দেনা-পাওনা

জামাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু আজ এলেন কি করে?

তারাদাস এতক্ষণ নীরবেই ছিল, এবার কথা কহিল। বলিল, ও-পারের ওই বটগাছের সঙ্গে জায়গাগুলো সব মা-চণ্ডীর। তাই থেকে আলাপ। ফকির-সাহেব ষোড়শীকে বড় ভালবাসেন, থাকলে ওখানে ষোড়শী প্রায়ই যায়। তাঁর কাছে পড়াশুনাও করে দেখেচি।

জামাই-সাহেব একটু হাসির ভাবে কহিলেন, ভালবাসে! বিদ্যাচর্চাও চলে! এই ফকির-সাহেবটির বয়স কত?

তারাদাস লজ্জিত হইয়া বলিল, আজ্ঞে, বুড়োমানুষ তিনি। বয়স ষাট-বাষট্টির কম নয়, মা বলে ডাকেন। একবার ষোড়শীর ভারী অসুখ হয়েছিল—প্রায় মরতে বসেছিল—উনিই ভাল করেন।

সাহেব বলিলেন, ওঃ—তাই নাকি! তবে কি জানো বাপু, ওদিকেও সাধু-ফকির, এদিকেও ডাকিনী-যোগিনী! এই-সব ভৈরব-ভৈরবীর দলটাকে—কিন্তু শেষ করিতে পারিলেন না। হঠাৎ স্ত্রীর মুখের একাংশে চক্ষু পড়িয়া এই বেফাঁস কথাটা ওখানেই রহিয়া গেল। আর কেহই কথা যোগ করিল না, কেবল অপ্রতিহতগতি শিরোমণি নিবৃত্ত হইলেন না। অপরাধের বাকীটুকু সদম্ভে সম্পূর্ণ করিয়া দিয়া তিনিই কেবল বলিয়া উঠিলেন, একশো’ বার বাবাজী, একশো’ বার! এই-সব ভণ্ড বেটা-বেটীরা যেমন নষ্ট তেমনি ভ্রষ্ট। তিনি বাম ও দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করিয়া বোধ করি তাঁহার যোগেন ভায়া ও মিত্তিরজার মাথা-নাড়াটাও অন্ততঃ প্রত্যাশা করিলেন। কিন্তু এবার তাহারাও নির্বাক্‌ রহিল, এবং দ্বারের অন্তরালবর্তিনী হৈমবতীর শুষ্ক মুখখানি ক্ষণেকের জন্য একেবারে রাঙ্গা হইয়া উঠিল।

ঠিক এই সময়ে ভৈরবীকে সঙ্গে করিয়া, সেই ভণ্ড মুসলমান ফকির ধীরপদক্ষেপে প্রাঙ্গণের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। কাহারও সংশয় রহিল না যে শিরোমণির উচ্চকণ্ঠ তাঁহাদের শ্রুতিগোচর হইয়াছে।

অনতিবিলম্বে উভয়ে যখন নিকটে সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তখন কাহারও মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না। একটা অভ্যর্থনা না, বসিতে বলার একটা সামান্য ভদ্রতা-রক্ষা পর্যন্ত না। অথচ মনে মনে সকলেই যেন বিশেষ একটু চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। শিরোমণির পর্যন্ত মনে হইতে লাগিল, কি যেন ঠিক হইল না—কিসে যেন ভারী একটা ত্রুটি হইয়াছে অথচ সবাই তেমনিই বসিয়া রহিলেন।

মিস্টার বসুসাহেবের কাছে উভয় আগন্তুকই একবারে সম্পূর্ণ অপরিচিত। মিনিট দুই-তিন তীক্ষ্ণদৃষ্টি দ্বারা তিনি দুইজনকেই আপাদমস্তক বার বার নিরীক্ষণ করিলেন। এই ফকিরটির মাথার চুল হইতে দীর্ঘ দাড়ি-গোঁফ সমস্তই একেবারে তুষার-শুভ্র, অঙ্গে মুসলমান ফকিরের সাধারণ পোশাক। সচরাচর যাহা দেখা যায় তাহার অধিক কিছু নয়, অথচ মনে হয় এই সবল সুদীর্ঘ দেহের উপরে এগুলি সমস্ত যেন তাদের সামান্যতাকে বহু ঊর্ধ্বে অতিক্রম করিয়া গেছে। তাঁহার গায়ের রঙ জলে ভিজিয়া এবং রৌদ্রে পুড়িয়া এমন একপ্রকার হইয়াছে, যাহা আগে কি ছিল কিছুতেই অনুমান করা যায় না। ফকিরের মুখ ও চোখের উপর সামান্য একটুখানি উৎকণ্ঠিত কৌতূহলের ছায়া পড়িয়াছে বটে, কিন্তু আরও একটু মন দিয়া দেখিলেই দেখা যায়, ইহারই অন্তরালে যে চিত্তখানি বিরাজ করিতেছে, তাহা যেমন শান্ত তেমনি নিরুদ্বেগ এবং তেমনি ভয়হীন। ইঁহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইল ষোড়শী। তাহার গৈরিক বস্ত্র, তাহার সুন্দর সুগঠিত, অনাবৃত মাথাটি ভরিয়া রুক্ষ বিস্রস্ত কেশ-ভার, তাহার উপবাস-কঠিন, যৌবন-সন্নদ্ধ দেহের সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত আশ্চর্য সুষমা, সর্বোপরি তাহার নত-নেত্রের অপরিদৃষ্ট বেদনার অনুক্ত ইতিহাস—সমস্ত একসঙ্গে মিশিয়া ক্ষণকালের জন্য সাহেবকে অভিভূত করিয়া ফেলিল।

এই আচ্ছন্ন ভাবটা তাঁহার কাটিয়া গেল ফকিরের একটা কথার ধাক্কায় এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের দুর্বলতায় তিনি অকারণ লজ্জিত হইয়া তাঁহার কথার জবাবে খামকা রূঢ় হইয়া উঠিলেন। ফকির নিজেদের প্রথামত অভিবাদন করিয়া যখন জিজ্ঞাসা করিলেন, বাবুসাহেব, আপনি কি ডেকে পাঠিয়েছিলেন? বাবুসাহেব তখন উত্তর দিলেন, তোমাকে ডেকে পাঠাই নি, তুমি যেতে পারো।

ফকির রাগ করিলেন না। একটু হাসিয়া ষোড়শীকে দেখাইয়া শান্তস্বরে বলিলেন, আসামীকে কিন্তু আমিই হাজির করেচি বাবুসাহেব। উনি ত আসতেই চাননি। নেহাত দোষ দেওয়াও যায় না, কারণ সবাই মিলে হট্টগোল করে যে বিচার তাতে বিচারের চেয়ে অবিচারই বেশী হয়। আর সেও ত সকালবেলাই একদফা সাঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু আপনার নাম শুনে আমি বললুম, চল, মা, আমরা যাই। তিনি আইনজ্ঞ মানুষ, তাতে বাইরের লোক—যদি সম্ভব হয় তিনি সুমীমাংসাই করে দেবেন।

ব্যারিস্টার-সাহেব মনে মনে বুঝিলেন, এই ফকিরের সম্বন্ধে তিনি ভুল ধারণা করেন নাই। ইনি যেই হোন, অশিক্ষিত সাধারণ ভিক্ষুকশ্রেণীর নয়। সুতরাং প্রত্যুত্তরে তাঁহাকেও কতকটা ভদ্র হইতে হইল; কহিলেন, এঁরা ত তালা-ভাঙ্গা এবং অনধিকার-প্রবেশের জন্য পুলিশের হাতে দিয়ে ওঁকে প্রথমটা জেল খাটিয়ে নিতে চান। আর শুনলাম তালা-ভাঙ্গা নাকি আপনার হুকুমেই হয়েচে।

ফকির হাসিয়া কহিলেন, ওরে বাপ রে, একা কেবল অপরাধী নয়, তার সঙ্গে আবার তার সাহায্যকারী! কিন্তু বাবুসাহেব, আমি শুধু তালা ভাঙ্গবারই মতলব দিয়েচি, কিন্তু আইন ভাঙ্গবার পরামর্শ দিইনি। বাড়িটা দেবোত্তর সম্পত্তি, এবং মা ভৈরবীই তার অভিভাবিকা। তারাদাস খামকা যদি তালা বন্ধ না করতে যেতেন ত ভাল ভাল তালাগুলো এমন ভেঙ্গে নষ্ট করতে হতো না। তারাদাসের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, তারাদাস, ও বুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছিলেন বাবা? কিন্তু যেই দিন সুবুদ্ধি দেননি।

তারাদাস ইহার উত্তর দিতে পারিল না, এবং অন্য কেহও যখন কোন কথা খুঁজিয়া পাইল না, নির্বাক্‌ হইয়া রহিল, তখন শিরোমণি সাড়ম্বরে গাত্রোত্থান করিয়া কহিলেন, ওকে ভৈরবী কে করেছিল জানেন ফকির-সাহেব? সে ওই তারাদাস। এখন ও যদি ওকে না রাখতে চায় ত সে তার ইচ্ছা। এই আমার মত।

0 Shares