দেনা-পাওনা

আজ্ঞে না।

তা হলে লিখে দাও যে জমি তারা পাবে। দেরি করো না।

না, দিচ্চি লিখে, এই বলিয়া সে এককড়িকে সঙ্গে লইয়া প্রস্থান করিল। আবার কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত গৃহটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। শিরোমণি উঠিয়া দাঁড়াইয়া আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, আমরা আজ তা হলে আসি?

আসুন।

রায়মহাশয় হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া কহিলেন, অনুমতি হয় ত আর একদিন চরণ দর্শন করতে আসব।

বেশ, আসবেন।

সকলেই ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। বাহিরে আসিয়া তাঁহারা জমিদারের হাঁক শুনিতে পাইলেন, বেয়ারা—

অনেকখানি পথ কেহই কাহারো সহিত বাক্যালাপ করিল না। অবশেষে শিরোমণি আর কৌতূহল দমন করিতে না পারিয়া রায়মহাশয়কে একপাশে একটু টানিয়া ফিসফিস করিয়া কহিলেন, জনার্দন, জমিদারকে তোমার কিরূপ মনে হয় ভায়া?

জনার্দন সংক্ষেপে বলিলেন, মনে ত অনেক রকমই হলো।

মহাপাপিষ্ঠ—লজ্জাশরম আদৌ নেই।

না।

কিন্তু দিব্যি সরল। মাতাল কিনা! দেখলে, দেনার দায়ে চুল পর্যন্ত বাঁধা, তাও বলে ফেললে।

জনার্দন বলিলেন, হুঁ।

শিরোমণি বলিলেন, কিছুই থাকবে না, সব ছারখার হয়ে যাবে, তুমি দেখে নিয়ো।

জনার্দন বলিলেন, খুব সম্ভব।

হয়ত বেশীদিন বাঁচবেও না।

হতেও পারে।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলিয়া শিরোমণি পুনশ্চ বলিলেন, যা ভাবা গিয়েছিল, বোধ হয় ঠিক তা নয়—নেহাত হাবাবোকা বলে মনে হয় না। কি বল?

জনার্দন শুধু জবাব দিলেন, না।

কিন্তু বড় দুর্মুখ। মানীর মান-মর্যাদার জ্ঞান নেই।

জনার্দন চুপ করিয়া রহিলেন। উত্তর না পাইয়াও শিরোমণি কহিলেন, কিন্তু দেখেচ ভায়া কথার ভঙ্গী—অর্ধেক মানে বোঝাই যায় না। সত্য বলচে, না আমাদের বাঁদর নাচাচ্চে ঠাওর করাই শক্ত। জানে সব, কি বল?

রায়মহাশয় তথাপি কোন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন না, তেমনি নীরবে পথ চলিতে লাগিলেন। কিন্তু বাটীর কাছাকাছি আসিয়া শিরোমণি আর কৌতূহল সংবরণ করিতে পারিলেন না, আস্তে আস্তে বলিলেন, ভায়াকে বড় বিমর্ষ দেখাচ্চে—বিশেষ সুবিধে হবে না বলেই যেন ভয় হচ্চে, না?

রায়মহাশয় যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু দাঁড়াইয়া কহিলেন, মায়ের অভিরুচি।

শিরোমণি ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তার আর কথা কি? কিন্তু ব্যাপারটা যেন খিচুড়ি পাকিয়ে গেল—না গেল একে ধরা, না গেল তাকে মারা। তোমার কি ভায়া—পয়সার জোর আছে—কিন্তু বাঘের গর্তের মুখে ফাঁদ পাততে গিয়ে না শেষে আমি মারা পড়ি।

জনার্দন একটু রুক্ষকণ্ঠে কহিলেন, আপনি কি ভয় পেয়ে এলেন নাকি?

শিরোমণি বলিলেন, না না ভয় নয়, কিন্তু তুমিও যে খুব ভরসা পেয়ে এলে, তা ত তোমার মুখ দেখেও অনুভব হচ্চে না। হুজুরটি ত কানকাটা সেপাই—কথাও যেমন হেঁয়ালি, কাজও তেমনি অদ্ভুত। ও যে ধরে গলা টিপে মদ খাইয়ে দেয়নি এই আশ্চর্য। এককড়ির মুখে ঠাকরুনটির হুমকিও ত শুনলে? আমিও মেলা কথা কয়ে এসেচি—ভাল করিনি। কি জানি, এককোড়ে ব্যাটা ভেতরে ভেতরে সব বলে দেয় নাকি! দুয়ের মাঝে পড়ে শেষকালে না বেড়াজালে ধরা পড়ি!

জনার্দন উদাসকণ্ঠে কহিলেন, সকলই চণ্ডীর ইচ্ছা। বেলা হয়ে গেল—ও-বেলায় একবার আসবেন।

তা আসবো।

গলির মোড় ফিরিতে বাঁ দিকের গাছের ফাঁকে মন্দিরের অগ্রভাগ দেখা দিতেই বৃদ্ধ শিরোমণি হাত তুলিয়া যুক্তকরে প্রণাম করিলেন, কানে এবং নাকে হাত দিলেন, কিন্তু অস্ফুটে কি প্রার্থনা যে করিলেন তাহা শোনা গেল না। তার পরে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিয়া গেলেন।

পরিচ্ছেদ – চৌদ্দ

অন্যান্য স্থানের মত চণ্ডীগড়েও দিন আসে যায়, বাহির হইতে কোন বিশেষত্ব নাই। দেবীর সেবা সমভাবে চলিতেছে, গ্রাম-গ্রামান্তর হইতে যাত্রীরা দল বাঁধিয়া তেমনি আসিতেছে, যাইতেছে, মানস করিতেছে, পূজা দিতেছে, পাঁঠা কাটিতেছে, প্রসাদের ভাগ লইয়া পূজারীর সহিত তেমনি বিবাদ করিতেছে, এবং ঠিক তেমনি মুক্তকণ্ঠে আপনার খ্যাতি ও প্রতিবেশীর অখ্যাতি প্রচার করিয়া দেহ ও মনের স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিকতার প্রমাণ দিতেছে। বস্তুতঃ কোথাও কোন ব্যতিক্রম নাই; বিদেশীর বুঝিবার জো নাই যে, ইতিমধ্যে হাওয়ার বদল হইয়াছে, এবং ঝঞ্ঝার পূর্বক্ষণের ন্যায় চণ্ডীগড়ের মাথার আকাশ গোপন ভারে থমথম করিতেছে। এ গ্রামের সাধারণ চাষাভূষারাও যে ঠিক নিশ্চয় করিয়া কিছু বুঝিয়া লইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু ষোড়শীর সম্বন্ধে মোড়ল-পদবাচ্যদের মনোভাব যা-ই হোক, এই দীনদুঃখীরা তাহাকে যেমন ভক্তি করিত, তেমনি ভালবাসিত। এককড়ি নন্দীর উৎপাত হইতে বাঁচিবার সেই কেবল একমাত্র পথ ছিল। ছোটখাটো ঋণ যখন আর কোথাও মিলিত না, তখন ভৈরবীর কাছে গিয়া হাত পাতিতে তাহাদের বাধিত না। তাহার বাড়ি ছাড়িয়া আসার জন্য ইহাদের সত্য সত্যই বিশেষ কোন দুশ্চিন্তা ছিল না, তাহারা জানিত পিতা ও কন্যার মনোমালিন্য একদিন না একদিন মিটিবেই। ষোড়শীর দুর্নামের কথাটাও অপ্রকাশ ছিল না। কেবল সে-ই বলিয়া ইহা না রটিলেই ভাল হইত; না হইলে দেবীর ভৈরবীদের স্বভাব-চরিত্র লইয়া মাথা গরম করার আবশ্যকতা কেহ লেশমাত্র অনুভব করিত না—দীর্ঘকালের অভ্যাসবশতঃ ইহা এতই তুচ্ছ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু ইহাকেই উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া মায়ের মন্দির লইয়া যে তুমুল কাণ্ড বাধিবে, কর্তারা তারাদাস ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই হুজুরের কাছে আনাগোনা করিয়া কি-যেন-কি-একটা ওলটপালট ঘটাইবার মতলব করিবেন, এবং ওই যে অচেনা ছোট মেয়েটাকে কোথা হইতে কিসের জন্য আনিয়া রাখা হইয়াছে—এমনি সব সংশয়ের বিদ্যুৎ কথায় কথায় ক্ষণে ক্ষণে যখন চমকিতে লাগিল, তখন চোখের আড়ালে কোথায় আকাশের গায়ে যে অকালের মেঘ জমিয়া উঠিতেছে এবং তাহাতে দেশের ভালই হইবে না, এই ভাবটাই সকলের মধ্যে ক্রোধ ও ক্ষোভের মত আবর্তিত হইতে লাগিল।

সেদিন অষ্টমী তিথির জন্য মন্দির-প্রাঙ্গণে লোকসমাগম কিছু অধিক হইয়াছিল। প্রতিমার অনতিদূরে বারান্দার একাধারে বসিয়া ষোড়শী আরতির উপকরণ সজ্জিত করিতেছিল, তারাদাস ও সেই মেয়েটিকে সঙ্গে করিয়া এককড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। ষোড়শী কাজ করিতে লাগিল, মুখ তুলিয়া চাহিল না। এককড়ি কহিল, মা মঙ্গলা, তোমার চণ্ডীমাকে প্রণাম কর।

0 Shares