দেনা-পাওনা

শিরোমণি গায়ে পড়িয়া কহিলেন, ওকে জিরোবার একটু সময় দাও তোমরা—কি বল হে? বলিয়া তিনি চোখের একটা ইশারা করিয়া অকারণে হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে লাগিলেন। কেহ বা সে হাসিতে প্রকাশ্যে যোগ দিল, কেহ বা শুধু একটু মুচকিয়া হাসিল।

নির্মল সমস্ত অগ্রাহ্য করিয়া ভিতরে যাইতেছিল, শিরোমণি ডাকিয়া কহিলেন, বলি, বাবাজীকে কি ও বেটী কৌঁসুলি খাড়া করেচে নাকি?

নির্মল উদ্দীপ্ত ক্রোধ দমন করিয়া শান্তভাবে কহিল, মকদ্দমা বাধলে সে কাজ করতে হবে বোধ হয়।

শিরোমণি এ উত্তরের আশা করেন নাই, একটু থতমত খাইয়া বলিলেন, তা যেন করলে, কিন্তু বলে রাখি বাবাজী, এ পুঁটি মাছের প্রাণ নয়, বাঘা—ভাল্‌কোর সঙ্গে লড়াই—মকদ্দমা হাইকোর্টে না গড়িয়ে থামবে না, তা নিশ্চয় জেনো।

নির্মল কহিল, মামলা-মকদ্দমা কোথায় গিয়ে থামে এ ত আমার জানবার কথা শিরোমণিমশায়।

শিরোমণি কহিলেন, সে ত বটেই, এ হলো তোমার ব্যবসা, তুমি আর জানবে না! কিন্তু আরও ত ঢের খরচপত্র আছে, সে দেবে কে? বলিয়া তিনি মুখ টিপিয়া হাসিলেন। কিন্তু এ হাসিতে এবার কেহ যোগ দিল না।

নির্মল কহিল, অভাব হলে আমি দেব।

তাহার জবাব শুনিয়া শুধু শিরোমণি নয়, উপস্থিত সকলেই অবাক হইয়া গেলেন। রায়মহাশয় নিজেও ধৈর্য ধারণ করিতে পারিলেন না; রুক্ষকণ্ঠে বলিয়া ফেলিলেন, তোমাদের ঠাট্টা- তামাশার সম্পর্ক নয় নির্মল, বিশেষতঃ শিরোমণিমশাই প্রাচীন এবং সম্মানিত ব্যক্তি—উপহাস করা তোমার সাজে না।

নির্মল চুপ করিয়া রহিল; শিরোমণি সামলাইয়া লইয়া একটু হাসিবার প্রয়াস করিয়া কহিলেন, টাকা ত দেবে, কিন্তু দেবার গরজটা কি একটু শুনতে পাইনে?

নির্মল বলিল, আমার গরজ শুধু আপনাদের অন্যায় অত্যাচার। আমি যেখানে থাকি সেখানে যদি একবার খোঁজ নেন ত শুনতে পাবেন, জীবনে অনেক গরজই আমি মাথায় তুলে নিয়েচি।

যে লোকটা ডাকিতে আসিয়াছিল, সে তখনও যায় নাই; কহিল, আপনার কখন, যাবার সুবিধে হবে তাঁকে জানাবো?

আমার সময়মত দেখা করব বলো। বলিয়া সে বাটীর ভিতর প্রস্থান করিল।

সায়াহ্নবেলায় জনার্দন রায় প্রস্তুত হইয়া আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া ডাক দিয়া কহিলেন, মন্দিরে সকলে উপস্থিত হয়েচেন, তোমাকে তাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, যদি যাও ত আর বিলম্ব করো না।

নির্মল বাহিরে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমার যাওয়া কি আপনি প্রয়োজন মনে করেন?

জনার্দন কহিলেন, যাঁরা ডাকতে পাঠিয়েচেন, তাঁরা নিশ্চয়ই করেন, এই বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন।

সন্ধ্যার অব্যবহিত পরেই দেবীর আরতি শুরু হইল। মাতার বহুবিধ গৌরবের বস্তুই কালক্রমে বিরল হইয়া আসিতেছে, কিন্তু তাঁহার শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসর, ঢাক, ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ও যন্ত্রীর সংখ্যা প্রাচীনকাল হইতে অদ্যাবধি তেমনি বজায় আছে। সেই সম্মিলিত তুমুল বাদ্যনিনাদ নির্মল ঘরে বসিয়াই শুনিতে পাইল। কথা ছিল, আরতি শেষ হইলে পঞ্চায়েত বসিবে, অতএব সেই সুপবিত্র ধ্বনি থামিবার পর সে গৃহ হইতে যাত্রা করিল। মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দেখিল আলোর বন্দোবস্ত বিশেষ কিছু নাই, প্রাঙ্গণমধ্যস্থিত নাট-বাঙ্গালায় গোটা-দুই লণ্ঠন মাঝখানে রাখিয়া একটা কোলাহল উঠিয়াছে এবং তাহাই বহুলোক ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ হইয়া শুনিতেছে। সেই অন্ধকারে নির্মলকে কেহ চিনিল না, সে জন-দুই লোকের কাঁধের উপর উঁকি মারিয়া দেখিল তথায় কে একজন বাবুগোছের ভদ্রলোক হাতমুখ নাড়িয়া কি-সব বলিতেছেন। কিছুই শোনা গেল না, কিন্তু মানুষের আগ্রহ দেখিয়া এ কথা বুঝা গেল, তিনি অত্যন্ত শ্রুতিমধুর কাহারও নিন্দা ও গ্লানি করিতেছেন। এই ব্যক্তিই যে জমিদার জীবানন্দ চৌধুরী তাহা সে আন্দাজ করিল, অতএব বক্তব্যবস্তু যে ষোড়শীর জীবনচরিত তাহাতে সন্দেহ রহিল না। ভিড় ঠেলিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইতে যদিচ তাহার প্রবৃত্তি হইল না, কিন্তু দুই-একটা কথা শুনিবার লোভও সে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে না পারিয়া পায়ের দুই আঙুলে ভর দিয়া উদ্‌গ্রীব হইয়া দাঁড়াইল। কয়েক মুহূর্তেই মনে লাগিয়া গেল, তখনও জীবানন্দ চৌধুরী আসল বস্তুতে অবতীর্ণ হয় নাই—ষোড়শীর মায়ের ইতিবৃত্তেরই আখ্যান চলিতেছিল, অবশ্য সমস্তই শোনা কথা। সাক্ষী তারাদাস অদূরে বসিয়া—এই-সকল অসচ্চরিত্র স্ত্রীলোকদিগের সংস্রবে কিরূপে এই পীঠস্থান ক্রমশঃ ধীরে ধীরে অপবিত্র হইয়া উঠিতেছে এবং সমস্ত দেশের কল্যাণ তিরোহিত হইতেছে—

পিছনে পিঠের উপর একটু চাপ পড়িতে ফিরিয়া দেখিল কে একজন অন্ধকারে আগাগোড়া মুড়ি দিয়া তাহাকে বাহিরের দিকে ইশারা করিল এবং তাহাকেই অনুসরণ করিয়া কয়েক পদ অগ্রসর হইতে নির্মল স্পষ্ট বুঝিতে পারিল এই সুগঠিত দীর্ঘ ঋজুদেহ ষোড়শী ভিন্ন আর কাহারও নহে। সে দ্বারের বাহিরে আসিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল এবং ঈষৎ একটু হাসিয়া অনুযোগের কণ্ঠে কহিল, ছি, ছি, কি দাঁড়িয়ে যা-তা শুনচেন! কতকগুলো কাপুরুষ মিলে দু’জন অসহায় স্ত্রীলোকের কুৎসা রটনা করচে—তাও আবার একজন মৃত, আর একজন অনুপস্থিত। চলুন আমার ঘরে, সেখানে ফকিরসাহেব বসে আছেন, আপনাকে পরিচিত ক’রে দিই গে।

তিনি কবে এলেন?

কি জানি। বিকেলবেলা ফিরে গিয়ে দেখি আমার ঘরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আনন্দ আর রাখতে পারলাম না, প্রণাম করে নিয়ে গিয়ে আমার ঘরে বসালাম, সমস্ত ইতিহাস মন দিয়ে শুনলেন।

শুনে কি বললেন?

শুধু একটু হাসলেন। বোধ হলো যেন সমস্তই জানতেন। কিন্তু হাঁ নির্মলবাবু, আপনি নাকি বলেচেন আমার মামলা-মকদ্দমার সমস্ত ভার নেবেন? একি সত্যি?

নির্মল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ সত্যি।

কিন্তু কেন নেবেন?

নির্মল একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, বোধ করি আপনার প্রতি অন্যায় অত্যাচার হচ্চে বলেই।

কিন্তু আর কিছু বোধ করেন না ত? বলিয়াই ষোড়শী ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, থাক, সব কথার যে জবাব দিতেই হবে এমন কিছু শাস্ত্রের অনুশাসন নেই। বিশেষ করে এই কূট-কচালে শাস্ত্রের—না? আসুন, আমার ঘরে আসুন।

0 Shares