দেনা-পাওনা

কোথায়?

এই যে কাছারিবাড়িতে। সকাল থেকে এসেই প্রজার নালিশ শুনচেন। যদি অনুমতি করেন ত পালকি আনতে পাঠিয়ে দিই?

সকলে হাঁ করিয়া শুনিতেছিল; ষোড়শীর মনে হইল তাহারা যেন এই কথায় হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছে।তাহার ভিতরটা অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু মুহূর্তে আত্মসংবরণ করিয়া কহিল, এটা তাঁর প্রস্তাব, না, তোমার সুবিবেচনা এককড়ি?

এককড়ি সসম্ভ্রমে বলিল, আজ্ঞে, আমি ত চাকর, এ স্বয়ং হুজুরের আদেশ।

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, তোমার হুজুরের কপাল ভাল।জেলের ঘানি টানার বদলে পালকি চড়ে বেড়াচ্চেন, তাও আবার শুধু স্বয়ং নয়, পরের জন্যও ব্যবস্থা করচেন।কিন্তু বল গে এককড়ি, আমার পালকি চড়ার ফুরসত নেই—আমার ঢের কাজ।

এককড়ি কহিল, ও-বেলায় কিংবা কাল সকালেও কি একটু সময় পাবেন না?

ষোড়শী কহিল, না।

এককড়ি কহিল, কিন্তু হলে যে ভালো হতো। আর দশজন প্রজার যে নালিশ আছে।

ষোড়শী কঠোরস্বরে উত্তর দিল, বিচার করবার মত বিদ্যেবুদ্ধি থাকে ত তাঁর নিজের প্রজার করুন গে। কিন্তু আমি তোমার হুজুরের প্রজা নই, আমার বিচার করবার জন্যে রাজার আদালত আছে। এই বলিয়া সে গামছাটা কাঁধের উপর ফেলিয়া পুষ্করিণীর উদ্দেশে দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

পরিচ্ছেদ – তের

জমিদারের নিভৃত-নিবাস সাজাইতে গুছাইতে দিন-চারেক গিয়াছে। জনশ্রুতি এইরূপ যে, হুজুর এবার একাদিক্রমে মাস-দুই চণ্ডীগড়ে বিশ্রাম করিয়া যাইবেন। আজ সকালবেলাতেই উত্তরদিকের বড় হলটায় মজলিশ বসিয়াছিল। ঘরজোড়া কার্পেট পাতা, তাহার উপরে সাদা জাজিম বিছানো এবং মাঝে মাঝে দুই-চারিটা মোটা তাকিয়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। গৃহের একধারে আজ গ্রামের মাতব্বরেরা বার দিয়া বসিয়াছিলেন—জমিদারের কাছে তাঁহাদের মস্ত নালিশ ছিল। রায়মহাশয় ছিলেন, শিরোমণি ছিলেন, ঘোষজা ছিলেন, বোসজা ছিলেন, এমন কি তারাদাস ঠাকুরও ইঁহাদের আড়ালে মুখ নীচু করিয়া ও কান খাড়া করিয়া সতর্ক হইয়া বসিয়াছিলেন। আরও যাঁহারা যাঁহারা ছিলেন তাঁহাদের কেহই যদিচ অবহেলার বস্তু নহেন, তবুও ইঁহাদের নাম ধাম ও বিবরণ সবিস্তারে বিদিত না হইলেও পাঠকের জীবন দুর্ভর হইয়া উঠিবে না বিবেচনা করিয়াই তাহাতে নিরস্ত হইলাম। যাই হোক, ইঁহাদের সমবেত চেষ্টায় অভিযোগের ভূমিকাটা একপ্রকার শেষ হইয়া গেলেও আসল কথাটি উঠি-উঠি করিয়াও থামিয়া যাইতেছিল—ঠিক যেন মুখে আসিয়াও কাহারও বাহির হইতে চাহিতেছিল না।

জীবানন্দ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সকলের সঙ্গে থাকিয়াও একটুখানি দূরে একটা তাকিয়ার উপর দুই কনুয়ের ভর দিয়া বসিয়া তিনি মন দিয়াই যেন সমস্ত শুনিতেছিলেন। মন প্রফুল্ল। একেবারে স্বাভাবিক না হইলেও সম্পূর্ণ কৃত্রিম বলিয়াও সন্দেহ হয় না। খুব সম্ভব মদের ফেনা তখনও তাঁহার মগজের সমস্ত অলিগলি দখল করিয়া বসে নাই। সুমুখের বড় বড় খোলা দরজা দিয়া বারুইয়ের শুক্‌না বালু ও ভিজা মাটির গন্ধ বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছিল, এবং পাশের ঘরটাতেই বোধ করি রান্না হইতেছিল বলিয়া তাহারই রুদ্ধ দ্বারের কোন্‌ একটা ফাঁক দিয়া একজাতীয় শব্দ ও গন্ধ মাঝে মাঝে এই বাতাসেই ভর দিয়া লোকের কানে ও নাকে আসিয়া পৌঁছিতেছিল, তাহা ব্যক্তিবিশেষের কাছে উপাদেয় ও রুচিকর হইলেও শিরোমণিমহাশয় চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিলেন। হঠাৎ তিনি বার-দুই কাশিয়া ও উত্তরীয়-প্রান্তে নাকের ডগাটা মার্জনা করিয়া, উঠিয়া গিয়া আর এক ধারে বসিতেই জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, শিরোমণিমশায়ের কি অর্ধভোজন হয়ে গেল নাকি?

অনেকেই হাসিয়া উঠিল, শিরোমণির নাকের ডগার মত মুখখানাও রাঙ্গা হইয়া উঠিল। জীবানন্দ তখন হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই ঠাকুর, জাত যাবে না; ওটা আপনাদের মাচণ্ডীরই মহাপ্রসাদ। তবে যিনি রাঁধচেন তাঁর গোত্রটি ঠিক জানিনে, হয়ত এক না হতেও পারে।

শিরোমণি আপনাকে কতকটা সামলাইয়া লইয়া কহিলেন, তা হোক, তা হোক। ব্রাহ্মণ পাচক—দরিদ্র হলেও একটা গোত্র আছে বৈ কি।

জীবানন্দ হাঃ হাঃ করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া কহিলেন, জানিনে ঠাকুর, ও-সব বালাই ওর কিছু আছে কি না। কিন্তু হাতা-বেড়ির সঙ্গে মিলে সোনার চুড়ির আওয়াজটাও আমার বড় মিঠে লাগে। আর সেই হাতে পরিবেশন করলে—তা নিমন্ত্রণ করলে ত আর—, বলিয়া তিনি পুনশ্চ প্রবল হাসির শব্দে ঘর ভরিয়া দিলেন।

শিরোমণি অধোবদন হইলেন, এবং ভিতরের কদর্য ব্যাপার যদিচ সকলেই জানিতেন, তথাপি এই অভাবনীয় প্রকাশ্য নির্লজ্জতায় উপস্থিত কেহই লোকটার মুখের প্রতি সহসা চাহিতে পর্যন্ত পারিল না।

হাসি থামিলে তিনি কহিলেন, সদালাপ ত হলো। এবং দয়া করে মাঝে মাঝে এলে এমন আরও ঢ়ের হতে পারবে, কিন্তু আপনাদের নালিশটা কি শুনি?

কিন্তু উত্তরে কাহারও মুখে কথা ফুটিল না, সকলে যেমন নীরবে বসিয়াছিল তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল।

জীবানন্দ কহিলেন, বলতে কি আপনাদের লজ্জাবোধ হচ্চে?

এবার রায়মহাশয় মুখ তুলিয়া চাহিলেন; বলিলেন, নন্দীমশাই ত সমস্ত জানেন, তিনি কি হুজুরের গোচর করেন নি?

জীবানন্দ কহিলেন, হয়ত করেচেন, কিন্তু আমার মনে নেই। তা ছাড়া, তার গোচর করার প্রতি খুব বেশী আস্থা না রেখে ব্যাপারটা আপনারাই বলুন। দ্বিরুক্তি দোষ ঘটতে পারে, কিন্তু কি আর করা যাবে। জমিদারের গোমস্তা—একটু মোকাবিলে হয়ে থাকা ভাল। ঠিক না?

প্রভুর মুখে এককড়ির এই সুখ্যাতিটুকুতে রায়মহাশয় মনে মনে আনন্দ লাভ করিলেন। কিন্তু চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া পরম গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন, হুজুর সর্বজ্ঞ। ভৃত্যের সম্বন্ধে যথা ইচ্ছা আদেশ করতে পারেন, কিন্তু, আমাদের অভিযোগ—

কি অভিযোগ?

জনার্দন রায় কহিলেন, আমরা গ্রামস্থ ষোল আনা ইতর-ভদ্র একত্র হয়ে—

জীবানন্দ একটু হাসিয়া বলিলেন, তা দেখতে পাচ্চি। ওইটি কি সেই ভৈরবীর বাপ তারাদাস ঠাকুর নয়? এই বলিয়া তিনি তাহার প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেত করিলেন।

0 Shares