দেনা-পাওনা

পরিচ্ছেদ – নয়

মন্দির-সংক্রান্ত গোলযোগটা যে ওখানেই মিটিয়া শেষ হইয়া গেল না ষোড়শী তাহা ভাল করিয়াই জানিত; কিন্তু বিপত্তি যেদিক দিয়া তাহাকে পুনশ্চ আক্রমণ করিল তাহা সম্পূর্ণ অভাবনীয়। এখানে থাকিলে ফকিরসাহেব মাঝে মাঝে এমন আসিতেন বটে, কিন্তু মাত্র কাল সন্ধ্যাকালে তিনি গিয়াছেন, মাঝে একটা দিন কেবল গিয়াছে, আবার আজই প্রত্যুষে আসিয়া উপস্থিত হইবেন, এইরূপ তাঁহার কোনদিন নিয়ম নয়। ষোড়শী সেইমাত্র স্নান করিয়া আসিয়া নিত্যক্রিয়াগুলি সারিয়া লইতে ঘরে ঢুকিতেছিল, অসময়ে হঠাৎ তাঁহাকে দেখিয়া চিন্তিত হইল। তাড়াতাড়ি প্রণাম করিয়া, একটা আসন পাতিয়া দিয়া উদ্বিগ্ন-স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, এত সকালে যে?

তিনি উপবেশন করিয়া একটু হাসির চেষ্টা করিয়া কহিলেন, ফকির মানুষ, সংসারে সুখ-দুঃখের ধার বড় ধারিনে মা, তবুও কাল রাত্রিটায় ভাল করে ঘুমোতে পারিনি, ষোড়শী, দেহধারণের এমনই বিড়ম্বনা। কবে যে এটা মাটির তলায় যাবে!

ষোড়শী শারীরিক পীড়ার কথাই মনে করিয়া কহিল, আপনার কি কোন অসুখ করেচে?

ফকির ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না আমার শরীর ভালই আছে। কাল বিকেলে এঁরা সকলেই আমার কুটীরে পায়ের ধূলো দিয়েছিলেন, সঙ্গে জামাইবাবু-সাহেবও ছিলেন, এককড়িও ছিল। তাকে চিনি এই যা—নইলে সে অনেক কথাই বললে। তবুও দু-একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না মা!

ষোড়শী কহিল, বলুন।

ফকির বলিলেন, দেখ মা, আমি মুসলমান, তোমাদের দেব-দেবীর সম্বন্ধে আমার কৌতূহল থাকা উচিতও নয়, নেইও—কিন্তু তোমাকে আমি মা বলে ডাকি; তুমি কি জানিয়েছ স্বহস্তে আর কখনো চণ্ডীর পূজা করতে পারবে না?

ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, এ কথা সত্য।

ফকির বলিলেন, কিন্তু এতকাল ত তোমার সে বাধা ছিল না?

ইহার উত্তরে ষোড়শী যখন মৌন হইয়া রহিল, তখন তিনি কহিলেন, যাঁরা তোমাকে চান না তাঁরা যদি তোমার এই নূতন আচরণটা মন্দ বলেই গ্রহণ করেন, তাতে ত কোন জবাব দেওয়া যায় না ষোড়শী?

ইহারও কোনরূপ সদুত্তর দিবার চেষ্টা না করিয়া ষোড়শী যখন তেমনি নীরব হইয়া রহিল, তখন ফকিরের মুখও অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া উঠিল; তিনি নিজেও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া কহিলেন, এর কারণ বলবার হলে তুমি আমাকে নিশ্চয়ই বলতে। এ ছাড়া এককড়ি আরও একটা কথা বললে। সে বললে, জমিদারবাবু ভারী আশা করেছিলেন, তুমি তার সঙ্গে যাবে। এমন কি, আর একটা পালকি আনিয়ে যাই যাই করেও তাঁর শেষ পর্যন্ত ভরসা ছিল হয়ত তুমি ফিরে আসবে।

এবার ষোড়শী কথা কহিল, বলিল, তাঁর আশা-ভরসার জন্যও কি আমাকে দায়ী হতে হবে?

ফকির তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়া কহিলেন, নিশ্চয় না, নিশ্চয় না। কিন্তু কথাটা শুনতেও নাকি বিশ্রী, তাই উল্লেখ করলাম। আচ্ছা মা, যে ব্যাপারটায় সকল কুৎসিত কথার সৃষ্টি তার যথার্থ হেতুটা কি তুমি আমাকে বলতে পারো না? ও লোকটাকে যে তুমি কেন এমন করে বাঁচিয়ে দিলে এর কোন মীমাংসাই ত খুঁজে পাইনে ষোড়শী?

ষোড়শীর প্রথমে মনে হইল এ প্রশ্নেরও সে কোন উত্তর দিবে না, কিন্তু বৃদ্ধের উদ্বিগ্ন মুখের স্নেহ-করুণ চোখ-দুটির প্রতি চাহিয়া সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, কহিল, ফকিরসাহেব, ওই পীড়িত লোকটিকে জেলে পাঠানোই কি উচিত হতো?

ফকির বিস্মিত হইলেন, মনে মনে বোধ করি বা একটু বিরক্তও হইলেন, বলিলেন, সে বিবেচনার ভার ত তোমার নয় মা, সে রাজার। তাই তাঁর জেলেও হাসপাতাল আছে, পীড়িত অপরাধীরও তিনি চিকিৎসা করান। কিন্তু এই যদি হয়ে থাকে, তুমি অন্যায় করেচ বলতে হবে।

ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

ফকির বলিলেন, যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এর ত্রুটি শুধরে নিতে হবে।

ষোড়শী তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিল, তার অর্থ?

ফকির বলিলেন, ওই লোকটার অপরাধ ও অত্যাচারের অন্ত নেই, এ ত তুমি জানো! তার শাস্তি হওয়া উচিত।

এবার ষোড়শী বহুক্ষণ পর্যন্ত নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপরে মাথা নাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি সমস্ত জানি। তাঁকে শাস্তি দেওয়াই হয়ত আপনাদের উচিত, কিন্তু আমার কথা কাউকে বলবার নয়—তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আমি কোনদিন পারব না।

ফকির কহিলেন, ব্যাপার কি ষোড়শী?

ষোড়শী অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল, এবং বহুক্ষণ পর্যন্ত কাহারও মুখ দিয়া কোন বাক্যই বাহির হইল না। দাসী সংসারের কাজ করিতে আসিতেছিল, দ্বারের কাছে তাহাকে দেখিতে পাইয়া ফকির আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, এখন তা হলে আমি চললাম।

ষোড়শী কেবল হেঁট হইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিল; তিনি ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেলেন।

তাঁহার প্রশান্ত মুখের গম্ভীর বিষণ্ণতাই শুধু যে কেবল ষোড়শীর সমস্ত দিন সকল কাজকর্মের মধ্যেই যখন-তখন মনে হইতে লাগিল তাই নয়, যে অনুচ্চারিত বাক্য তিনি সহসা দমন করিয়া লইয়া নীরবে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন, তাহাও নানা আকারে নানা ছন্দে তাহার কানে বাজিতে লাগিল। সে যেন স্পষ্ট দেখিতে লাগিল এই সাধু ব্যক্তি যে শ্রদ্ধা, যে স্নেহ এতদিন তাহার প্রতি ন্যস্ত রাখিয়াছিলেন ঠিক কিছু না জানিয়াও আজ যেন তাহাকে খর্ব করিয়া লইয়া গেলেন। এই ক্ষতি যে কত বড়, তাহার পরিমাণ সে নিজে ছাড়া আর কেহই অধিক জানিত না।

কিন্তু তথাপি ইহাকে ফিরিয়া পাইবারও কোন পন্থা তাহার চোখে পড়িল না। তাহার বাল্য ইতিহাস কাহারও কাছে ব্যক্ত করা চলে না, এমন কি এই ফকিরের কাছেও না। কারণ ইহাতে যে-সকল পুরাতন কাহিনী উঠিয়া পড়িবে তাহা মেয়ের পক্ষে যতবড় লজ্জার কথাই হোক, তাহার যে মা আজ পরলোকে তাঁহাকেই সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে একেবারে পথের ধূলায় টানিয়া আনা হইবে। এবং এইখানেই ইহার শেষ নয়। স্বামিস্পর্শ ভৈরবীর একান্ত নিষিদ্ধ। কত যুগ হইতে এই নিষ্ঠুর অনুশাসন ইহাদিগকে অঙ্গীকার করিয়া আসিতে হইয়াছে। সুতরাং ভাল-মন্দ যাই হোক, জীবনানন্দের শয্যাপ্রান্তে বসিয়া একটা রাত্রির জন্যও তাহাকে যে-হাত দিয়া তাঁহার সেবা করিতে হইয়াছে, সেই হাত দিয়া আর যে দেবীর সেবা করা চলিবে না তাহা নিশ্চিত, অথচ এইখানেই এই দেবীর প্রাঙ্গণতলেই তারাদাস যখন তাহাকে অজ্ঞাতকুলশীল একজনের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিল তখন সে কোন আপত্তিই করে নাই; এবং সমস্ত জানিয়াও যে সে নিঃসঙ্কোচে এতকাল ভৈরবীর কার্য করিয়া আসিয়াছে, ইহার জবাবদিহি আজ যদি সমস্ত ক্রুদ্ধ হিন্দুসমাজের কাছে করিতে হয়, ত সে যে কি হইবে সে তাহার চিন্তাতীত। আবার এ-সকল ত গেল কেবল একটা দিকের কথা, কিন্তু যে দিকটা একেবারেই তাহার আয়ত্তাতীত, তথায় কি যে হইবে সে তাহার কি জানে? যে জীবানন্দ একদিন তাহাদের বিবাহটাকে কেবল পরিহাস করিয়া গিয়াছিল, সে যদি আজ সমস্ত ইতিহাসটাকে নিছক গল্প বলিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দেয়, ত তাহাকে সত্য বলিয়া সপ্রমাণ করিতে সে নিজে ছাড়া আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জীবিত নাই।

0 Shares