দেনা-পাওনা

তাহার কুটীরে প্রবেশ করিয়া দেখিল ফকিরসাহেব নাই। কহিল, কোথায় গেছেন, বোধ হয় এখনি ফিরে আসবেন। প্রদীপ স্তিমিত হইয়া আসিয়াছিল, উজ্জ্বল করিয়া দিয়া পাতা-আসনখানি দেখাইয়া দিয়া কহিল, বসুন। হাঙ্গামা, হৈচৈ, গণ্ডগোলের মাঝে এমন সময় পাইনে, যে বসে দু’দণ্ড গল্প করি। আচ্ছা, মকদ্দমার যেন সকল ভারই নিলেন, কিন্তু যদি হারি, তখন ভার কে নেবে? তখন পেছবেন না ত?

নির্মল জবাব দিতে পারিল না, তাহার কান পর্যন্ত রাঙ্গা হইয়া উঠিল। খানিকক্ষণ পরে কহিল, হারবার কোন সম্ভাবনা আমাদের নেই।

তা বটে। বলিয়া একবার একটুখানি যেন ষোড়শী বিমনা হইয়া পড়িল, কিন্তু পলকমাত্র। সহসা চকিত হইয়া প্রশ্ন করিল, ছেলে কেমন আছে নির্মলবাবু? কি করে তাকে ছেড়ে এলেন বলুন ত? আমি ত পারিনে।

অকস্মাৎ এই অসংলগ্ন প্রশ্নে নির্মল আশ্চর্য হইল। ষোড়শী একবার এ-দিকে একবার ও-দিকে বার দুই-তিন মাথা নাড়িয়া হাসিমুখে বলিল, আমি কিন্তু হৈম হলে এই-সমস্ত পরোপকার করা আপনার ঘুচিয়ে দিতাম। অত ভালমানুষ নই—আমার কাছে ফাঁকি চলত না—রাত্রি-দিন চোখে চোখে রাখতাম।

ইঙ্গিত এত সুস্পষ্ট যে নির্মলের বুকের মধ্যেটা বিস্ময়ে, ভয়ে ও আনন্দে একই সঙ্গে ও একই কালে তরঙ্গিত হইয়া উঠিল। এবং সেই অসংবৃত অবসরে মুখ দিয়া তাহার বাহির হইয়া গেল, চোখে চোখে রাখলেই কি রাখা যায় ষোড়শী? এর বাঁধন যেখানে শুরু হয়, চোখের দৃষ্টি যে সেখানে পৌঁছায় না, এ কথা কি আজও জানতে তুমি পারোনি?

পেরেচি বৈ কি, বলিয়া ষোড়শী হাসিল। বাহিরে হঠাৎ একটা শব্দ শুনিয়া গলা বাড়াইয়া দেখিয়া কহিল, এই যে ইনি এসেচেন।

কে? ফকিরসাহেব?

না, জমিদারবাবু। বলে পাঠিয়েছিলাম সভা ভাঙ্গলে যাবার পথে আমার কুঁড়েতে একবার একটু পদধূলি দিতে। তাই দিতেই বোধ হয় আসচেন। সঙ্গে লোকজন বিস্তর, স্ত্রীলোকের ঘরে একাকী আসতে বোধ করি সাধুপুরুষের ভরসায় কুলোয় নি। পাছে দুর্নাম হয়। বলিয়া সে হাসিতে লাগিল।

ব্যাপারটা নির্মলের একেবারে ভাল লাগিল না। সে বিরক্তি ও সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া বলিল, এ কথা আমাকে আপনি বলেন নি কেন?

বেশ! একবার তুমি একবার আপনি, বলিয়া সে হাসিয়া কহিল, ভয় নেই, উনি ভারী ভদ্রলোক, লড়াই করেন না। তা ছাড়া, আপনাদের ত পরিচয় নেই—সেটাও একটা লাভ। বলিয়া সে দ্বারের বাহিরে অগ্রসর হইয়া অভ্যর্থনা করিয়া কহিল, আসুন—আমার কুঁড়ে আর একবার পবিত্র হ’লো।

জীবানন্দ চৌকাঠে পা দিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, ইনি? নির্মলবাবু বোধ হয়?

ষোড়শী হাসিমুখে জবাব দিল, হাঁ, আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দিলে খুব সম্ভব অতিশয়োক্তি হবে না।

পরিচ্ছেদ – বাইশ

অনুমান যে ভুল নয়, লোকটি যে সত্য সত্যই নির্মল বসু, তাহা বুঝিতে পারিয়া জীবানন্দ প্রথমে চমকিত হইল, কিন্তু যে-কোন অবস্থায় নিজেকে মুহূর্তে সামলাইয়া লইবার শক্তি তাহার অদ্ভুত। সে সামান্য একটু হাসিয়া বলিল, বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে, তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।

নির্মলের গোড়া হইতেই ভাল লাগে নাই, কিন্তু নিজের দুষ্কৃতির এই লজ্জাহীন, অনাবৃত রসিকতার চেষ্টায় তাহার গা জ্বলিয়া গেল। মুখ লাল করিয়া কি একটা বলিতেও চাহিল, কিন্তু বলিতে হইল না। ষোড়শী জবাব দিল, কহিল, চৌধুরীমশায়, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন? আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপার না হোক, কিন্তু ছোট বলে এ দেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতে পারে না?

জীবানন্দ অপ্রস্তুত হইয়া হঠাৎ যাহা মুখে আসিল কহিল। বলিল, ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, এই যেমন মন্দিরে দাঁড়িয়ে এইমাত্র একদফা দিয়ে এলেন।

জীবানন্দ ইহার কোন জবাব দিল না। নির্মলের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনার শ্বশুরমহাশয়ের মুখে শুনলাম আপনি আসচেন—আশা করেছিলাম মন্দিরেই আলাপ হবে।

ষোড়শী বলিল, সে আমার দোষ চৌধুরীমশায়। উনি এসেও ছিলেন এবং সদালাপে যোগ না দিন, ভিড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে শোনবার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু আমি দেখতে পেয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম। বললাম, চলুন নির্মলবাবু, ঘরে বসে বরঞ্চ দুটো গল্প-সল্প করা যাক।

জীবানন্দ মনের উত্তাপ চাপিয়া কতকটা সহজ গলাতেই কহিল, তা হলে আমি এসে পড়ে ত ব্যাঘাত দিলাম।

ষোড়শী বলিল, দিয়ে থাকলেও আপনার দোষ নেই—আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।

জীবানন্দ কহিল, কিন্তু কেন? গল্প করতে নয় বোধ হয়?

ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল; বলিল, না গো মশায়, না—বরঞ্চ ঠিক তার উলটো। আজ আপনাকে আমি ভারী বক্‌বো। তাহার কণ্ঠস্বর ও কথা কহিবার ভঙ্গী দেখিয়া নির্মল ও জীবানন্দ উভয়েই আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল। ষোড়শী হঠাৎ একটুখানি গম্ভীর হইয়া বলিল, ছি, ছি, ওখানে অত কি করছিলেন বলুন ত? একটা সভার আড়ম্বর করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’জন অসহায় স্ত্রীলোকের কি কুৎসাই রটনা করছিলেন! এর মধ্যে একজন আবার বেঁচে নেই। এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া, কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত?

সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, আমিও আমার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করিনি। এই নিন মন্দিরের চাবি, এবং এই নিন হিসাবের খাতা। বলিয়া সে অঞ্চল হইতে চাবির গোছা খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিয়া কহিল, মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিল-পত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আরও একখানা কাগজ পাবেন যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েচি।

0 Shares