দেনা-পাওনা

এককড়ি মস্ত একটা মাথায় ঝাঁকানি দিয়া বলিল, হুজুরের নজর থেকে কিছুই এড়ায় না। আজ্ঞে, এই সেই তারাদাস।

জীবানন্দ ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, হুঁ। সেবার অনেক টাকার ফেরে ফেলে দিয়েছিল। এরা কতখানি জমি ভোগ করে?

এককড়ি মনে মনে হিসাব করিয়া বলিল, পঞ্চাশ-ষাট বিঘের কম নয়।

জীবানন্দ মুহূর্তকাল মৌন থাকিয়া কহিলেন, কাল তুমি নিজে গিয়ে একে জানিয়ে এসো যে বিঘে পিছু দশ টাকা আমার নজর চাই। আমি আটদিন আছি।

এককড়ি কুণ্ঠিত এবং সঙ্কুচিত হইয়া কহিল, আজ্ঞে, সে যে নিষ্কর দেবোত্তর হুজুর।

না, দেবোত্তর এ গাঁয়ে একফোঁটা নেই। সেলামী না পেলে সমস্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।

এককড়ি নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া রহিল। সে চক্রবর্তী মহাশয়ের জন্য নয়, তাঁহার কন্যা কাটখোট্টা ষোড়শী ভৈরবীর কথাই স্মরণ করিয়া। জমিদার ত একদিন চলিয়া যাইবেন, কিন্তু তাহাকে যে এই গ্রামেই বাস করিতে হইবে। একবার সে অস্ফুটে বলিতেও গেল, কিন্তু হুজুর—

কিন্তু বক্তব্যটা উহার অধিক অগ্রসর হইতে পাইল না। হুজুর মাঝখানেই থামাইয়া দিয়া কহিলেন, কিন্তু এখন থাক এককড়ি। আমার টাকার দরকার, পাঁচ-ছ’শ টাকা আমি ছাড়তে পারব না, ওটা তাদের দিতেই হবে। কাল চক্রবর্তীকে খবর দিও যেন কাছারিতে হাজির থাকে। দলিলপত্র কিছু থাকে ত তাও সঙ্গে আনতে পারে। রাত হল, এখন তুমি যেতে পারো। লোকজনদের খাবার বন্দোবস্ত করে দিও—সদরে ফিরে তোমাকে মনে রাখব।

হুজুর মা-বাপ, বলিয়া এককড়ি আর একদফা ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

পরিচ্ছেদ – দুই

জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী মাত্র পাঁচদিন চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিয়াছেন, এইটুকু সময়ের অনাচার ও অত্যাচারে সমস্ত গ্রামখানা যেন জ্বলিয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছে। নজরের টাকাও আদায় হইতেছে, কিন্তু সে যে কি করিয়া হইতেছে তাহা জমিদার-সরকারে চাকরি না করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করাও পাগলামি।

তারাদাস চক্রবর্তী আদেশমত প্রথম দিন হাজির হইয়া নজর দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন, এমন কি ছয় ঘণ্টাকাল তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খাড়া দাঁড়াইয়াও স্বীকার করেন নাই; কিন্তু সর্বসমক্ষে কান ধরিয়া ওঠ-বোস, ঘোড়দৌড় এবং ব্যাঙের নাচ নাচাইবার প্রস্তাবে আর ধৈর্য রক্ষা করিতে পারেন নাই। চণ্ডীমাতার নিকট কায়মনে জমিদারগোষ্ঠীর বংশলোপের আবেদন করিয়া, প্রকাশ্যে পাঁচদিনের কড়ারে টাকা আদায় দিবার অঙ্গীকারে অব্যাহতি পাইয়া বাড়ি আসেন। আজ সেই দিন, কিন্তু সকাল হইতে কোথাও তাঁহাকে দেখা যাইতেছে না।

ইতিমধ্যে প্রত্যহ মহাপ্রসাদ যোগাইতে হইয়াছে; পুকুরের মাছ, বাগানের ফলমূল, চালের লাউ-কুমড়া জমিদারের লোক যথেচ্ছা টানিয়া ছিঁড়িয়া লইয়া গিয়াছে—ষোড়শী প্রতিবাদ করিতে চাহিয়াছে, কিন্তু তারাদাস কিছুতেই একটা কথাও কহিতে দেয় নাই, তাহার হাতে ধরিয়া কাঁদাকাটা করিয়া যেমন করিয়া হোক নিবৃত্ত করিয়া রাখিয়াছে। পিতার অপমান হইতে আরম্ভ করিয়া এই-সকল নির্যাতন সে কোনমতে এতদিন সহিয়াছিল, কিন্তু আজিকার ঘটনায় তাহার সমস্ত সঞ্চিত ক্রোধ একমুহূর্তে অগ্ন্যুৎপাতের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। পিতার নিঃশব্দ অন্তর্ধানের হেতু ও তাহার অবশ্যম্ভাবী ফলাফলের ভার তাহার মন একাকী যেন আজ আর বহিতে পারিতেছিল না। এমনি করিয়া সমস্ত সকাল ও মধ্যাহ্ন যখন অপরাহ্নে গড়াইয়া পড়িল, তখন রাত্রের অন্ধকারে উপবাসী পিতার গোপনে ফিরিয়া আসার প্রত্যাশা করিয়া সে দুটো রাঁধিতে বসিয়াছিল, এমন সময়ে মন্দিরের পরিচারিকা আসিয়া যে অত্যাচার বর্ণনা করিল, তাহা এই—

মাতাল ভূস্বামীর হঠাৎ খেয়াল হইয়াছে যে, অতঃপর নিষিদ্ধ মাংস ত নহেই, এমন কি বৃথা মাংসও ভোজন করিবেন না। অথচ পাঁঠার মাংস যথেষ্ট সুস্বাদু বা রুচিকর নহে। তাই আজ জমিদারের লোক ডোমপাড়া হইতে একটা খাসি আনিয়া মন্দিরে হাজির করে এবং তাহাকে মহাপ্রসাদ করিয়া দিতে বলে। পুরোহিত প্রথমটা আপত্তি করে, কিন্তু শেষে আদেশ শিরোধার্য করিয়া উহাকেই উৎসর্গ করিয়া যথারীতি বলি দিয়া দেবীর মহাপ্রসাদ করিয়া দেয়।

শুনিবামাত্রই ষোড়শী হাঁড়িটা দুম্‌ করিয়া চুলা হইতে নামাইয়া দিয়া ক্রোধে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া দ্রুতবেগে মন্দিরে চলিয়াছিল, বহির্দ্বারে জন-চারেক হিন্দুস্থানী পাইক তাহার গতিরোধ করিয়া দাঁড়াইল। বিশ্বম্ভর দূর হইতে বাড়িটা দেখাইয়া দিয়া সরিয়া পড়িল। ইহারা জমিদারের পালকি-বেহারা। মুখে তাড়ির দুর্গন্ধ, চোখগুলো রাঙ্গা— অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল অবস্থা। যে লোকটা বাংলা শিখিয়াছে, সে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করিল, শালা ঠাকুরমোশাই ঘোরে আছে? শালা টাকা দেবে, না ভেগে ফিরচে!

ষোড়শী চাহিয়া দেখিল কোথাও কেহ নাই। পাছে এই দুর্বিনীত মদমত্ত পশুগুলা হঠাৎ তাহাকেই অপমান করিয়া বসে এই ভয়ে সে দুর্জয় ক্রোধ প্রাণপণে সংবরণ করিয়া মৃদুকণ্ঠে কহিল, না, বাবা বাড়ি নেই।

কোথা ছিপ্‌ছে?

আমি জানি নে, বলিয়া ষোড়শী পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিতেই লোকটা হাত বাড়াইয়া একটা অত্যন্ত অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ করিয়া কহিল, না আছে ত তুই চোল। গোলায় গামছা লাগিয়ে খিঁচে লিয়ে যাবো।

এ অপমান ষোড়শীকে একেবারে আত্মহারা করিয়া ফেলিল, সে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়া কহিল, খবরদার বলচি। চল্‌ আমিই যাবো—তোদের মাতালটা আমাকে কি করতে পারে দেখি গে। বলিয়া সে পরিণাম-ভয়হীন উন্মাদিনীর ন্যায় নিজেই দ্রুতপদে অগ্রসর হইয়া চলিল।

পথে দুই-একজন পরিচিত লোকের সহিত সাক্ষাৎ হইল, কিন্তু ষোড়শী ভ্রূক্ষেপও করিল না। জমিদারের লোকগুলা পিছনে হল্লা করিয়া চলিয়াছে, ইহার অর্থ পল্লীগ্রামের কাহাকেও বুঝাইয়া বলা নিষ্প্রয়োজন বলিয়াই শুধু নয়, কাহারও সাহায্য ভিক্ষা করিয়া এতবড় অবমাননাকে আর নিজের মুখে চতুর্দিকে ছড়াইয়া দিতে তাহার কিছুতেই প্রবৃত্তি হইল না।

0 Shares