দেশে একটা অভদ্র ইঙ্গিত করিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, এবার মন্দিরে ঢুকলে গলাধাক্কা খেয়ে মরতে হবে জানিস! নষ্ট মেয়েমানুষ কোথাকার! ভেবেচিস গাঁয়ে মানুষ নেই? আজও জনার্দন রায় বেঁচে, আজও সর্বেশ্বর শিরোমণি মরেনি, তা জানিস!

এই-সকল অভিযোগ ও আস্ফালনের প্রতিবাদ করিবার তথায় কেহ ছিল না, বরঞ্চ তাঁহারই পোষকতায় রমণীগণের মধ্য হইতে বর্ষীয়সী কে একজন বলিয়া ফেলিল, হতভাগীকে ঝাঁটা মেরে দূর কর শিরোমণিমশাই! বড় অহঙ্কার! বড় অহঙ্কার! জমিদারের বাগানবাড়িতে একরাত একদিন কাটিয়ে এসে বলে কিনা বাবুর অসুখ হয়েছিল! হয়েই যদি থাকে ত তোর কি! কিন্তু, বলিতে বলিতেই সহসা প্রতিমার প্রতি চক্ষু পড়িতেই তাঁহার ঈর্ষা-পীড়িত উচ্ছৃঙ্খল রসনা চক্ষের পলকে শান্ত ও সংযত হইয়া গেল; নিজের দুই কান তিনি তৎক্ষণাৎ দুই হাতে স্পর্শ করিয়া কণ্ঠস্বর অত্যন্ত সুমিষ্ট ও কোমল করিয়া অতঃপর কহিতে লাগিলেন, মায়ের ভৈরবী, নিন্দে করলে মহাপাপ হবে, নিন্দে আমি করচি নে, কিন্তু তাই বলে কি এতটা ভাল! সাহেব ভালমানুষ, তাই ছেড়ে দিলে, নইলে মিথ্যের দায়ে নিজের বাপের হাতেই যে দড়ি পড়ত!

কিন্তু ইহাতে উপস্থিত কেহই আর কথা যোগ করিল না। ষোড়শী যাহাই করুক সে যে চণ্ডীমাতার ভৈরবী এই সত্যটা হঠাৎ উত্থাপিত হইয়া না পড়িলে কুকথার প্রবাহটা বোধ করি এমন করিয়া তখনি থামিত না। কিন্তু তাই বলিয়া শিরোমণিমহাশয়ের রাগ পড়ে নাই, তিনি পুনশ্চ কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, হৈম মলিন অবসন্ন মুখখানি তুলিয়া আস্তে আস্তে কহিল, ও-সব কথা এখন থাক শিরোমণি জ্যাঠামশাই! তাড়াতাড়ি ত নেই—এখন আমার ছেলের পূজোটি হয়ে যাক।

তাই হোক, তাই হোক, বলিয়া শিরোমণি তাঁহার দুঃসহ বিরক্তি ও ক্রোধ তখনকার মত সংবরণ করিয়া চলিয়া গেলেন এবং হৈম অদূরে একধারে নির্জীবের মত নিঃশব্দে বসিয়া পড়িল। এই লজ্জাকর ও নিরতিশয় অপ্রিয়কর আলোচনা সে এইভাবে বন্ধ করিয়া দিল সত্য, পুরোহিতও সাড়ম্বরে দেবীর পূজা করিয়া দিলেন, কিন্তু হৈম তাহার অন্তরের মধ্যে উৎসাহ বা আনন্দের লেশমাত্র খুঁজিয়া পাইল না। তাহার পিতা ও লোকগুলার দুর্ব্যবহারে এবং বিশেষ করিয়া ওই ব্রাহ্মণের জঘন্য ইতরতায় তাহার যেমন বিতৃষ্ণা জন্মিল, ষোড়শীর অদ্ভুত আচরণেও তাহার মনের ভিতরটা তেমনি অজ্ঞাত গ্লানি ও সংশয়ের ব্যথায় পরিপূর্ণ হইয়া রহিল। তথাপি পুরোহিতের কাজটা কলের মত অবাধে চলিল। জাগ্রত দেবতার পূজা, বলিদান, হোম প্রভৃতি যাহা-কিছু অনেক সময় লইয়া সমস্তই ধীরে ধীরে সমাধা হইয়া আসিল, তাহার পুত্রের কল্যাণে শুভকর্মে কোথাও কোন বিঘ্নই ঘটিল না, কিন্তু ষোড়শী আর ফিরিল না।

0 Shares