দেনা-পাওনা

হৈম একপাশে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া সমস্তই দেখিতেছিল, পিতার আশঙ্কাও তাহার দৃষ্টি এড়ায় নাই, কিন্তু তখন পর্যন্ত সে ভিতরের আসল কথাটা জানিত না। এইটাই আত্মপ্রকাশ করিল তাহার জননীর কথায়। তিনি হঠাৎ বাহিরে আসিয়া স্বামীকে কঠোর অনুযোগ করিয়া বলিয়া উঠিলেন, সে জামাই মানুষ, তাকে কেন তোমাদের ঝগড়ার মধ্যস্থ মানা? যার পেছনে ডাকাতের দল রয়েচে তাকে করবে তোমরা জব্দ? যেখানে পাও আমার নির্মলকে খুঁজে এনে দাও, নইলে যেখানে দু’চক্ষু যায় এই অন্ধকারে আমি বেরিয়ে যাবো। বলিয়া তিনি কাঁদ-কাঁদ হইয়া অন্তঃপুরে চলিয়া গেলেন, এবং কিছুক্ষণের জন্য কন্যা ও পিতা উভয়েই নির্বাক্‌ বিবর্ণমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিলেন।

জনার্দন রায় আত্মসংবরণ করিয়া সান্ত্বনা ও সাহসসূচক কি একটা কথা হৈমকে বলিতে যাইতেছিলেন, ঠিক এমনি সময়ে জামাতা প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গ বাহিয়া জল ঝরিতেছে, জামা-কাপড় জুতা কাদামাখা। শ্বশুরের মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল—কিন্তু পরক্ষণেই যে সাহেব জামাইকে তিনি যথেষ্ট খাতির এবং ভয় করিতেন, তাহাকেই আনন্দের উৎকট প্রাবল্যে যা মুখে আসিল তাই বলিয়া তিরস্কার করিতে লাগিলেন।

সাহেব নিঃশব্দে উঠিয়া আসিয়া হাতের ভাঙ্গা ছড়িটা রাখিয়া দিলেন, এবং পায়ের জুতা হাত দিয়া টানিয়া ফেলিয়া গায়ের ভিজা জামাটা খুলিয়া ফেলার মধ্যে ছোট-বড়, উচ্চ-নীচ, আত্মীয়-পর সকলে একযোগে ও নির্বিশেষে প্রশ্ন করিতে লাগিল, কি করিয়া এ দুরবস্থা ঘটিল এবং কোথায় ঘটিল?

রায়মহাশয় প্রকৃতিস্থ হইয়া কহিলেন, আচ্ছা, সে পরে হবে, তুমি বাড়ির ভেতরে যাও। মা হৈম, দাঁড়িয়ে থেকো না, একটা শুকনো কাপড়চোপড় দাও গে।

বাটীর মধ্যে শাশুড়ী ও সমবেত কুটুম্বিনীগণের প্রশ্নের উত্তরে নির্মল জানাইল, সে ওপারে ফকিরসাহেবের সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল, কিন্তু সাক্ষাৎ হয় নাই, তিনি আশ্রমে নাই।

ওপারের নামে একপ্রকার আতঙ্কসূচক অস্ফুট ধ্বনি উঠিল। রায়মহাশয় আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া! আমাকে বললে ত তাকে ডেকে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু এই অন্ধকারে পথ চিনলে কি করে?

নির্মল কহিল, পথ চেনবার আমার দরকার হয়নি, হলে পারতাম না।

কিন্তু এলে কি করে?

একজন আমাকে হাত ধরে এনে বাড়ির সামনে দিয়ে গেছেন।

চতুর্দিকে প্রশ্ন উঠিল—কে? কে? কি নাম তার?

নির্মল একটুখানি স্থির থাকিয়া কহিল, কি জানি, নামটা জানাতে হয়ত তাঁর আপত্তি আছে।

রায়মহাশয় প্রতিবাদ করিয়া কহিলেন, আপত্তি? কখ্‌খনো না, আমাদের দেশের লোককে তুমি চেনো না। কিন্তু যেই হোক তাকে খুশী করে দেওয়া চাই ত? বলিয়া চাকরটাকে তৎক্ষণাৎ ডাকিয়া হুকুম করিয়া দিলেন, অধর, চাটুয্যে যদি বাইরে থাকে, এখনি বলে দে কাল সকালেই খবর নিয়ে যেন বকশিশ দেওয়া হয়। পুরো টাকাই যেন তার হাতে পড়ে—কেটে যেন কিছু না রাখে। চাটুয্যেটা আবার যে কৃপণ! বলিয়া তিনি ঔদার্যের আবেগে প্রথমে গৃহিণী ও পরে কন্যা-জামাতার মুখের প্রতি সদয় দৃষ্টিপাত করিলেন।

রাত্রে আহারাদির পর নিরালা ঘরের মধ্যে স্বামীকে একাকী পাইয়া হৈম কহিল,বাবা ত পুরস্কারের ঘোষণা করে দিলেন, পুরো টাকাটা দেবার চেষ্টাও হয়ত কিছু হবে, কিন্তু ফল হবে না।

নির্মল কহিল, না, আসামীকে পাওয়া যাবে না।

হৈম একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু তুমি সেই দয়ালু লোকটিকে কি পুরস্কার দিলে?

নির্মল কহিল, দেওয়া জিনিসটা কি তুমি এতই সহজ মনে কর? ও কি কেবলমাত্র দাতার মর্জির উপরেই নির্ভর করে?

তা হলে দিতে পারোনি?

না, দেবার চেষ্টাও করিনি।

হৈম স্বামীর মুখের প্রতি একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু আমার উচিত। বাবা তাঁকে বার করতে পারবেন না, কিন্তু আমি পারব।

নির্মল সন্দেহ প্রকাশ করিয়া কহিল, আমার মনে হয় তোমার বাবার মত তুমিও তাঁকে খুঁজে পাবে না।

হৈম বলিল, যদি পাই ত আমাকেও কিছু পুরস্কার দিয়ো। কিন্তু আমি তাঁকে চিনেছি। কারণ তোমার মত অন্ধ মানুষকে যে এই ভয়ানক অন্ধকারে নির্বিঘ্নে নদী পার করে ঘরের সামনে রেখে যেতে পারে, অথচ আত্মপ্রকাশ করে না, তাকে চিনতে পারা শক্ত নয়। তা ছাড়া সন্ধ্যার আঁধারে গা ঢেকে আমিও একবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ঘরদোর খোলা; তিনি নেই বটে, কিন্তু তারাদাস ঠাকুর সমস্ত দখল করে বসে আছেন।

লুকিয়ে পালিয়ে এলাম। পথে একজন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলো, সে বলে দিলে, ষোড়শীকে সে সোজা নদীর পথে যেতে দেখেচে। এখন বুঝলে, যে দয়ালু লোকটি তোমাকে দিয়ে গেছেন তাঁকে আমি চিনি। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি একেবারে হাত ধরে রেখে গেছেন?

নির্মল ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, সত্যই তাই। যে মুহূর্তে তিনি নিশ্চয় বুঝলেন আমি অন্ধের সমান, সেই মুহূর্তে নিঃসঙ্কোচে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার হাত ধরে আসুন। কিন্তু পরের জন্য এ কাজ তুমি পারতে না।

হৈম অত্যন্ত সহজে স্বীকার করিয়া কহিল, না।

তাহার স্বামী কহিল, তা জানি। ইহার পরে কি করিয়া কি হইল সমস্ত ঘটনা একে একে বিবৃত করিয়া কহিল, অথচ এ ছাড়া আমার পক্ষে যে কি উপায় ছিল জানিনে। আবার ওদিকে তাঁর বিপদের গুরুত্বটা একবার ভেবে দেখ। আমাকে তিনি সামান্যই জানতেন এবং তাও বোধ হয় ভাল করে জানতেন না। তবুও আমাকেই এই যে নির্জন অন্ধকার পথ দিয়ে নিয়ে এলেন, এর দায়িত্বটা কত বিশ্রী, কত ভয়ঙ্কর! বস্তুতঃ পথ চলতে চলতে আমার অনেকবার ভয় হয়েচে যদি কারো সুমুখে পড়ি, তার চোখে এটা কি রকম দেখাবে? দেখ হৈম, তোমাদের দেবীর এই ভৈরবীটিকে আমি চিনতে পারিনি সত্যি, কিন্তু এটুকু আজ নিশ্চয় বুঝেচি এঁর সম্বন্ধে বিচার করার ঠিক সাধারণ নিয়ম খাটে না। হয় সতীত্ব জিনিসটা এঁর কাছে নিতান্তই একটা বাহুল্য বস্তু—তোমাদের মত তার যথার্থ রূপটা ইনি চেনেন না, না হয় এর সুনাম-দুর্নাম একে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে না।

0 Shares