দেনা-পাওনা

ষোড়শী স্তব্ধ হইয়া রহিল। তাহার এই হতভাগ্য জীবনে সে অনেককে দেখিয়াছে। সে জনার্দনকে দেখিয়াছে, সে এককড়ি নন্দীকে দেখিয়াছে, সে তাহার আপনার পিতাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠরূপে দেখিয়াছে; কিন্তু মানুষের পাষণ্ডতা যে এতদূরে উঠিতে পারে, এ কথা উপলব্ধি করিয়া তাহার ধাক্কা সামলাইতে তাহার সময় লাগিল। জীবানন্দ এদিক-ওদিক চাহিয়া বাঁশের আলনা হইতে কম্বলের আসনখানি পাড়িয়া লইল; পাতিতে গিয়া খোলা দরজার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, খিলটা একেবারে দিয়েই বসিনে কেন? তোমার সাগরচাঁদটি শুনেচি নাকি আমাকে তেমন ভালবাসে না। কাছাকাছি কোথাও আছেন নিশ্চয়—এসে পড়লে হয়ত বা কিছু মনেই করবে। ছোটলোক বৈ ত নয়! বলিয়া সে এইবার একটু হাসিল।

ষোড়শীর গা কাঁপিতে লাগিল। সে নিশ্চয় বুঝিল লোকটা একাকী আসে নাই, তাহার লোকজন নিকটেই লুকাইয়া আছে, এবং সম্ভবতঃ এই সুযোগই সে প্রত্যহ প্রতীক্ষা করিতেছিল। আজ ভীষণ কিছু একটা করিতে পারে—হত্যা করাও অসম্ভব নয়। এবং এই উদ্বেগ কণ্ঠস্বরে সে সম্পূর্ণ গোপন করিতে না পারিয়া কহিল, আপনি এখানে এসেছেন কেন?

জীবানন্দ কহিল, তোমাকে দেখতে। একটু ভয় পেয়েচ বোধ হচ্চে—পাবারই কথা। কিন্তু তাই বলে চেঁচিও না। সঙ্গে গাদা-পিস্তল আছে, তোমার ডাকাতের দল শুধু মারাই পড়বে, আর বিশেষ কিছু পারবে না। বলিয়া সে পকেট হইতে রিভলভার বাহির করিয়া পুনশ্চ পকেটেই রাখিয়া দিয়া কহিল, কিন্তু দোরটা বন্ধ করে দিয়ে একটু নিশ্চিন্ত হওয়াই যাক না। এই বলিয়া সে ষোড়শীর মুখপানে চাহিয়া একটু হাসিল, এবং অগ্রসর হইয়া দ্বার অর্গলবন্ধ করিয়া দিল, যাহার গৃহ তাহার অনুমতির অপেক্ষামাত্র করিল না।

ষোড়শীর মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। একবার কথা কহিতে গিয়া তাহার কণ্ঠে বাধিল, তার পরে স্বর যখন ফুটিল, তখন সেই স্বর ভয়ে কাঁপিতে লাগিল, কহিল, সাগর নেই—

জীবানন্দ বলিল, নেই? ব্যাটা গেল কোথায়?

ষোড়শী কহিল, আপনারা জানেন বলেই ত—

জীবানন্দ কহিল, জানি বলে? কিন্তু আপনারা কারা? আমি ত বাষ্পও জানতাম না।

ষোড়শী বলিল, নিরাশ্রয় বলেই ত লোক নিয়ে আমাকে মারতে এসেচেন। কিন্তু আপনার কি করেচি আমি?

জীবানন্দ কহিল, লোক নিয়ে মারতে এসেচি! তোমাকে? মাইরি না! বরঞ্চ মন কেমন করছিল বলে দেখতে এসেচি।

ষোড়শ আর কথা কহিল না। তাহার চোখে জল আসিতেছিল, এই কদর্য উপহাসে তাহা একেবারে শুকাইয়া গেল। এবং সেই শুষ্ক চক্ষু ভূমিতলে নিবদ্ধ করিয়া সে নিঃশব্দে বসিয়া রহিল; এবং অদূরে বসিয়া আর একজন তাহারই আনত মুখের প্রতি লুব্ধ তৃষিত দৃষ্টি স্থির করিয়া তাহারি মত চুপ করিয়া রহিল।

পরিচ্ছেদ – আঠারো

অলকা?

বলুন।

তোমার এখানে তামাক-টামাকের ব্যবস্থা নেই বুঝি?

ষোড়শী একবার মুখ তুলিয়াই আবার অধোমুখে স্থির হইয়া রহিল।

জবাব না পাইয়া জীবানন্দ সজোরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, ব্রজেশ্বরের কপাল ভাল ছিল; দেবী-রানী তাকে ধরে আনিয়েছিল সত্যি, কিন্তু অম্বুরী তামাক খাইয়েছিল, এবং ভোজনান্তে দক্ষিণা দিয়েছিল। বিদায়ের পালাটা আর তুলব না, বলি, বঙ্কিমবাবুর বইখানা পড়েচ ত?

ষোড়শী স্থির করিয়াছিল এই পাষণ্ড আজ তাহাকে যত অপমানই করুক সে নিরুত্তরে সহ্য করিবে, কিন্তু জীবানন্দের কণ্ঠস্বরের শেষ দিকটায় হঠাৎ কেমন যেন তাহার সঙ্কল্প ভাঙ্গিয়া দিল; বলিয়া ফেলিল, আপনাকে ধরে আনলে সেইমত ব্যবস্থাও থাকত—অনুযোগ করতে হতো না।

জীবানন্দ হাসিল, কহিল, তা বটে। টানা-হেঁচড়া দড়িদড়ার বাঁধাবাঁধিই মানুষের নজরে পড়ে। ভোজপুরী পেয়াদা পাঠিয়ে ধরে আনাটাই পাড়াসুদ্ধ সকলে দেখে; কিন্তু যে পেয়াদাটিকে চোখে দেখা যায় না—হাঁ অলকা, তোমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে কি বলে? অতনু, না? বেশ তিনি।

ষোড়শী আরক্ত অধোমুখে নির্বাক হইয়া রহিল।

জীবানন্দ কহিল, যৎসামান্য অনুরোধ ছিল, কিন্তু আজ উঠি। তোমার অনুচরগুলো সন্ধান পেলে ঠিক জামাই-আদর করবে না, এমন কি শ্বশুরবাড়ি এসেচি বলে হয়ত বিশ্বাস করতেই চাইবে না—ভাববে প্রাণের দায়ে বুঝি মিথ্যেই বলচি।

ষোড়শী কোন কথাই কহিল না; এই কদর্য পরিহাসে অন্তরে সে যে কিরূপ লজ্জা বোধ করিল, মুখ তুলিয়া তাহা জানিতেও দিল না।

জবাব না পাইয়া জীবানন্দ মুহূর্তকয়েক তাহার প্রতি চাহিয়া থাকিয়া সত্যই উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, অম্বুরী তামাকের ধুঁয়া আপাততঃ পেটে না গেলেও চলত; কিন্তু ধুঁয়া নয় এখন কিছু একটা পেটে না গেলে আর ত দাঁড়াতে পারিনে। বাস্তবিক নেই কিছু অলকা?

ষোড়শী চুপ করিয়াই থাকিত, কিন্তু তাহার নাম ধরিয়া শেষ প্রশ্নটা তাহাকে মৌন থাকিতে দিল না, মুখ তুলিয়া বলিল, কিছু কি? মদ?

জীবানন্দ হাসিয়া মাথা নাড়িল। কহিল, এবারে ভুল হলো! ওর জন্যে লোক আছে, সে তুমি নয়। তোমাকে বুঝতে পারার যথেষ্ট সুবিধে দিয়েচ—আর যা অপবাদ দিই, অস্পষ্টতার অপবাদ দিতে পারব না। অতএব তোমার কাছে যদি চাইতেই হয় ত চাই এমন কিছু যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মরণের দিকে ঠেলে দেয় না। ডাল-ভাত, মেঠাই-মণ্ডা, চিড়ে-মুড়ি যা হোক দাও, আমি খেয়ে বাঁচি। নেই?

ষোড়শী স্থিরচক্ষে চাহিয়া রহিল। জীবানন্দ বলিতে লাগিল, সকালে আজ মন ভাল ছিল না। শরীরের কথা তোলা বিড়ম্বনা, কারণ সুস্থ দেহ যে কি, আমি জানিনে। সকালে হঠাৎ নদীর তীরে বেরিয়ে পড়লাম—ধারে ধারে কতদূর যে হাঁটলাম বলতে পারিনে—ফিরতে ইচ্ছেই হলো না। সূর্যদেব অস্ত গেলেন, একলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি যে ভাল লাগল বলতে পারিনে। কেবল তোমাকে মনে পড়তে লাগলো। ফেরবার পথে তাই বোধ হয় আর বাড়ি গেলাম না, ক্ষিদে-তেষ্টা নিয়েই এসে দাঁড়ালাম ওই মন্‌সা গাছটার পেছনে। দেখি দোর খোলা, আলো জ্বলছে। পিস্তল ছাড়া আমি এক পা বাড়াইনে—ওটা পকেটেই ছিল, তবু গা ছমছম করতে লাগল। জানি ত বাবাজীবনরা আড়ালে-আবডালে কোথাও আছেন নিশ্চয়। হঠাৎ পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি মেঝের ওপর তুমি চুপ করে বসে। আপনাকে আর সামলাতে পারলাম না। বাস্তবিক নেই কিছু?

0 Shares