দেনা-পাওনা

প্রফুল্ল সভয়ে কহিল, বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র সমর্পণ ডাইনীর হাতে?

জীবানন্দ রাগ করিল না, কহিল, নিতান্ত মিথ্যা বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, অথচ, এ আমি চাইনি প্রফুল্ল। আমি যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম জনার্দন রায়কে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে আমার হাতে গুঁজে দিলে।

প্রফুল্ল নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এর কারণ?

জীবানন্দ কহিল, বোধ হয় সে ভেবেছিল, এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপলে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।

প্রফুল্ল বলিল, কিন্তু আপনাকে সে চিনতে পারেনি।

জীবানন্দ হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না; কহিল, সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আমার আর যতদিকেই থাক, আমাকে চিনতে না পারার অপরাধ গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত আমি একটা দিনের তরেও করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এই মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি ঠিক করে নেয়, কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে মরফিয়া নিয়ে চোখ বুজে খাওয়ার গল্পটা তোমার কাছে করেছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের শেষ তর্ক, সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর যে কোন উপায় ছিল না, এদিকেও মরি, ওদিকেও মরি—সে ছাড়া আর কারও পানে চাইবার পথ ছিল না—এ-সমস্ত ষোড়শী একদম ভুলে বসে আছে, শুধু একটি কথা তার মনে জেগে রয়েছে, যে নিজের প্রাণটা নিঃসংশয়ে তার হাতে দিতে পেরেছিল, তাকে আবার অবিশ্বাস করা যায় কি করে? ব্যস্‌, যা-কিছু ছিল সমস্ত দিলে চোখ বুজে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ার ভয়ানক চালাক লোকও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসার একেবারে মরুভূমি হয়ে দাঁড়াতো, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবার ঠাঁই পেত না।

প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, অতিশয় খাঁটি কথা দাদা। অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পুড়িয়ে ফেলুন, তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন—জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধা যায় ত, শুধু রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।

জীবানন্দ কহিল, প্রফুল্ল, এইজন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।

প্রফুল্ল হাত জোড় করিয়া বলিল, এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলায় চুঙ্গি পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেল। এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের যোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।

জীবানন্দ হাসিয়া কহিল, একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হ’লো প্রফুল্ল?

বার-চারেক। এই বলিয়া সে নিজেও হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে-মাঝে বার করতে পারি ত নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নিচু বলে এ দেহটায় মেদ-মাংসই কেবল শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেচে, সত্যিকারের রক্ত বলতে বোধ করি ছিটেফোঁটাও আর বাকী নেই। আজ ভাবচি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে খপ্‌ করে ভৈরবী ঠাকরুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে গিলে ফেলব। আপনার অনেক ভালমন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্থ করেচি, এ নইলে সেগুলা আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।

জীবানন্দ হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্ছে প্রফুল্ল।

প্রফুল্ল পুনশ্চ হাতজোড় করিয়া কহিল, তাহলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেবি-পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেচেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন—চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না, কিন্তু আমাকে দান করে অতগুলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।

জীবানন্দ কহিল, তা হলে এবার আমাকে তুমি সত্যি সত্যিই ছাড়লে?

প্রফুল্ল তেমনি করজোড়ে কহিল, আশীর্বাদ করুন, এই সুমতিটুকু শেষ পর্যন্ত যেন বজায় থাকে।

জীবানন্দ মৌন হইয়া রহিল।

প্রফুল্ল জিজ্ঞাসা করিল, কবে যাচ্চেন তিনি?

জানিনে।

কোথায় যাচ্ছেন তিনি?

তাও জানিনে।

প্রফুল্ল কহিল, জেনেও কোন লাভ নেই দাদা। সহসা তাহার মুখের চেহারা বদলাইয়া গেল, কহিল, বাপ রে! মেয়েমানুষ ত নয়, যেন পুরুষের বাবা! মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম, মনে হল, যেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত একেবারে পাথরে গড়া। ঘা মেরে মেরে গুঁড়ো করা যাবে, কিন্তু আগুনে গলিয়ে যে ইচ্ছেমত ছাঁচে ঢেলে গড়বেন, সেই বস্তুই নয়। পারেন ত ও মতলবটা পরিত্যাগ করবেন।

জীবানন্দ কতকটা বিদ্রূপের ভঙ্গিতে প্রশ্ন করিল, তা হলে প্রফুল্ল এবার নিতান্তই যাচ্চো?

প্রফুল্ল সবিনয়ে জবাব দিল, গুরুজনের আশীর্বাদের জোর থাকে ত মনস্কামনা সিদ্ধ হবে বৈ কি।

জীবানন্দ কহিল, তা হতে পারে। কিন্তু কি করবে স্থির করেচ?

প্রফুল্ল বলিল, অভিলাষ ত আপনার কাছে ব্যক্ত করেচি। প্রথমে চারটি ডালভাতের যোগাড়ের চেষ্টা করব।

জীবানন্দ কয়েক মুহূর্ত নীরবে থাকিয়া প্রশ্ন করিল, ষোড়শী সত্যই চলে যাবে তোমার মনে হয়?

প্রফুল্ল কহিল, হয়। তার কারণ, সংসারে সবাই প্রফুল্ল নয়। ভাল কথা দাদা, একটা খবর আপনাকে দিতে ভুলেছিলাম। কাল রাত্রে নদীর ধারে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি সেই ফকির-সাহেব। আপনাকে যিনি একদিন তাঁর বটগাছে ঘুঘু শিকার করতে দেননি—বন্দুক কেড়ে নিয়েছিলেন—তিনি। কুর্নিশ করে কুশল প্রশ্ন করলাম, ইচ্ছে ছিল মুখরোচক দুটো খোশামোদ-টোশামোদ করে যদি একটা কোন ভালরকমের ওষুধ-টষুধ বার করে নিতে পারি ত আপনাকে ধরে পেটেন্ট নিয়ে বেচে দু’পয়সা রোজগার করব। কিন্তু ব্যাটা ভারী চালাক, সেদিক দিয়েই গেল না। কথায় কথায় শুনলাম তাঁর ভৈরবী-মাকে দেখতে এসেছিলেন, এখন চলে যাচ্ছেন। ভৈরবী যে সমস্ত ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্চেন, তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম।

0 Shares