দেনা-পাওনা

তারাদাসটা কে?

এককড়ি কহিল, গড়চণ্ডীর সেবায়েত।

এই সেবায়েতদিগের সহিত জমিদারি সংস্পর্শে এককড়ির অনেক কলহ-বিবাদ হইয়া গেছে, কিন্তু সেজন্য তাহার বিশেষ কোন ক্ষোভ ছিল না; কিন্তু বৎসর-দুই পূর্বে একটা পাকা কাঁঠাল গাছ লইয়া যে লড়াই বাধে, সে জ্বালা তাহার যায় নাই। কারণ কাঁঠালের তক্তাগুলা ছিল তাহার নিজের বাটীর জন্য এবং সেই হেতু শেষ পর্যন্ত তাহাকেই নতি স্বীকার করিয়া গোপনে মিটমাট করিয়া লইতে হয়।

এককড়ি কহিতে লাগিল, কি করব হুজুর, সদরে আরজি করে সুবিচার পাই নে—দেওয়ানজী গেরাহ্যিই করেন না, নইলে চক্কোত্তিকে ঢিট্‌ করতে কতক্ষণ লাগে! কিন্তু এও নিবেদন করচি, হুজুর আশকারা দিলে ওরা প্রজা বিগড়ে দেবে—তখন গাঁ শাসন করা ভার হবে।

হুজুরের কিন্তু নেশা বাড়িয়া উঠিতেছিল, তিনি নিস্পৃহ জড়িত-কণ্ঠে বলিলেন, তুমি তারাদাসের নামটাই ত করলে, এককড়ি—আবার ওরা এল কারা?

এককড়ি কহিল, চক্কোত্তির মেয়ে ভৈরবী। নইলে চক্কোত্তিমশাই নিজে তত লোক মন্দ নয়, কিন্তু মেয়েটাই হচ্চে আসল সর্বনাশী। দেশের যত বোম্বেটে বদমাশগুলো হয়েচে যেন একেবারে তার গোলাম।

জমিদারবাবুর কানে বোধ করি সমস্ত কথাগুলি পৌঁছিল না। তিনি তেমনি অস্ফুটস্বরে বলিলেন, হবারই কথা। কত বয়স? দেখতে কেমন?

এককড়ি কহিল, বয়স তেইশ-চব্বিশ হতে পারে। আর রূপের কথা যদি বলেন হুজুর, ত সে যেন এক কাটখোট্টা সেপাই। না আছে মেয়েলী ছিরি, না আছে মেয়েলী ছাঁদ। যেন চুয়াড়, যেন হাতিয়ার বেঁধে লড়াই করতে চলেছে। তাতেই ত দেশের ছোটলোকগুলো মনে করে গড়ের উনিই হচ্চেন সাক্ষাৎ চণ্ডী।

জীবানন্দ অকস্মাৎ সোজা উঠিয়া বসিলেন। উৎসাহ ও কৌতূহলে দুই রক্তচক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, বল কি এককড়ি? ব্যাপারটা কি খুলে বল ত শুনি? না হয় চুয়াড়ের মতই দেখতে, তবু ত গৃহস্থ ব্রাহ্মণের মেয়ে—সর্বনাশীই বা হল কি করে, আর বোম্বেটে বদমাশের দলই বা তার জুটলো কোথা থেকে?

এককড়ি কহিল, তা আর আশ্চর্যি কি হুজুর! বলিয়া সে ভৈরবীর যে ইতিহাসটা দিল তাহা সংক্ষেপে এইরূপ—

ভৈরবী কাহারও নাম নয়, গড়চণ্ডীর প্রধান সেবিকাদের ইহা একটা সাধারণ উপাধি। যেমন বর্তমান ভৈরবীর নাম ষোড়শী এবং ইহার পূর্বে যিনি ছিলেন তাঁহার নাম ছিল মাতঙ্গিনী ভৈরবী। মাতার আদেশে তাঁহার সেবায়েত কখনও পুরুষ হইতে পারে না, মেয়েরাই এ পদ চিরদিন অধিকার করিয়া আসিতেছে।

আন্দাজ বৎসর পনর-ষোল হইবে হঠাৎ একদিন জানা যায় মাতঙ্গিনী ভৈরবীর স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে। কথাটা অনেক কষ্টে যখন সত্য বলিয়াই প্রমাণিত হয়, তখন বাধ্য হইয়া মাতঙ্গিনীকে পদত্যাগ করিয়া কাশী চলিয়া যাইতে হয়।

জীবানন্দ এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, বিধবা হলে বুঝি ভৈরবীগিরি খারিজ হয়ে যায়?

এককড়ি কহিল, হাঁ হুজুর।

তাই বুঝি তিনি স্বামীটিকে অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছিলেন?

এককড়ি বলিল, সে ছাড়া আর ত কোন উপায় নেই হুজুর! মায়ের আদেশে বিয়ের তেরাত্রি পরে স্বামীর আর ভৈরবী স্পর্শ করিবারও জো নেই। তাই দূরদেশ থেকে দুঃখী গরীবের একটা ছেলে ধরে এনে বিয়ে দিয়ে পরের দিনই টাকাকড়ি দিয়ে সেই যে বিদায় করা হয়, আর কখনো কেউ তার ছায়া পর্যন্ত দেখতে পায় না। এই-ই নিয়ম, এই-ই চিরকাল ধরে হয়ে আসচে।

জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, বল কি এককড়ি, এক্কেবারে দেশান্তর? ভৈরবী মানুষ, রাত্রে নিরিবিলি একপাত্র সুরা ঢেলে দেওয়া—গরম মসলা দিয়ে চাট্টি মহাপ্রসাদ রেঁধে খাওয়ানো—একেবারে কিছুই করতে পায় না?

এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, না হুজুর, মায়ের ভৈরবীকে স্বামী স্পর্শ করতে নেই; কিন্তু তাই বলে কি স্বামী ছাড়া গাঁয়ে আর পুরুষ নেই? মাতু ভৈরবীকেও দেখেচি, ষোড়শী ভৈরবীকেও দেখচি। লোকগুলো কি আর খামকা তার পায়ে পায়ে জড়ায়! কথায় কথায় হুজুরের সঙ্গেই মামলা-মকদ্দমা বাধিয়ে দেয়।

জীবানন্দ হাসিয়া কহিলেন, মেয়ে-মোহন্ত আর কি! তার দোষ নেই; কিন্তু মাতুর পরে ইনি জুটলেন কি করে?

এককড়ি বলিল, চক্কোত্তিমশাই হচ্চেন মাতঙ্গিনীর ভাগ্নে। ঢাকা না কোথায় কোন্‌ মহাজনের আড়তে খাতা লিখছিলেন, চিঠি পেয়ে চলে এলেন, সঙ্গে একটা বছর-দশেকের মেয়ে। কোথা থেকে একটা পাত্রও জুটিয়ে আনলেন—কি জাত, কার ছেলে, কোথায় ঘর—রাতারাতি বিয়ে হল, রাতারাতি চালান দিয়ে দিলেন—তারপর দিব্যি গদিতে বসিয়ে রাজভোগে আছেন। কেবা কথা কয়, কেবা জিজ্ঞেসা করে? গাঁয়েও মানুষ নেই, রাজারও শাসন নেই! বলিয়া সে জমিদারকেই কটাক্ষ করিল। কিন্তু চাহিয়া বুঝিল এ বক্রোক্তি নিষ্ফল হইয়াছে। রাজা নিমীলিতচক্ষে এক নিমিষেই যেন তন্দ্রাভিভূত হইয়া পড়িয়াছেন।অনেকক্ষণ পর্যন্ত কোন কথা নাই—পাছে তাহার কিছুমাত্র অবিবেচনায় এই তন্দ্রা ভাঙ্গিয়া যায়, এই ভয়ে সে পুত্তলিকার ন্যায় নিশ্চল দাঁড়াইয়া মনে মনে মাতালের পিতৃপুরুষের আদ্যশ্রাদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া যাইবে কিনা ভাবিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ ঠিক সহজ মানুষের মতই পুনরায় কথা কহিলেন। বলিলেন, বছর-পনর পূর্বে না? আচ্ছা, এই তারাদাস লোকটা কি দেখতে খুব বেঁটে আর ফরসা?

এককড়ি কহিল, না হুজুর, চক্কোত্তিমশায়ের রঙ ফরসা বটে, কিন্তু ইনি খুব দীর্ঘাঙ্গ।

দীর্ঘাঙ্গ? আচ্ছা, লোকটা যে ঢাকায় মহাজনের গদিতে খাতা লিখত এ তুমি জানলে কি করে? এমন ত হতে পারে সে কলকাতায় রাঁধুনি বামুনের কাজ করত?

এককড়ি মাথা নাড়িয়া বলিল, না হুজুর, সত্যিই তিনি খাতা লিখতেন। তাঁর ছ’মাসের মাইনে বাকী ছিল, আমিই নালিশ করবার ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখে টাকাটা আদায় করে দিই।

জীবানন্দ কহিলেন, তা হলে সত্যি। আচ্ছা, এই লোকটাই কি বছর-পাঁচেক পূর্বে একটা প্রজা উৎখাতের মামলায় মামার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল?

0 Shares