দেনা-পাওনা

ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল, জীবানন্দ হাতমুখ ধুইয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল, কহিল, আমি যখন একলা থাকি, সে রাত্রের কথা মনে মনে আলোচনা করে কোথা দিয়ে যে সময় কাটে বলতে পারিনে। বিশেষ করে চাকরদের ঘরে পাঠানোর ভয়ে তোমার সেই হাতজোড় করে কান্না! ভোলনি বোধ হয়?

ষোড়শী কহিল, না।

জীবানন্দ বলিল, তার পরে সেই শূলব্যথা। একলা ঘরে তুমি আর আমি। শেষে তোমার কোলেই মাথা রেখে আমার রাত কাটল। তারপরের ঘটনাগুলো আর ভাবতে ভাল লাগে না। তোমাকে ঘুষ দিতে যাবার কথা মনে হলে আমার পর্যন্ত যেন লজ্জায় গা শিউরে উঠে। এই সেদিন পুরীতে যখন মর-মর হলাম, প্রফুল্ল বললে, দাদা, অলকাকে একবার আনিয়ে নিন। আমি বললাম, সে আসবে কেন? প্রফুল্ল বললে, গায়ের জোরে। আমি বললাম, গায়ের জোরে ধরে এনে লাভ হবে কি? সে উত্তর দিলে, ঠাকরুন একবার আসুন ত, তার পরে এর লাভ-লোকসানের হিসেব হবে। তাকে তুমি জানো না, কিন্তু এতবড় ভক্ত তোমার আর নেই।

এই ভক্ত লোকটির পরিচয় জানিতে ষোড়শীর কৌতূহল হইল, কিন্তু সে-ইচ্ছা সে দমন করিয়া রাখিল।

জীবানন্দ কহিল, রাত অনেক হলো, তোমাকে আর বসিয়ে রাখতে পারিনে। এবার আমি যাই, কি বল?

ষোড়শী কহিল, আপনার কি-একটা যে কাজের কথা ছিল?

কাজের কথা? কিন্তু বিশেষ কি কথা ছিল আমার আর মনে পড়চে না। এখন কেবল একটা কথাই মনে পড়চে, তোমার সঙ্গে কথা কহাই আমার কাজ। বড্ড খোশামোদের মত শোনাল, না? কিন্তু এ-রকম খোশামোদ করতেও যে পারি, এর আগে তাও জানতাম না। হাঁ অলকা, তোমার কি সত্যি আবার বিয়ে হয়েছিল?

ষোড়শী মুখ তুলিয়া কহিল, আবার কি রকম? সত্যি বিয়ে আমার একবার মাত্রই হয়েছে।

জীবানন্দ বলিল, আর তোমার মা যে আমাকে দিয়েছিলেন, সেটাই কি সত্যি নয়?

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ অসঙ্কোচে কহিল, না, সে সত্যি নয়। মা আমার সঙ্গে যে টাকাটা দিয়েছিলেন আপনি তাই শুধু নিয়েছিলেন, আমাকে নেননি। ঠকানো ছাড়া তার মধ্যে লেশমাত্র সত্যও কোথাও ছিল না।

জীবানন্দ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল, কোনপ্রকার উত্তর দিবার চেষ্টা পর্যন্ত করিল না। মিনিট-পাঁচেক যখন এইভাবে কাটিয়া গেল, তখন ষোড়শী মনে মনে চঞ্চল হইয়া উঠিল, এবং ম্লান দীপশিখা উজ্জ্বল করিয়া দিবার অবসরে চাহিয়া দেখিল, সে যেন হঠাৎ ধ্যানে বসিয়া গেছে। এই ধ্যান ভাঙ্গিতে তাহার দ্বিধা বোধ হইল, কিন্তু ক্ষণেক পরে সে নিজেই যখন কথা কহিল, তখন মনে হইল কে যেন কতদূর হইতে কথা কহিতেছে।

অলকা, এ কথা তোমার সত্য নয়।

কোন কথা?

জীবানন্দ কহিল, তুমি যা জেনে রেখেচ। ভেবেছিলাম সে কাহিনী কখনো কাউকে বলব না, কিন্তু সেই কাউকের মধ্যে আজ তোমাকে ফেলতে পারচি নে। তোমার মাকে ঠকিয়েছিলাম, কিন্তু তোমাকে ঠকাবার সুযোগ ভগবান আমাকে দেননি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

বলুন।

জীবানন্দ কহিল, আমি সত্যবাদী নই, কিন্তু আজকের কথা আমার তুমি বিশ্বাস কর। তোমার মাকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করার মতলব আমার ছিল না—ছিল কেবল তাঁর টাকাটাই লক্ষ্য, কিন্তু সে-রাত্রে হাতে হাতে তোমাকে যখন পেলাম, তখন না বলে ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছেও আর হলো না।

তবে কি ইচ্ছে হলো?

জীবানন্দ কহিল, থাক, সে তুমি আর শুনতে চেয়ো না। হয়ত শেষ পর্যন্ত শুনলে আপনিই বুঝবে, এবং সে বোঝায় ক্ষতি বৈ লাভ আমার হবে না, কিন্তু এরা তোমাকে যা বুঝিয়েছিল তা তাই নয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাই নি।

ষোড়শী এই ইঙ্গিত বুঝিল, এবং ঘৃণায় কণ্টকিত হইয়া কহিল, আপনার না-পালানোর ইতিবৃত্ত এখন ব্যক্ত করুন।

তাহার কঠোর কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করিয়া জীবানন্দ মুচকিয়া হাসিল। কহিল, অলকা, আমি নির্বোধ নই, যদি ব্যক্তই করি, তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করব। তোমার মায়ের এতবড় ভয়ানক প্রস্তাবেও কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? একজন স্ত্রীলোকের হার আমি চুরি করি; ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করব। সে শান্ত হলো, কিন্তু পুলিশের ওয়ারেন্ট তাতে শান্ত হলো না। ছ’মাস জেলে গেলাম—সেই যে শেষ রাত্রে বার হয়েছিলাম, আর ফেরবার অবকাশ পেলাম না।

ষোড়শী নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া কহিল, তার পরে?

জীবানন্দ তেমনি মৃদু হাসিয়া বলিল, তার পরেও মন্দ নয়। জীবানন্দবাবুর নামে আরও একটা ওয়ারেন্ট ছিল। মাস-খানেক পূর্বে রেলগাড়িতে একজন বন্ধু সহযাত্রীর ব্যাগ নিয়ে তিনি অন্তর্ধান হন। ফলে আরও দেড় বৎসর। একুনে এই বছর-দুই নিরুদ্দেশের পর বীজগাঁয়ের ভাবী জমিদারবাবু আবার যখন রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করলেন, তখন কোথায় বা অলকা, আর কোথায় বা তার মা!

জীবানন্দের আত্মকাহিনীর এক অধ্যায় শেষ হইল। তার পরে দু’জনেই নিঃশব্দে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল।

রাত কত?

বোধ হয় আর বেশী বাকী নেই।

তা হলে এ অন্ধকারে বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই।

কাজ নেই? তার মানে?

ষোড়শী কহিল, কম্বলটা পেতে দিই, আপনি বিশ্রাম করুন।

জীবানন্দের দুই চক্ষু বিস্ফারিত হইয়া উঠিল, কহিল, বিশ্রাম করব? এখানে?

ষোড়শী কহিল, ক্ষতি কি?

কিন্তু বড়লোক জমিদারের যে এখানে কষ্ট হবে অলকা?

ষোড়শী বলিল, হলেও থাকতে হবে। গরীবের দুঃখটা আজ একটুখানি জেনে যান।

জীবানন্দ চুপ করিয়া রহিল। তাহার চোখের কোণে জল আসিতেছিল, ইচ্ছা হইল বলে, আমি জানি সব, কিন্তু বুঝিবার মানুষটা যে মরিয়াছে। কিন্তু এ-কথা না বলিয়া কহিল, যদি ঘুমিয়ে পড়ি অলকা?

অলকা শান্তভাবে জবাব দিল, সে সম্ভাবনা ত রইলই।

পরিচ্ছেদ – উনিশ

জীবানন্দের উচ্ছিষ্ট ভোজনপাত্র ও ভুক্তাবশেষ প্রভৃতি ফেলিয়া দিতে এবং রান্নাঘরের কিছু কিছু কাজ সরিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া আসিতে ষোড়শী বাহিরে চলিয়া গেলে, তাহার সেই চিঠির ছেঁড়া টুকরাখানি জীবানন্দের চোখে পড়িল। হাতে তুলিয়া লইয়া সেই মুক্তার মত সাজানো অক্ষরগুলির প্রতি মুগ্ধচক্ষে চাহিয়া সে প্রদীপের আলোকে রাখিয়া সমস্ত লেখাটুকু একনিঃশ্বাসে পড়িয়া ফেলিল। অনেক কথাই বাদ গিয়াছে, তথাপি এটুকু বুঝা গেল, লেখিকার বিপদের অবধি নাই, এবং সাহায্য না হোক, সহানুভূতি কামনা করিয়া এ পত্র যাহাকে সে লিখিয়াছে, সে নিজে যদিও নারী, কিন্তু অক্ষরের আড়ালে দাঁড়াইয়া আর এক ব্যক্তিকে ঝাপসা দেখা যাইতেছে যাহাকে কোনমতেই স্ত্রীলোক বলিয়া ভ্রম হয় না। এই পত্র তাহাকে যেন পাইয়া বসিল। একবার, দুইবার শেষ করিয়া যখন সে আরও একবার পড়িতে শুরু করিয়াছে, তখন ষোড়শীর পায়ের শব্দে মুখ তুলিয়া কহিল, সবটুকু থাকলে পড়ে বড় আনন্দ পেতাম! যেমন অক্ষর তেমনি ভাষা—ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

0 Shares