দেনা-পাওনা

তালা খুলিয়া ষোড়শী এই ঘরের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল এবং আলো জ্বালিয়া সেইখানেই মাটির উপরে বসিয়া পড়িল। প্রতিদিনের ন্যায় আজিও তাহার অনেক কাজ বাকী ছিল। রাত্রে রান্নার হাঙ্গামা তাহার ছিল না বটে; দেবীর প্রসাদ যাহা-কিছু আঁচলে বাঁধিয়া সঙ্গে আনিত, তাহাতেই চলিয়া যাইত, কিন্তু আহ্নিক প্রভৃতি নিত্যকর্মগুলি সে সর্বসমক্ষে মন্দিরে না করিয়া নির্জন গৃহের মধ্যেই সম্পন্ন করিত, তাহার পরে অনেক রাত্রি জাগিয়া ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিত।

এ-সকল তাহার প্রতিদিনের নিয়ম; তাই প্রতিদিনের মত আজও তাহার মনের মধ্যে অসমাপ্ত কর্মের তাগিদ উঠিতে লাগিল, কিন্তু পা-দুটা কোনমতেই আজ খাড়া হইতে চাহিল না; এবং যে দরজা উন্মুক্ত রহিল, উঠি উঠি করিয়াও তাহাকে সে বন্ধ না করিয়া তেমনি জড়ের মত স্থির হইয়া প্রদীপের সম্মুখে বসিয়া রহিল।

সে সাগরের কথা ভাবিতেছিল। মন্দিরের অনতিদূরবর্তী ভূমিজ পল্লীস্থ এই দুঃস্থ ও দুরন্ত লোকগুলিকে সে শিশুকাল হইতেই ভালবাসিত এবং বড় হইয়া ইহাদের দুঃখদুর্দশার চিহ্ন যতই বেশী করিয়া তাহার চোখে পড়িতে লাগিল ততই স্নেহ তাহার সন্তানের প্রতি মাতৃস্নেহের ন্যায় দৃঢ় ও গভীর হইয়া উঠিতে লাগিল। সে দেখিল চণ্ডীগড়ের ইহারাই একপ্রকার আদিম অধিবাসী, এবং একদিন সকলেই ইহারা গৃহস্থ কৃষক ছিল; কিন্তু আজ অধিকাংশই ভূমিহীন—পরের ক্ষেতে মজুরি করিয়া বহু দুঃখে দিনপাত করে। সমস্ত জমিজমা হয় জনার্দন, না হয় জমিদারের কর্মচারী স্বনামে বেনামে গিলিয়া খাইয়াছে। ভূতপূর্ব ভৈরবীদের আমলে দেবীর অনেক জমি মন্দিরের নিজ জোতে ছিল, তাঁহাদের যথেচ্ছামত সেগুলি প্রতি বৎসর ভাগে বিলি হইত, এবং এই উপলক্ষে প্রজায় প্রজায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবধি থাকিত না। অথচ লাভ কিছুই ছিল না; তত্ত্বাবধান ও বন্দোবস্তের অভাবে প্রাপ্য অংশের কিছু-বা প্রজারা লুটিয়া খাইত, এবং অবশিষ্ট আদায় যদি-বা হইত অপব্যয়েই নিঃশেষ হইত। এই-সকল ভূমিই সে ভূমিহীন ভূমিজ প্রজাদিগকে বছর ছয়-সাত পূর্বে ফকিরসাহেবের নির্দেশমতে নির্দিষ্ট হারে বন্দোবস্ত করিয়া দেয়। জনার্দন রায় ও এককড়ি নন্দীর সহিত তাহার বিবাদের সূত্রপাতও তখন হইতে। এবং সেই কলহই পরবর্তী কালে নানা অজুহাতে নানা তুচ্ছ কাজে আজ এই আকারে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সাগর ও হরিহর সর্দার তখন জেল খাটিতেছিল। খালাস পাইয়া তাহার মন্দিরে ষোড়শীর কাছে আসিয়া একদিন হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইল। কহিল, মা, আমরা খুড়ো-ভাইপোয়েই কি কেবল কূলকিনারা পাবো না, শুধু ভেসে ভেসে বেড়াব?

ষোড়শী রাগ করিয়া কহিল, তোরা ভাসতে যাবি কেন হরিহর—জেলের অমন সব বাড়িঘর হয়েচে তবে কিসের জন্যে?

সাগর নিঃশব্দে মুখ ফিরাইয়া মাথা উঁচু করিয়া রহিল; কিন্তু বুড়ো হরিহর তেমনি জোড়হাতে কহিল, মা, আমরা তোমার কুপুত্র বলে তুমিও কি কুমাতা হবে? আমাদেরও একটা পথ করে দাও।

ষোড়শী একটু নরম হইয়া কহিল, তোমার কথাগুলি ত ভাল হরিহর, তা ছাড়া তুমি বুড়ো হয়েও গেছ, কিন্তু তোমার ভাইপোটি ত অহঙ্কারে মুখ ফিরিয়ে রইল, দোষটুকু পর্যন্ত স্বীকার করলে না—ও কি কখনো শান্ত হতে পারবে?

হরিহর নিজের সর্বাঙ্গে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, বুড়ো হয়ে গেছি, না মা? চুলগুলোও সব পেকে গেছে, বলিয়া সে মুচকাইয়া একটু হাসিতেই সাগরের সমস্ত মুখ শান্ত হাসিতে দীপ্ত হইয়া উঠিল। মুহূর্তে খুড়ো-ভাইপোর চোখে চোখে নিঃশব্দে বোধ হয় এই কথাই হইয়া গেল যে, এই ভাল। তোমার এই প্রাচীন বাহু দুটির শক্তির কোন সংবাদ যে রাখে না, তাহার কাছে এমনি সহাস্যে সবিনয়ে স্বীকার করাই সবচেয়ে শোভন।

বুড়ো কহিল, অহঙ্কার নয় মা, অভিমান। ওটুকু ও পারে করতে—সাগর কখনো ডাকাতি করে না।

ষোড়শী আশ্চর্য হইয়া কহিল, ও কি তবে বিনাদোষে শাস্তিভোগ করলে? যা সবাই জানে, তা সত্য নয়—এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও হরিহর?

তাহার অবিশ্বাসের কণ্ঠস্বর অকারণে অত্যন্ত কঠোর হইয়া বাজিল, তথাপি বুড়া হরিহর কি-একটা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু ভাইপো সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে বাধা দিল। কহিল, কি হবে মা, তোমার সে কথা শুনে? তোমরা ভদ্রলোকেরা যখন আমাদের ছোটলোকের কথা বিশ্বাস করতে পারবে না! ভদ্রলোকেরা যখন আমাদের সর্বস্ব কেড়ে নিলে, সেও সত্যি পাওনার দাবিতে, আবার যখন জেলে দিলে, সেও তেমনি সত্যি সাক্ষীর জোরে। জজসাহেবের আদালত থেকে মা চণ্ডীর মন্দির পর্যন্ত ছোটলোকের কথা বিশ্বাস করবার ত কেউ নেই মা! চল, ছোটখুড়ো, আমরা ঘরে যাই। বলিয়া সে চট করিয়া হেঁট হইয়া ভৈরবীর পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া প্রস্থান করিল। হরিহর নিজেও প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিয়া সলজ্জ-কণ্ঠে কহিল, রাগ করো না মা, ও ব্যাটা ঐ রকম গোঁয়ার, ও কথা কারু সইতে পারে না। বলিয়া সেও ভ্রাতুষ্পুত্রের অনুগমন করিল।

হোক ইহারা অন্ত্যজ, হোক ইহারা দস্যু; যতক্ষণ দেখা গেল ষোড়শী স্তব্ধবিস্ময়ে এই হীনবীর্য, অবমানিত, অধঃপতিত বাঙলাদেশের এই দুটি সুস্থ, নির্ভীক ও পরম শক্তিমান পুরুষদিগের প্রতি চাহিয়া রহিল।

পরদিন প্রভাতেই ষোড়শী সাগরকে ডাকাইয়া আনিয়া কহিল, তোদের কাছে বাবা, কাল আমি অন্যায় করেছি। বিঘে দশ-পনর জমি আমার এখনো আছে, তোরা খুড়ো-ভাইপোতে তাই ভাগ করে নে। মায়ের খাজনা তোরা যা খুশি দিস্‌, কিন্তু অসৎপথে আর কখনো পা দিবিনে এই আমার শর্ত।

সেই অবধি সাগর আর হরিহর তাহার ক্রীতদাস। তাহার সকল কর্মে সকল সম্পদে তাহারা ছায়ার মত অনুসরণ করিয়াছে, সকল বিপদে বুক দিয়া রক্ষা করিয়াছে। এই যে ভাঙ্গা কুটীর, এই সঙ্গীবিহীন বিপদাপন্ন জীবন, তবু যে কেহ তাহার কেশাগ্র স্পর্শ করিবার দুঃসাহস করে না, সে যে কিসের ভয়ে এ কথা ত তাহার অবিদিত নাই। তথাপি সেই সাগরের যে মূর্তি আজ সে চোখে দেখিয়া আসিল তাহাতে ভরসা করিবার, বিশ্বাস করিবার আর তাহার কিছুই রহিল না। সে ডাকাতি করে কিনা বলা কঠিন; কিন্তু প্রয়োজন বোধ করিলে ইহার অসাধ্য কিছু নাই— তাহার সমস্ত আয়োজন ও উপকরণ আজও তেমনি সজীব আছে, এবং মুহূর্তের আহ্বানে তাহারা আজও তেমনি সাজিয়া দাঁড়াইতে পারে, এ সংশয় আর ত ঠেকাইয়া রাখা যায় না।

0 Shares