দেনা-পাওনা

সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, কৈ, ফকির ত এখনো এলেন না, আসবেন বলে কি আপনার আশা হয়?

ষোড়শী অতি মৃদুস্বরে উত্তর দিল, কি জানি, বোধ হয় না-ও আসতে পারেন।

বসু কহিলেন, ফকিরসাহেবের জিনিসপত্র কি ছিল আমি জানিনে, কিন্তু তাঁর ঘরটি ত একেবারে খালি – এমন হঠাৎ চলে যাওয়া কি আপনার সম্ভব মনে হয়?

ষোড়শী তেমনি আস্তে আস্তে বলিল, একেবারে অসম্ভবও নয়। এমনি সহসা তিনি মাঝে মাঝে কোথায় চলে যান।

আবার কতদিনে ফিরে আসেন?

কিছু ঠিক নেই। এবার ত প্রায় বছর-তিনেক পরে ফিরে এসেছিলেন।

বসু কহিলেন, তা হলে চলুন আমরা বাড়ি ফিরে যাই।

চলুন, বলিয়া ষোড়শী অগ্রসর হইতেই বসু কহিলেন, কিন্তু যাবার সুযোগ ত দেখচি ষোল আনাই হয়েচে। একে ত বালির ওপর পথের চিহ্নমাত্র নেই, তাতে অন্ধকার এমনি যে নিজের হাত-পা পর্যন্ত দেখা যায় না।

ষোড়শী নীরবে ধীরে ধীরে চলিতে শুরু করিয়াছিল, কিছুই বলিল না।

বসু কহিলেন, হাওয়ার শব্দে বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বৃষ্টি পড়চে। গাছতলা পার হলেই ভিজতে হবে। এ কথাতেও ষোড়শী যখন কথা কহিল না, তখন বসু কহিলেন, দেখুন, পথঘাট আমি কিছুই চিনিনে, তা ছাড়া শুনেচি এ অঞ্চলে সাপখোপের ভয়টাও খুব বেশী। এই ভয়ানক অন্ধকারে কি—

ষোড়শী থামিল না, চলিতে চলিতেই কহিল, পথ আমি চিনি। আপনি আমার ঠিক পিছনে পিছনে আসুন।

বসুসাহেব হাসিলেন, কহিলেন, অর্থাৎ সর্পাঘাতের দুর্ঘটনা ঘটে ত আপনার উপর দিয়েই যাক। তা বটে! আপনি সন্ন্যাসিনী, এ প্রস্তাব আপনি করতেও পারেন, কিন্তু আমার মুশকিল এই যে, আমিও পুরুষমানুষ। অবশ্য এ কথা আপনি কাউকে বলবেন না জানি, এমন কি হৈমকেও না, কিন্তু তবুও ওটা ঠিক পেরে উঠব না।

এবার ষোড়শী থমকিয়া দাঁড়াইল। অন্ধকারে দেখা গেল না বটে, কিন্তু সাহেবের কথা শুনিয়া তাহারও মুখে হাসি ফুটিল। মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া কহিল, আপনি তা হলে কি-রকম করতে বলেন?

সাহেব কহিলেন, বলা শক্ত। কিন্তু পরামর্শ স্থির হবার পূর্বেই ভিজে উঠতে হবে। বটপত্রে আর বৃষ্টি মানচে না।

কথাটা সত্য। কারণ উপরের জলধারা ফোঁটায় ফোঁটায় নীচে নামিতে শুরু করিয়াছিল। ষোড়শী কহিল, আপনি বরঞ্চ ওই ঘরটার মধ্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি হৈমকে খবর দিয়ে আলো এবং লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিই গে। আমার অভ্যাস আছে, এ জলে বিশেষ ক্ষতি হবে না।

সাহেব কহিলেন, অত্যন্ত মনোরম প্রস্তাব। কারণ, বাঙালী সাহেব হয়ে উঠলে যা হন সে আপনি বেশ জানেন দেখচি। কিন্তু আমার সম্বন্ধে আজও একটুখানি ত্রুটি রয়ে গেছে, হৈম মাঝে থাকায় আমার ভেতরের সঙ্গে বাইরের এখনও সম্পূর্ণ একাকার হয়ে উঠতে পায়নি। এ প্রস্তাবও অচল, সুতরাং চলাই স্থির। চলুন।

বৃক্ষতল ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দু’জনেই বুঝিলেন, অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ, বায়ুবেগে বৃষ্টিধারাই যে কেবল গায়ে সূচের মত বিঁধিতেছে তাই নয়, ইতিপূর্বে যে শুষ্ক বালুকারাশি আকাশ ব্যাপ্ত করিয়া শূন্যে উড়িয়াছে জলধারায় ধুইয়া মাটিতে না পড়া পর্যন্ত চোখ চাহিয়া পথ চলা দুঃসাধ্য।

নিঃশব্দে চলিতে চলিতে ষোড়শী হঠাৎ পিছনে শব্দ শুনিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আপনার লাগল নাকি?

বসুসাহেব কোনমতে সামলাইয়া লইয়া সোজা হইয়া কহিলেন, হাঁ, কিন্তু প্রত্যাশার অতিরিক্ত কিছু নয়। চশমাসুদ্ধ চোখ আমার চারটে বটে, কিন্তু দৃষ্টিশক্তিটা চার ভাগের এক ভাগ থাকলেও বাঁচতাম। চলুন।

ষোড়শী চলিল না, একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি সত্যিই ভাল দেখতে পাচ্চেন না?

বসু কহিলেন, সত্যি। তারপরে ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, বিস্তর ইংরাজী বই মুখস্ত করে সাহেব হতে হয়েচে—তার দক্ষিণাটাও তারা বেশ বড় করেই নিয়েচে। কিন্তু তাই বলে আর দাঁড়িয়ে ভেজাবেন না—এগোন, দু’চক্ষু বুজে চললে যতটা দেখতে পাওয়া যায়, আমি ততটা দেখতে পাবই, এ আমি আপনাকে নিশ্চয় ভরসা দিচ্চি।

ষোড়শীর কণ্ঠস্বর করুণায় কোমল হইয়া উঠিল, কহিল, তা হলে নদীটা পার হতে আপনার ত ভারী কষ্ট হবে!

বসু বলিলেন, তা ঠিক জানিনে। তবে নদী পার হবার পূর্বেও বিশেষ আরাম পাচ্চিনে। কিন্তু তাই বলে এই মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও সমস্যার মীমাংসা হবে না।

ষোড়শী এক পা অগ্রসর হইয়া আসিয়া কহিল, আপনি আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে আসুন, এই বলিয়া সে তাহার হাতখানি বাড়াইয়া দিল।

এই অপরিচিতা নারীর আচরণ ও সাহস দেখিয়া বাক্‌পটু ব্যারিস্টার ক্ষণকালের জন্য বিস্ময়ে নির্বাক্‌ হইয়া গেলেন। কিন্তু সে ওই ক্ষণকালমাত্রই। তারপরে সেই প্রসারিত হাতখানি নিঃশব্দ ব্যগ্রতায় আশ্রয় করিয়া আস্তে আস্তে কহিলেন, চলুন। এইবার আমি সত্যি সত্যিই দু’চক্ষু বুজে চলতে পারব।

ষোড়শী ইহার কোন উত্তর দিল না। উভয়ে ধীরে ধীরে কিছুদূর অগ্রসর হইলে বসুসাহেব অকস্মাৎ বলিয়া উঠিলেন, আপনার প্রতি আমি সেদিন ভদ্র ব্যবহার করিনি। তার জন্যে ক্ষমা চাইচি, আপনি আমাকে মাপ করবেন।

ষোড়শী এ কথার উত্তরেও কিছুই বলিল না, তেমনি নিঃশব্দে ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।

বসু কহিলেন, আপনি হৈমর ছেলেবেলার বন্ধু। আমার সেদিনের আচরণ যাই হোক, আমাকেও ঠিক শত্রু বলেই মনে রাখবেন না। বলিয়া তাহার হাতের উপর একটুখানি চাপ দিলেন।

ষোড়শী একেবারেই নির্বাক। বসুসাহেব নিজেও কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, এঁরা যে আপনাকে সহজে ছাড়বেন তা মনে হয় না। খুব সম্ভব মামলা-মকদ্দমাও হবে। ফকিরসাহেব হয়ত সত্যিই চলে গেছেন, আমিও বোধ হয় থাকব না—

ষোড়শী কিছুই বলিল না। তিনি নিজেও একটু মৌন থাকিয়া পুনশ্চ কহিলেন, আপনি নিজে আর দেবীর পূজো করবেন না বলেচেন, এ কি রাগ করে?

ষোড়শী এবার জবাব দিল, কহিল, না।

তা হলে এর কি সত্যিই কোন কারণ আছে?

0 Shares