দেনা-পাওনা

ছেঁড়া একখানা কাগজের টুকরা একপাশে পড়িয়া ছিল, অন্যমনস্কভাবে হাতে তুলিয়া লইতেই তাহার প্রদীপের আলোকে চোখে পড়িল, হৈমর চিঠির জবাবে সেদিন যে চিঠিখানা সে লিখিয়াও ভাল হইল না ভাবিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আর একখানা লিখিয়া পাঠাইয়াছিল ইহা তাহারই অংশ। অনেক রাত্রি জাগিয়া দীর্ঘ পত্র যখন শেষ হয়, তখন একবার যেন সন্দেহ হইয়াছিল এত কথা না লিখিলেই হইত—পরের কাছে আপনাকে এমন করিয়া ব্যক্ত করা হয়ত কিছুতেই ঠিক হইল না, কিন্তু নিদ্রাহীন সেই গভীর রাত্রে ঠিক করিবার ধৈর্যও আর তাহার ছিল না। কিন্তু পরদিন ডাকে ফেলিয়া দিতে যখন পাঠাইল, তখন না পড়িয়াই পাঠাইয়া দিল। তাহার ভয় হইল পাছে ইহাও সে ছিঁড়িয়া ফেলে—পাছে আজও তাহার হৈমকে উত্তর দেওয়া ঘটিয়া না ওঠে। এ কয়দিন যাহা ভুলিয়াছিল, আজ একে একে সেই চিঠির কথাগুলাই মনে পড়িয়া তাহার ভারী লজ্জা করিতে লাগিল—ভয় হইতে লাগিল পাছে তাহার নির্যাতনের কাহিনীটুকু কেহ ভুল বুঝিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে আসিয়া উপস্থিত হয়। এই হৈম ও তাহার স্বামীকে মনে পড়িলেই মন যেন তাহার কেমন বিবশ হইয়া আসিত। ইহাদের শৃঙ্খলিত জীবনযাত্রার ধারার সহিত তাহার বিশেষ পরিচয় নাই, তবুও কেমন করিয়া যে স্বপ্ন রচিয়া উঠিত, কেমন করিয়া যে কাজের চিন্তা তাহার এলোমেলো কল্পনায় পর্যবসিত হইত, কখনো হৈম, কখনো নির্মলের সূত্র ধরিয়া কি করিয়া যে ইহাই একসময়ে সমস্ত সংযমের বেড়া ভাঙ্গিয়া অকস্মাৎ লজ্জায় ফাটিয়া পড়িত, তাহা সে নিজেই ভাবিয়া পাইত না। অথচ নিজের মনের এই মোহাবিষ্ট লক্ষ্যহীন গতিকে সে চিনিত, ভয় করিত, লজ্জা করিত, এবং সকল শক্তি দিয়া বর্জন করিতে চাহিত। সেই উতলা আবেগের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে পত্রখণ্ড খান খান করিয়া ফেলিয়া দিয়া শক্ত হইয়া বসিল। মনে মনে দৃঢ়বলে কহিল, কিসের জন্য হৈমদের এত কথা আমি বলিতে গেলাম! কোন্‌ সাহায্য তাহাদের কাছে আমি ভিক্ষা করিয়া লইব? কিসের জন্য লইব? দেবীর ভৈরবীপদের মধ্যে কি আছে যে এমন করিয়া আঁকড়াইয়া থাকিব? যে-কেহ নিক না, কি আমার আসিয়া যায়? ইহারা সবাই ত চোর-ডাকাত। যাহার যত শক্তি সে তত বড়ই দস্যু। সুবিধা ও সামর্থ্য মত অপরের গলা টিপিয়া কাড়িয়া লওয়াই ইহাদের কাজ। এই ত সংসার, এই ত সমাজ, এই ত মানুষের ব্যবসা! পীড়িত ও পীড়কের মাঝখানে ব্যবধান কতটুকু যে অহর্নিশি এমন ভয়ে ভয়ে আছি! কিসের জন্য আমার এতবড় মাথাব্যথা! কিসের জন্য এতবড় বিরোধ সৃষ্টি করিয়াছি! এই ভৈরবীর আসন ত্যাগ করা কিসের জন্য এতবড় কঠিন! মুহূর্তের জন্য মনে হইল এ কাজ তাহার পক্ষে একেবারেই কঠিন নয়, কাল সকালেই সে এককড়ি ও জনার্দন রায়কে লিখিয়া পাঠাইয়া ভৈরবীর সকল দায়িত্ব স্বচ্ছন্দে ফিরাইয়া দিতে পারে, কোথাও কোন টান, কোন ব্যথা তাহার বাজিবে না।

ষোড়শী উঠিয়া দাঁড়াইল। পাশের কুলুঙ্গিতে তাহার কালি কলম ও কাগজ থাকিত; পাড়িয়া লইয়া এই চিঠিখানা তখনই লিখিয়া ফেলিতে প্রস্তুত হইল। তাড়াতাড়ি কয়েক ছত্র লিখিয়া ফেলিয়া সহসা তাহার লেখনী রুদ্ধ হইল। সর্দার ও সাগরকে মনে পড়িল—পৃথিবী-জোড়া কাড়াকাড়ি ও দস্যুপনার মাঝখানে কেবল এই দুটি দস্যুই আজও তাহাকে ত্যাগ করে নাই। সহসা নিজের কথা মনে পড়িয়া মনে হইল, তার পরে? দাঁড়াইবার কোথাও স্থান নাই—সবাই ত্যাগ করিয়াছে। কাল যাহারা তাহাকে ঘেরিয়া ছিল, আজ তাহারা শাসনের ভয়ে, জমিদারের গৃহপ্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া তাহারই বিরুদ্ধে পঞ্চায়েতি করিয়া আসিয়াছে। অথচ সে বেশীদিনের কথা নয়, ইহাদিগকেই—কিন্তু থাক সে কথা। এই অত্যন্ত ছোটদের বিরুদ্ধে তাহার অভিযোগ নাই।এককড়ি, জনার্দন, শিরোমণি, তাহার পিতা তারাদাস, আর এই জমিদার—পুরানো ও নূতন অনেক কথা—কিন্তু সেও থাক; এ আলোচনাতেও আজ আর কাজ নাই। তাহার ফকিরসাহেবকে মনে পড়িল। তিনি যে কি ভাবিয়া এমন করিয়া অকস্মাৎ চলিয়া গেলেন তাহার জানা নাই; কাহাকেও তিনি কোন হেতু, কাহারও বিরুদ্ধে কোন অনুযোগ করিয়া যান নাই। ইতিপূর্বেও তিনি এমনি নীরবে চলিয়া গেছেন; স্নেহ দিয়া, ভক্তি দিয়া, সসম্ভ্রমে বিদায় দিবার কোন অবসর কাহাকেও দেন নাই, হয়ত ইহাই তাঁহার প্রস্থানের পদ্ধতি। তবুও কেমন করিয়া যেন ষোড়শীর মনের মধ্যে ব্যথা একটা বিঁধিয়াই ছিল, তাঁহার এই যাওয়াটাকে কোনক্রমে সে তাঁহার অভ্যাস বলিয়া সান্ত্বনা লাভ করিতে পারিতেছিল না। তিনি মাঝে মাঝে তাহার কথার প্রত্যুত্তরে বলিতেন, মা, আমি নিজের সঙ্গেই সম্বন্ধ ছেদ করিতে চাই, লোকের সঙ্গে নয়। তাই লোকালয়ের মায়া কাটাতে পারিনে—মানুষের মাঝখানে বাস করতেই ভালবাসি। তুমিও তোমার দেহটাকে যখন দেবতাকেই দিয়েছ, তখন সেই কথাটাই সকলের আগে মনে রেখো। কোন ছলে নিজের বলে যেন ভুল না হয়। দেবতার সঙ্গে আপনাকে জড়িয়ে আত্মবঞ্চনার চেয়ে বরঞ্চ দেবতাকে ছাড়াও ভাল। আজ এই বঞ্চনাই ত তাহাকে জালের মত জড়াইয়া ধরিয়াছে। আজ যদি তিনি থাকিতেন! একবার যদি সে তাঁহার পায়ের কাছে গিয়া বসিতে পারিত! বহুপূর্বে একদিন তিনি বলিয়াছিলেন, মা, যখন আমাকে তোমার যথার্থ প্রয়োজন হবে, সত্যই ডাকবে, যেখানেই থাকি আমি তখনি এসে দাঁড়াব। আজ ত তার সেই প্রয়োজন!

ঠিক সেই মুহূর্তেই বাহির হইতে ডাক আসিল, একবার ভিতরে আসতে পারি কি?

ষোড়শীর বিক্ষিপ্ত উদ্‌ভ্রান্ত চিত্ত চক্ষের পলকে সচেতন হইয়া পরক্ষণেই আবার যেন আচ্ছন্ন হইয়া গেল। এতবড় অলৌকিক বিস্ময় সহসা যেন সে সহিতে পারিল না।

আমি আসতে পারি কি?

আসুন, বলিয়া ষোড়শী উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং মুদিতচক্ষে সর্বাঙ্গ দিয়া আগন্তুকের পদতলে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিয়া কম্পিতপদে উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রদীপের আলোকে চাহিয়া দেখিল—ফকিরসাহেব নহেন, জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী। চক্ষে আর পলক পড়িল না—চোখের পাতা দুটো পর্যন্ত যেন পাষাণ হইয়া গেল। গৃহের দীপশিখা স্তিমিত হইয়া আসিতেছিল, কিন্তু এমন করিয়া যে-মানুষ এক নিমিষে পাথর হইয়া গেল, তাহাকে চিনিবার মত আলো ছিল। সুতরাং এই অদ্ভুত ও অকারণ উচ্ছ্বসিত ভক্তির উপলক্ষ যে সত্যই সে নয়, আর কেহ, তাহা অনুভব করিয়া জীবানন্দর ভয় ভাঙ্গিল। গম্ভীরমুখে কহিল, এরূপ পতিভক্তি কলিকালে দুর্লভ। আমার পাদ্য-অর্ঘ্য, আসনাদি কই?

0 Shares