দেনা-পাওনা

সাগর কহিল, স্বয়ং হুজুরের মুখে।

তাহলে এ-সকল তাঁরই মতলব?

সাগর চিন্তা করিয়া কহিল, কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন।

ষোড়শী একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, আচ্ছা সাগর, তুই বলতে পারিস, জমিদার আমার উপর অত্যাচার করেন না কেন? আমি ত ভাঙা কুঁড়েয় একলা থাকি, ইচ্ছে করলেই ত পারেন?

সাগর হাসিল, কহিল, কে তোমাকে বললে মা তুমি একলা থাকো? মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই,—গুরুর নিষেধ আছে, বলিতে বলিতে সহসা তাহার বলিষ্ঠ দক্ষিণ হাতের পাঁচটা আঙ্গুল লাঠির গায়ে যেন ইস্পাতের সাঁড়াশির মত চাপিয়া বসিল, কহিল, যার ভয়ে চণ্ডীর মন্দিরে না বসে ষোল আনা বসতে গেল আজ এককড়ির কাছারি-বাড়িতে, তারই ভয়ে কেউ তোমার ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে, তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না।

ষোড়শীর দুই চক্ষু অকস্মাৎ জ্বলিয়া উঠিল; কহিল, সাগর, এ কি সত্য?

সাগর হেঁট হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার হাতের লাঠিটা ষোড়শীর পায়ের নীচে রাখিয়া দিয়া কহিল, বেশ ত মা, সেই আশীর্বাদ কর না যেন কথা আমার মিথ্যে না হয়।

ষোড়শীর চোখের দৃষ্টি একবার একটুখানি কোমল হইয়াই আবার তেমনি জ্বলিতে লাগিল, কহিল, আচ্ছা সাগর, আমি ত শুনেচি তোদের প্রাণের ভয় করতে নেই?

সাগর সহাস্যে কহিল, মিথ্যে শুনেচ তাও ত আমি বলচি নে মা।

ষোড়শী কহিল, কেবল প্রাণ দিতেই পারিস, আর নিতে পারিস নে?

সাগর কহিল, একটা হুকুম দিয়ে আজ রাত্রেই কেন যাচাই কর না মা? এই বলিয়া সে ষোড়শীর মুখের উপর দুই চোখ মেলিয়া ধরিতে ষোড়শী বিস্ময়ে ও ভয়ে একেবারে নির্বাক হইয়া গেল। সাগরের চাহনি এক পলকে বদলাইয়া গেছে। সেই স্বাভাবিক দীপ্তি নাই, সে তেজ নাই, সে কোমলতা কোথায় অন্তর্হিত হইয়াছে—নিষ্প্রভ, সঙ্কুচিত গভীর দৃষ্টি—এ যেন আর সে সাগর নয়, এ যেন আর কেহ। সাগর কথা কহিল। কণ্ঠস্বর শান্ত কঠিন, অত্যন্ত ভারী। কহিল, রাত বেশী হয়নি—ঢের সময় আছে। মা চণ্ডীর কপাট তাই এখনো খোলা আছে মা, আমি তোমার হুকুম শুনতে পেয়েচি। বেশ, তাই হবে মা, পাপের শেষ করে দেব—সকালেই শুনতে পাবে, তোমার সাগর সর্দার মিছে অহঙ্কার করে যায়নি। তাহার পিতৃ-পিতামহের হাতের সুদীর্ঘ লাঠিখানা ত ষোড়শীর পায়ের কাছে পড়িয়া ছিল, হেঁট হইয়া তৎক্ষণাৎ তুলিয়া লইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল।

ষোড়শী কথা কহিতে গেল, তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল, নিষেধ করিতে চাহিল, কণ্ঠে স্বর ফুটিল না, ভূমিকম্পের সমুদ্রের মত অকস্মাৎ সমস্ত বুক জুড়িয়া দোলা উঠিল, এবং নিমেষের জন্য সাগরের এই একান্ত অপরিচিত ঘাতকের মূর্তি তাহার চোখের উপর হইতে অদৃশ্য হইয়া গেল। সাগর কি যেন একটা কহিল, কিন্তু সে বুঝিতে পারিল না, কেবল এইটুকুমাত্র উপলব্ধি করিল যে, সে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া দ্রুতবেগে বাহির হইয়া যাইতেছে।

পরিচ্ছেদ – সতের

ষোড়শীর যখন চেতনা ফিরিয়া আসিল, তখন সাগর চলিয়া গেছে।

মন্দিরের ভৃত্য ডাকিয়া কহিল, মা, এবার দোর বন্ধ করি?

কর, বলিয়া সে চাবির জন্য দাঁড়াইয়া রহিল। ছেলেবেলা হইতে জীবনটা তাহার যথেষ্ট সুখেরও নয়, নিছক আরামেও দিন কাটে নাই; বিশেষ করিয়া যে অশুভ মুহূর্তে বীজগ্রামের নূতন জমিদার চণ্ডীগড়ে পদার্পণ করিয়াছিলেন, তখন হইতে উপদ্রবের ঘুর্ণিহাওয়া তাহাকে অনুক্ষণ ঘেরিয়া নিরন্তর অশান্ত, চঞ্চল ও বিশ্রামহীন করিয়া রাখিয়াছে। তবুও সে-সকল সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের ন্যায়, আজ যেখানে সাগর সর্দার তাহাকে এইমাত্র নিক্ষেপ করিয়া অন্তর্হিত হইল। অথচ যথার্থই সে যে এতবড় ভয়ঙ্কর কিছু একটা এই রাত্রির মধ্যে করিয়া উঠিতে পারিবে, তাহা এমনি অসম্ভব যে ষোড়শী বিশ্বাস করিল না। অথবা এ আশঙ্কাও তাহার মনের মধ্যে সত্য সত্যই স্থান পাইল না যে, যে লোক হত্যা, রক্তপাত ও হিংসার সর্বপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও আয়োজনে পরিবৃত হইয়া অহর্নিশি বাস করে, পাপ তাহার যত বড়ই হোক, কেবলমাত্র সাগরের লাঠির জোরেই তাহার পরিসমাপ্তি ঘটিবে। তথাপি দৈব বলিয়া যে শক্তির কাছে সকল অঘটনই হার মানে, তাহারই ভয়ে বুকের মধ্যে তাহার মুগুরের ঘা পড়িতে লাগিল।

মন্দিরের দ্বারে তালা বন্ধ করিয়া ভৃত্য চাবির গোছা হাতে আনিয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, রাত অনেক হয়েচে মা, সঙ্গে যেতে হবে কি?

ষোড়শী মুখ তুলিয়া অন্যমনস্কের মত বলিল, কোথায় বলাই?

তোমাকে পৌঁছে দিতে মা।

পৌঁছে দিতে? না, বলিয়া ষোড়শী ধীরে ধীরে স্বপ্নাবিষ্টের মত বাহির হইয়া গেল।

প্রত্যহের মত এই পথটুকুর মধ্যেও অতি সর্তকতা আজ তাহার মনেই হইল না। রাত্রির প্রগাঢ় অন্ধকার, কিন্তু এ-কয়দিনের ন্যায় ঝাপসা মেঘের আচ্ছাদন আজ ছিল না। স্বচ্ছ নির্মল কৃষ্ণা-দ্বাদশীর কালো আকাশ এইমাত্র যেন কোন্‌ অদৃশ্য পারাবারে স্নান করিয়া আসিয়াছে, তাহার আর্দ্র গা-মাথায় এখনও যেন জল মাখানো রহিয়াছে। মন্দির হইতে ষোড়শীর কুটীরখানির ব্যবধান যৎসামান্য; এই আঁকাবাঁকা পায়ে-হাঁটা ধূসর পদরেখাটির উপরে একটি স্নিগ্ধ আলোক অসংখ্য নক্ষত্রলোক হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে; তাহারই উপর দিয়া সে নিঃশব্দ পদক্ষেপে তাহার ঘরের দ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইল।

শেষ চৈত্রের এই কয়টা দিন গ্রামে জনমজুর মিলে না, তথাপি তাহার অনুগত ভক্ত প্রজারা আঙ্গিনার চারিদিকে শক্ত করিয়া বাঁশের বেড়া বাঁধিয়া দিয়াছে এবং জীর্ণ কুটীরের কিছু কিছু সংস্কার করিয়া তাহারই গায়ে একখানি ছোট চালা বাঁধিবার জন্য তৈরি করিয়া দিয়াছে। পুরাতন অর্গল নূতন হইয়াছে, এবং দেওয়ালের গায়ে ফাটা ও গর্ত যত ছিল, বুজাইয়া নিকিয়া মুছিয়া ঘরটিকে অনেকটা বাসোপযোগী করিয়া তুলিয়াছে।

0 Shares